ঢাকা, রবিবার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১
১৯৮৩ সালের রক্তাক্ত ১৪ ফেব্রুয়ারি

কেন স্মরণ করবেন জয়নাল-কাঞ্চন-দীপালিদের

নিজস্ব প্রতিবেদক : | প্রকাশের সময় : সোমবার ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০২২ ১২:০০:০০ অপরাহ্ন | জাতীয়

১৯৮২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবসে সামরিক সরকারের শিক্ষামন্ত্রী মজিদ খান-এর শিক্ষানীতি বাতিলের দাবি তোলে ছাত্র সংগঠনগুলো। ছাত্ররা মনে করেছিল, এই নীতিতে দরিদ্র শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। আর এ আন্দোলন জন্ম দেয় ১৯৮৩ সালের রক্তাক্ত ১৪ ফেব্রুয়ারির। রাজপথে সেইদিন ঝরেছিল জয়নাল, জাফর, কাঞ্চন, দীপালীসহ আরও অনেকের প্রাণ। কালের গহ্বরে দিনটিতে সেই শহীদদের স্মরণ সীমিত হয়ে আসে।

সেই আন্দোলনে জড়িত ছাত্রনেতারা বলছেন, এই দিনটি আমাদের বারবার শেকড় সন্ধানী করে। এই শহীদদের আত্মত্যাগ স্মরণ করা জরুরি। কেননা ১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ সময়টাতে যারা ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তাদের লক্ষ্য পরিপূর্ণভাবে অর্জিত হয়নি। 

১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ মজিদ খানের কুখ্যাত শিক্ষানীতি প্রত্যাহার, বন্দি মুক্তি ও গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবি ও গণমুখী, বৈজ্ঞানিক ও অসাম্প্রদায়িক শিক্ষানীতির দাবিতে ছাত্র জমায়েত ডাকে। হাজার হাজার শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ মিছিলটি হাইকোর্টের গেটের সামনে ব্যারিকেডের সামনে বসে পড়ে এবং ছাত্রনেতারা তারের ওপরে উঠে বক্তৃতা শুরু করে। এসময় পুলিশ বিনা উসকানিতে তারের একপাশ সরিয়ে রায়ট কার ঢুকিয়ে দিয়ে রঙিন গরম পানি ছেটাতে থাকে, বেধড়ক লাঠিচার্জ, ইট-পাটকেল ও বেপরোয়া গুলি ছুড়তে শুরু করে। গুলিবিদ্ধ হন জয়নাল, এরপর গুলিবিদ্ধ জয়নালকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারা হয়।

 

এসময় দিপালীও গুলিবিদ্ধ হন এবং পুলিশ তার লাশ গুম করে ফেলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিহত ও আহতদের অ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়ে নিয়ে আসতে চাইলে ঘটনাস্থলে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। ওইদিন নিহত হয়েছিলেন জয়নাল, জাফর, কাঞ্চন, দীপালীসহ আরও অনেকে। সরকারি হিসাবেই তখন গ্রেফতার করা হয় ১ হাজার ৩৩১ জন ছাত্র-জনতাকে। বাস্তবে এই সংখ্যা আরও বেশি ছিল। খোঁজ মেলেনি অনেকেরই।

সেসময়ের ছাত্রনেতা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, যেভাবে পূর্ণ গণতান্ত্রিক পরিবেশ হোঁচট খেয়েছে, তাতে আশির দশকের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা আন্দোলন-সংগ্রামকে আমাদের বারবার স্মরণ করতে হয়। শাসনতান্ত্রিকভাবে আইনগতভাবে আমরা এখন সামরিক শাসন থেকে আলাদা জায়গায় আছি সন্দেহ নেই। কিন্তু সাধারণ মামুষের সামনে কী এসে দাঁড়িয়েছে। বৈষম্য বেড়েছে, গণতান্ত্রিক পরিবেশে তা হওয়ারকথা ছিল না। ৮৩ থেকে ৯০ যারা ত্যাগ স্বীকার করলো, অনেকে প্রাণ হারালো, সেই সময়টাতে ফিরে যেতেই হয়। জয়নাল, দীপালি, কাঞ্চনদের স্মরণ করা হয় না, কারণ তারা সাধারণ ঘরের সন্তান ছিলেন। কিন্তু ছাত্র সমাজের যে প্রচণ্ড শক্তি, চাইলে যেতারা সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে ক্ষমতার ভিত নাড়িয়ে দিতে পারে, তা ভুলে গেলে চলবে না। 

 

সেদিনের কথা স্মরণ করে ডা. মুশতাক বলেন, ‘১৪ ফেব্রুয়ারি আমরা শুধু জয়নালের লাশ পাই। দিপালী সাহার লাশ গুম করে ফেলে, তার লাশ আমরা পাইনি। ১৫ ফেব্রুয়ারি কাঞ্চন চট্টগ্রাম শহরে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। আরও অনেকে নিখোঁজ হন। তাদের জীবিত বা মৃত কোনও অবস্থাতেই পাওয়া যায়নি। এই প্রজন্মকে সেই দিনটি স্মরণ করাতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। এ দায় স্বীকার করে নিতে আমার আপত্তি নেই। ইতিহাসে অনেক ঘটনা আছে,পরবর্তী প্রজন্ম ভুলে গেলেও তারও পরবর্তী প্রজন্ম আবার খুঁজে বের করে, ইতিহাস হারায় না।

আশির দশকের আরেক ছাত্রনেতা ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, নতুন প্রজন্মের গণতান্ত্রিক মনস্কতা গড়ে তোলার জন্য জয়নাল-দীপালিদের যে আত্মত্যাগ তা স্মরণ জরুরি। আমরা বাজারঅর্থনীতির চাকচিক্যে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ভুলতে বসি। এই প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আমাদের মূল শেকড়ে ফিরে যেতে হবে। সেকারণেই এই ছাত্রনেতাদের আত্মত্যাগ স্মরণ জরুরি।