নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নিবন্ধন পেতে উচ্চ আদালতের ওপর ভরসা করতে হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোকে। ইসির ‘শর্ত পূরণ’ করে নিয়মতান্ত্রিকভাবে আবেদন করলেও প্রায় সবাই ব্যর্থ হচ্ছে নিবন্ধন সনদ পেতে। তবে ইসির অযোগ্য বিবেচিত এসব দলের কয়েকটি ইতোমধ্যে উচ্চ আদালতের মাধ্যমেই নিবন্ধন পেয়েছে। ইসির নিবন্ধন পাওয়া সর্বশেষ ৫টি দলের সবগুলোই নিবন্ধন পেয়েছে আদালতের আদেশে।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একাধিক দলের নিবন্ধনের রিট উচ্চ আদালতে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। পাশাপাশি বেশ কয়েকটি দল নিবন্ধন পেতে আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এর মধ্যে ইসির কাছে আবেদন নিষ্পত্তির অপেক্ষায় থাকা কয়েকটি দলও রয়েছে।
সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন ২০০৮ সালে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিবন্ধনের আওতায় আনে। ওই সময় গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংশোধন করে রাজনৈতিক দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়। সে সময় ১১৭টি দল আবেদন করেছিল। যাচাই- বাছাইয়ে পর নিবন্ধন পায় ৩৯টি। তবে, এর মধ্যে ইসির শর্ত পূরণ করতে না পারায় ফ্রিডম পার্টির নিবন্ধন বাতিল হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশসহ আরও চারটি দলের নিবন্ধন বাতিল হয়। অন্যদলগুলো হলো ঐক্যবদ্ধ নাগরিক আন্দোলন, প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক পার্টি (পিডিপি) ও জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা)।
পরবর্তী সময়ে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ কমিশন নিবন্ধনের জন্য গণবিজ্ঞপ্তি জারি করলে ৪৩টি দল আবেদন করে। সে সময় বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ) ও সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটকে নিবন্ধন দেওয়া হয়। দল দুটি নিবন্ধনের ৩ নম্বর শর্ত পূরণ করেই নিবন্ধন পেয়েছিল। তবে এর মধ্যে বিএনএফের নিবন্ধন নিয়ে নানা সমালোচনা হয়েছিল। এর আগে উচ্চ আদালতের আদেশে নিবন্ধন পায় বাংলাদেশ মুসলিম লীগ-বিএমএল। দলটিকে ২০১৩ সালের জুন মাসে নিবন্ধন দেওয়া হয়।
এদিকে বিদায়ী কে এম নূরুল হুদার কমিশনের সময় ৭৬টি দল নিবন্ধনের আবেদন করলেও সবগুলোকে অযোগ্য ঘোষণা করে তাদের আবেদন নাকচ করে দেয় ইসি। এই দলগুলোর মধ্যে ৫টিকে উচ্চ আদালতের আদেশে নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে নিবন্ধন দিয়েছে। এর মধ্যে ববি হাজ্জাজের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনালিস্ট ডেমোক্রেটিক মুভমেন্টকে (এনডিএম) ২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি ইসি নিবন্ধন দেয়। আদালতের আদেশে একই বছর মে মাসে নিবন্ধন পায় বাংলাদেশ কংগ্রেস। এছাড়া চলতি বছরে মরহুম নাজমুল হুদার তৃণমূল বিএনপি, ইনসানিয়াত বিপ্লব বাংলাদেশ ও সর্বশেষ বাংলাদেশ কংগ্রেসকে নিবন্ধন দিয়েছে বর্তমান কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন। এ ৫টি দলের সবকয়টিই নূরুল হুদা কমিশনের যাচাই-বাছাইয়ে অযোগ্য প্রমাণিত হয়েছিল। আর সবগুলোই নিবন্ধন পেয়ে উচ্চ আদালতে রিটের প্রেক্ষিতে।
সর্বশেষ নিবন্ধন পাওয়া বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া বলেন, আমরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে সব শর্ত পূরণ করেও নিবন্ধন পাইনি। পরে বাধ্য হয়ে আদালতে যাই। আদালতের রায় বাস্তবায়নেও ইসি গড়িমসি করেছে। পরে অবমাননার মামলা দায়ের করলে তড়িঘড়ি করে আমাদের নিবন্ধন দিয়েছে। এক্ষেত্রে আমরা হাতি প্রতীক চাইলেও সেটা না নিয়ে তারা মোটর গাড়ি (কার) দিয়েছে।
তৃণমূল বিএনপির নিবন্ধন দেওয়ার সিদ্ধান্ত বিষয়ে কমিশনার মো. আলমগীর সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘আপিলেট ডিভিশন থেকে তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। আমাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে রেজিস্ট্রেশন দেওয়ার জন্য। যেহেতু সর্বোচ্চ আদালতের আদেশ, আমরা দিতে বাধ্য। এর বাইরে যাওয়ার কোনও সুযোগ নেই।’
এদিকে ২০১৮ সালে নিবন্ধন বঞ্চিত গণসংহতি আন্দোলনের নিবন্ধন নিয়ে আদালতে মামলা চলমান রয়েছে। দলটি ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে নিবন্ধন পেতে রিট পিটিশন করলে ২০১৯ সালে তাদের পক্ষে রায় দেয় হাইকোর্ট। বর্তমানে ওই রায়ের বিরুদ্ধে ইসির আপিল আবেদন শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, নির্বাচন কমিশন আমাদের নিবন্ধন না দেওয়ার প্রেক্ষাপটে আমরা ২০১৮ সালেই উচ্চ আদালতে রিট করি। হাইকোর্ট ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে আমাদের অনুকূলে নিবন্ধন সনদ দেওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশন টালবাহানা করলে আমরা বাধ্য হয়ে আদালত অবমাননার জন্য আবারও আদালতের দ্বারস্থ হই। পরে ইসি হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করে। বর্তমানে এটি আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় আছে। আমরা হাইকোর্টে ন্যায়বিচার পেয়েছি। আশা করি আপিল বিভাগেও পাবো।
বর্তমান নির্বাচন কমিশন নিবন্ধনের জন্য গণবিজ্ঞপ্তি জারি করলে ৯৩টি রাজনৈতিক দল আবেদন করে। এর প্রথম পর্যায়ে ১৪টির আবেদন বাতিল হয় এবং দুটি দল তাদের আবেদন প্রত্যাহার করে। বাকি ৭৭টি দলকে আরও কিছু কাগজপত্র দেওয়ার জন্য ১৫ দিন সময় দেওয়া হয়েছিল। সেগুলোর ভেতরে মোট ১২টি দলকে বাছাই করেছে নির্বাচন কমিশন। প্রাথমিক বাছাইয়ে টিকে থাকা দলগুলো হলো— এবি পার্টি (আমার বাংলাদেশ পার্টি), বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম), বাংলাদেশ হিউম্যানিস্ট পার্টি (বিএইচপি), গণ অধিকার পরিষদ, নাগরিক ঐক্য, বাংলাদেশ সনাতন পার্টি, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি (বিএসপি), বাংলাদেশ লেবার পার্টি, বাংলাদেশ মাইনরিটি জনতা পার্টি (বিএমজেপি), বাংলাদেশ পিপলস পার্টি (বিপিপি), ডেমোক্রেটিক পার্টি এবং বাংলাদেশ লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (বিএলডিপি)।
সূত্রে জানা গেছে, এই ১২ দলগুলোর বিষয়ে নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে এক দফা যাচাই-বাছাই সম্পন্ন করেছে। নতুন করে ইসি এসব দলের কয়েকটির বিষয় পুনঃযাচাই করছে। জুলাইয়ের ৩ তারিখের মধ্যে এ যাচাই প্রক্রিয়া শেষ হবে।
এদিকে ইসির যাচাই প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বেশ কয়েকটি দল। তারা ইসিতে এই বিষয়ে লিখিত আবেদন করে হয়রানির অভিযোগ তুলেছে। তাদের কেউ কেউ বলেছেন, নির্বাচন কমিশন যেসব তথ্য তালাশ করে তাতে কারও পক্ষেই শর্ত পূরণ করা সম্ভব নয়। উদাহরণ দিয়ে তারা বলেন, তাদের উপজেলা পর্যায়ের অফিসগুলোর বাড়ির মালিকদের নানা ধরনের অবাঞ্ছিত প্রশ্ন করছেন। যার কারণে তাদের বাড়ি ছাড়ারও নোটিশ দিচ্ছেন ওই সব মালিকরা। তাছাড়া তাদের কর্মী-সমর্থকদের বাড়ি বাড়ি গিয়েও ‘অপ্রয়োজনীয়’ খবর নিচ্ছেন।
বাংলাদেশ মাইনরিটি জনতা পার্টির (বিএমজেপি) সভাপতি সুকৃতি কুমার মণ্ডল বাংলা ট্রিবিউনের কাছে ইসির যাচাইয়ের নামে নানা হয়রানির অভিযোগ তোলেন। তিনি অভিযোগ করে বলেন, রাত সাড়ে ৯টার পর উপজেলা পর্যায়ের অফিসে গিয়ে তারা খোঁজ করেন অফিস খোলা কি না। তবে আমরা সব শর্ত পূরণ করেছি। যোগ্য দল হিসেবে আমরা নিবন্ধন পাবো বলে আশা করি। আর যদি নির্বাচন কমিশন আমাদের নিবন্ধন না দেয় তাহলে দরকার হলে উচ্চ আদালতে যাবো।
একই ধরনের মন্তব্য করেন আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি) সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু। তিনি বলেন, ইসি যতগুলো জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কমিটি সংক্রান্ত তথ্য চেয়েছে আমাদের তার থেকে অনেক বেশি রয়েছে। তবে তারা যেভাবে যাচাই-পুনঃযাচাই করছে এটা খুবই দুঃখজনক। তারা যেসব তথ্য এবং যেভাবে চায় তা কারো পক্ষেই পূর্ণ করা সম্ভব নয়। তবে আমরা তাদের সার্বিক সহায়তা করে যাচ্ছি। নির্বাচন কমিশন যদি আমাদের নিবন্ধন না দেয় তাহলে আমরা অবশ্যই উচ্চ আদালতে যাবো। এবং সেই প্রস্তুতি আমাদের রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, নতুন নিবন্ধন প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। আমরা কিছু ক্ষেত্রে পুনঃতদন্ত দিয়েছি। জুলাই মাসের ৩ তারিখ পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে। এরপর কমিশন বসে সিদ্ধান্ত নেবে। আশা করি শিগগিরই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানা যাবে।
নিবন্ধন অযোগ্যদের উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হওয়া প্রসঙ্গে ওই কর্মকর্তা বলেন, আইনের বাইরে নির্বাচন কমিশনের কিছু করণীয় নেই। আরপিও অনুযায়ী নিবন্ধনের শর্ত পূরণ হলেই নিবন্ধন দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে কেউ যোগ্য হলেও সেটা আইনানুগ হয় এবং অযোগ্য হলেও আইনের অধীনে হয়। ইসির সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট হয়ে যে কেউ উচ্চ আদালতে যেতে পারেন। এই অধিকার সকলেরই রয়েছে। আর আদালত থেকে কোনও সিদ্ধান্ত আসলে নির্বাচন কমিশনকে তা প্রতিপালন করতেই হবে।
নিবন্ধন পেতে দরকার তিন শর্ত
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী, কমিশনের তিনটি শর্তের মধ্যে একটি পূরণ হলে একটি দল নিবন্ধনের যোগ্য বিবেচিত হয়। নতুন কোনও দলকে নিবন্ধন পেতে হলে শেষ শর্তটিই পূরণ করতে হয়।
শর্তগুলো হলো— ১. দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যে কোনও জাতীয় নির্বাচনে আগ্রহী দলটির যদি অন্তত একজন সংসদ সদস্য থাকেন; ২. যে কোনও একটি নির্বাচনে দলের প্রার্থী অংশ নেওয়া আসনগুলোয় মোট প্রদত্ত ভোটের ৫ শতাংশ পায়। ৩. দলটির যদি একটি সক্রিয় কেন্দ্রীয় কার্যালয়, দেশের কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ (২১টি) প্রশাসনিক জেলায় কার্যকর কমিটি এবং অন্তত ১০০টি উপজেলা বা মেট্রোপলিটন থানায় কমপক্ষে ২০০ ভোটারের সমর্থন সম্বলিত দলিল থাকে।