ঢাকা, মঙ্গলবার ৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯শে অগ্রহায়ণ ১৪৩১

কক্সবাজারে মাধ্যমিকে এমপিওভুক্তি নিয়ে কোটি টাকার লেনদেন

স.ম ইকবাল বাহার চৌধুরী, কক্সবাজার : | প্রকাশের সময় : রবিবার ৬ অক্টোবর ২০২৪ ১০:৫৯:০০ অপরাহ্ন | চট্টগ্রাম প্রতিদিন

কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমুহের এমপিও নিয়ে চরম বানিজ্য চলছে। এমপিও'র ক্ষেত্রে চরম অনিয়ম ঠেকাতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় সব নির্দেশনা দিলেও ঠেকানো যাচ্ছেনা অনিয়ম। ফলে দীর্ঘসময়ে বিনা পারিশ্রমিকে শিক্ষকতা করা অনেকেই এমপিওভুক্ত বঞ্চিত হয়েছেন এমন অভিযোগ অহরহ। তবুও নিরব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। মহেশখালী উপজেলার নতুন এমপিও ভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহে কোটি টাকার লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে। সরজমিন পাওয়া তথ্যে জানা যায়, মহেশখালী তে নতুন এমপিওভুক্ত  শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যে সব শিক্ষক-কর্মচারী এমপিওভুক্ত হন এরমধ্যে অনেকেই ওইসব প্রতিষ্ঠানে ইতিপূর্বে কর্মরত ছিলো না। এছাড়াও নতুনসৃষ্ট বেশকিছু পদে এমপিওভুক্তির সময় জালসনদ নিয়ে নিয়োগ পেয়েছেন এমন অভিযোগ উঠেছে। এরপরেও কিভাবে এমপিওভুক্ত হলো তা জানতে সরজমিন সংশ্লিষ্টদের কাছে পাওয়া যায় চাঞ্চল্যকর তথ্য। 

 

 

      প্রত্যেকটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যানবেইস জরিপ ভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীদের বাদ দিয়ে অনিয়মের মাধ্যমে কয়েক লাখ টাকায় নিয়োগ হয় অনেকেই। প্রত্যেকটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভুয়া এমপিওভুক্তির সময় প্রায় কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে এমনই দাবি উঠেছে। যদিও ব্যানবেইস তথ্যের ভিত্তিতে শিক্ষক এমপিওভুক্তির তালিকা প্রেরণের নির্দেশ দিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরিপত্র জারি করেন। এসব তোয়াক্কা না করে জাল জালিয়াতির মাধ্যমে হয় সবকিছু, এসব জেনেও উদাসীন কর্তৃপক্ষ। মহেশখালীর কালারমারছড়া মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসা ২০১৯ সালে আলিম এমপিওভুক্ত হয়, এরপর শিক্ষক এমপিওভুক্ত  করণের সময় চলে মোটা অংকের নিয়োগ বাণিজ্য। ইতিপূর্বে মাদ্রাসায় কর্মরত ছিলো না এমন ব্যক্তিকে সাত লাখ টাকায় করেছেন আরবি প্রভাষক।

 

 

      জাল জালিয়াতির মাধ্যমে সৃষ্ট কাগজে কুতুবউদ্দিন কে ২৫ ডিসেম্বর ১৫ সালে যোগদান দেখিয়ে এমপিওভুক্ত করে নেন জুলাই ২০২০ সালে। তবে ব্যানবেইস তথ্যে ও কর্মরত শিক্ষকদের ভাষ্যে আরবি প্রভাষকের বিরুদ্ধে  চাঞ্চল্যকর অনিয়মের তথ্য। এ ছাড়াও করোনা কালীন সময়ে অনলাইন ক্লাস রুটিনে আরবি প্রভাষক কুতুবউদ্দিনের নাম নেই। তথ্যে উঠে আসে ওই সময়ে দাখিল ও আলিম স্তরে কোরআন ও হাদিস ক্লাস নিতেন আজিজুর রহমান, শাহিদা আক্তার এবং আনোয়ারুল করিম নামের তিনজন শিক্ষক। কুতুব উদ্দিনের অবৈধ নিয়োগসহ অধ্যক্ষের বহুবিধ অনিয়মের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন সেলিম চৌধুরী। এতে তদন্ত সংশ্লিষ্টদের কারণে বারবার সময় ক্ষেপণ করে যাচ্ছেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মুবিন।

 

 

   আজ্ঞাবহ কমিটি নিয়ে একইভাবে হোয়ানক আদর্শ বিদ্যাপীঠে ও হয়েছে সীমাহীন জালিয়াতি। এ প্রতিষ্ঠানে ল্যাব অনুমোদন না থাকলেও ভুয়া কাগজপত্রে কম্পিউটার ল্যাব অপারেটর এমপিওভুক্ত হয়েছেন। এ ছাড়াও দীর্ঘদিন যাবৎ প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে এলাকার বাইরে অবস্থান করেও অবশেষে জাফর আলম হয়ে গেলেন প্রধান শিক্ষক! প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ওই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক এমপিওভুক্ত হওয়ার সময় দীর্ঘদিন থেকে কর্মরত শিক্ষকদের বাদ দিয়ে টাকার বিনিময়ে শিক্ষক এমপিওভুক্ত হয়েছে। এরকম একজন হোয়ানক বালিকা বিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা বিষয়ের শিক্ষক মোহাম্মদ ইসহাক, তাকে হোয়ানক বিদ্যাপীঠে আইসিটি শিক্ষক হিসেবে এমপিওভুক্ত করা হয়। অথচ ব্যানবেইস জরিপে ওই শিক্ষক ১ লা জানুয়ারী/০৫ যোগদান করে ২০১৯ সাল পর্যন্ত হোয়ানক বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে তথ্য পাওয়া যায়।

 

 

       ভুয়া তথ্যে তাকে ১৫ মার্চ ২০০৫ সালে হোয়ানক বিদ্যাপীঠে যোগদান দেখানো হয়েছে। এছাড়াও ওই প্রতিষ্ঠানে কয়েকজন শিক্ষক ভুয়া সনদে চাকরি করে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ না করেও এধরণের সনদ নিয়ে দেওয়ার পেছনের কারিগর হিসেবে মহেশখালীর একজন প্রতিষ্ঠান প্রধানের নাম উচ্চারিত হয় লোকে মুখে। এছাড়াও মাতারবাড়ী পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ছিলোনা এমন বিষয়েও শিক্ষক এমপিওভুক্ত হয়, এমনকি এনটিআরসিএ কর্তৃক যে বিষয়ের শিক্ষক দেওয়ার কথা সে শিক্ষকও অভূতপূর্ব জালিয়াতির মাধ্যমে এমপিওভুক্ত হয়েছেন 'এমন সত্যতা পাওয়া যায়। আরেক জালিয়াতির আখড়ায় পরিনত জলেয়ারমার ঘাট উচ্চ বিদ্যালয়, ওই প্রতিষ্ঠানের প্রধান কাইছার লিটনের হাতে হয়নি এমন কোন অনিয়ম নেই। 

 

 

       শিক্ষা কর্মকর্তাদের যোগসাজসে ওই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান শিক্ষক নুর মোহাম্মদকে কৌশলে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন কাইছার লিটন। কম্পিউটার সংক্রান্ত কোন প্রাথমিক ধারনা না থাকলেও সাবেক প্রধান শিক্ষক নুর মোহাম্মদ কে আই সি টি শিক্ষক হিসেবে দেখান। এভাবেই শুরু করেন নজিরবিহীন অনিয়ম, ল্যাব অনুমোদন না থাকলেও নিয়ে নেন ল্যাব অপারেটর, মোটা অংকের টাকায় বেশকিছু শিক্ষক এমপিওভুক্ত করেন' এমন অভিযোগ স্থানীয়দের মুখেমুখে। জালিয়াতির মাধ্যমে ল্যাব অপারেটর এমপিও ভুক্তির বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ দিলেও গাফিলতির করে যাচ্ছেন মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা' এমন অভিযোগ উঠেছে। মহেশখালীতে শিক্ষক এমপিও ভুক্তি নিয়ে অহরহ অভিযোগ প্রকাশ্যে এলেও কিছুই জানেন না শিক্ষা অফিসার। 

 

 

  অভিযোগ উঠেছে  শিক্ষা অফিসার মোহাম্মদ জাহিদুর রহমান নিজেও এমপিওভুক্তির বাণিজ্যে জড়িত। যার দরুণ তিনি জলেয়ারমার ঘাট উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীর তালিকা প্রেরণে বেনবেইস জরিপ আমলে না নিয়ে অনিয়মের আশ্রয় নিয়েছেন। এ বিষয়ে জানতে মাধ্যমুক শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাহিদুর রহমান এর সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, এমপিওভুক্তির অনিয়মের বিষয়ে তার কাছে কোন তথ্য নেই। এছাড়াও কুতুবজোম সুমাইয়া বালিকা দাখিল মাদ্রাসা, গোরকঘাটা হাই স্কুলেও অকল্পনীয় নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ পাওয়া যায়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমপিওর ক্ষেত্রে অনিয়মের বিষয়ে জানতে জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মোহাম্মদ নাছির উদ্দীন এর সাথে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ চেষ্টা করেও সংযোগ না পাওয়ায় বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। 

 

 

    এমনও তথ্য পাওয়া যায়, কোনো কোনো শিক্ষক কর্মচারীর জন্মসাল ও যোগদানের তারিখেও বেনবেইস তথ্যে রয়েছে ভিন্নতা। সবমিলিয়ে শক্তিশালী জালিয়াত সিন্ডিকেট এর কারণে এমপিওভুক্তির অনিয়ম  নিয়ে কার্যকরি কোন পদক্ষেপ দৃশ্যমান হচ্ছে না এমন অভিযোগ সচেতন মহলের। এ বিষয়ে জানতে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মাধ্যমিক শাখার পরিচালক প্রফেসর সৈয়দ আলী আহসান এর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি জানান -প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক এমপিও'র ক্ষেত্রে যে অনিয়ম হয়েছে তা তিনি অবগত, সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে কেউ অভিযোগ করলে আইনানুগ ব্যবস্থা নিবেন। তবে অনিয়মের বিরুদ্ধে অভিযোগকারী অনেকেই জানান -লিখিত অভিযোগ দিলেও কার্যত কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।

 

 

     কারণ এধরণের অনিয়মে উপজেলা থেকে শুরু করে অধিদপ্তর পর্যন্ত বেশকিছু অসাধু কর্মকর্তা জড়িত আছেন। মাঠপর্যায়ে তথ্য সংগ্রহে সংশ্লিষ্ট অফিস সমুহের অনিয়ম জালিয়াতিতে সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, শিক্ষক এমপিওভুক্ত করার ক্ষেত্রে প্রথম পর্যায়ে কমিটি কর্তৃক শিক্ষক কর্মচারীর তালিকা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসে পাঠানো হয়। এরপর ওই তালিকা যথাযথ আছে কিনা তা যাচাই-বাছাই করেন উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার সহ যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্যরা। তবে শুরুতেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অমান্য করে মোটা অংকের টাকায় বেনবেইস তালিকা বহির্ভুত ব্যক্তিদের নাম প্রস্তাবে সুপারিশ করেন ওই কমিটি 'এমন অভিযোগ উঠেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ ধরণের অনিয়ম চলমান থাকলে জাতিকে এর চরম কুফল ভোগ করতে হবে এমনটা জানান অবসরপ্রাপ্ত বেশ কয়েকজন প্রতিষ্ঠান প্রধান। তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে গুরুত্বারোপ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবেন এমনটাই আশা করেন সচেতন মহল।