ঢাকা, শুক্রবার ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১

নিরাপদ সড়ক আন্দোলন কতটা সফল?

নিজস্ব প্রতিবেদক: | প্রকাশের সময় : বৃহস্পতিবার ১৩ জুলাই ২০২৩ ১১:২৯:০০ পূর্বাহ্ন | জাতীয়

 

 

বাংলাদেশে নিরাপদ সড়কের আন্দোলন শুরু হয় নব্বইর দশকের প্রথম দিকে। এরপর পেরিয়ে গেছে তিন দশক (১৯৯৩-২০২৩)। গত ১০ বছরে নিরাপদ সড়কের আন্দোলন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেলেও কমানো যায়নি দুর্ঘটনা ও হতাহতের ঘটনা। বরং উল্টো লাফিয়ে লাফিয়ে এই সংখ্যা বেড়েছে। আন্দোলনের ফলে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি সংগঠন, সংশোধন হয়েছে সড়ক আইনটিও। এতে নাগরিক সচেতনতা বেড়েছে, কিছু পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে। তবে সড়কে শৃঙ্খলা এনে মৃত্যুর মিছিল থামানো যায়নি। হতাহতের হার কমাতে না পারলে সবকিছু ফিকে হয়ে যাবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, এ জন্য আরও অনেক কিছু করা এখনও বাকি রয়ে গেছে।

 

নিরাপদ সড়ক ও যাত্রীসেবা নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর নেতারা বলছেন, তাদের তৎপরতা বাড়ানো ও বিস্তৃত হওয়ায় নিরাপদ সড়কের দাবি জোরদার হয়েছে। ২২ অক্টোবর জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবসের ঘোষণা এসেছে। সড়কে, পরিবহনে শৃঙ্খলা আনতে সরকারের ওপর চাপও বেড়েছে। কিন্তু পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের বেশি লাভের মানসিকতা আর সরকারি সংস্থার অব্যবস্থাপনার কারণে পরিস্থিতির কাঙ্ক্ষিত উন্নতি হচ্ছে না। তাই এ থেকে উত্তরণে সংগঠনগুলো নানাভাবে চাপ বৃদ্ধির পাশাপাশি কর্মকাণ্ড আরও বিস্তৃত করার পরিকল্পনা করছে।

 

 

তবে তারা এও বলেছেন, বেসরকারি সংগঠনগুলো যতই চাপ তৈরি করুক, তৎপরতা যতই বিস্তৃত করুক আর জনসচেতনতা যতই বাড়ুক— সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর, সংস্থা ও পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা আন্তরিক না হলে এই খাতে শৃঙ্খলা ফিরবে না, মৃত্যুর মিছিলও থামবে না, পরিস্থিতির কাঙ্ক্ষিত উন্নতিও হবে না। সে কারণে কর্তৃপক্ষকে এসব সমস্যা স্বীকার করে তা সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। এর কোনও বিকল্প নেই।

 

 

নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সূচনা

 

১৯৯৩ সালের ২২ অক্টোবর চট্টগ্রামের পটিয়ায় এক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চন। এই দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে নিরাপদ সড়কের আন্দোলনে মাঠে নামেন ইলিয়াস কাঞ্চন। এর আগে ১৯৮৮ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ইলিয়াস কাঞ্চনও গুরুতর আহত হন, তার পা কেটে ফেলতে বলেছিলেন চিকিৎসক। জাহানারা কাঞ্চনের বাধার মুখে পরে সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয় নায়ককে। দীর্ঘ তিন মাস চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে দেশে ফিরে আবারও অভিনয়ে যুক্ত হন কাঞ্চন।

 

জীবনসঙ্গীর মৃত্যু নাড়িয়ে দেয় ইলিয়াস কাঞ্চনকে। তার উদ্যোগে ১৯৯৩ সালের ১ ডিসেম্বর বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন-বিএফডিসি থেকে জাতীয় প্রেস ক্লাব পর্যন্ত ‘নিরাপদ সড়ক চাই' নামে একটি পদযাত্রা হয়। প্রথম সেই পদযাত্রা থেকে এটিকে সাংগঠনিক রূপ দেওয়ার পরামর্শ দেন বিশিষ্টজনেরা। পথযাত্রা শেষে ২২ দফা সুনির্দিষ্ট দাবি উত্থাপন করেন ইলিয়াস কাঞ্চন।

নিরাপদ সড়ক আন্দোলন (১)

স্ত্রীর সঙ্গে চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন

 

পরবর্তীকালে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) নিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছুটে যান এই অভিনেতা, আয়োজন করতে থাকেন পথযাত্রার। সেগুলো থেকে ২২ দফা দাবিতে নিরাপদ সড়কের আন্দোলন প্রসার লাভ করে, তৈরি হতে থাকে জনমত। দেশের ভেতরে নিরাপদ সড়কের দাবি বা আন্দোলনকে জোরালো ভিতের ওপর দাঁড়াতে সাহায্য করে। এটি ইলিয়াস কাঞ্চনকে সামাজিক আন্দোলনের তারকা খ্যাতি এনে দিয়েছে আজ।

 

নিসচার পক্ষ থেকে প্রতিবছর ২২ অক্টোবর আন্তর্জাতিকভাবে নিরাপদ সড়ক দিবস পালনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ সংক্রান্ত প্রস্তাব উত্থাপন করা হলে ২০০৪ সালের ৭ এপ্রিল একটি সভার আয়োজন করে জাতিসংঘ। সড়ক দুর্ঘটনা ৫০ শতাংশে নামিয়ে আনতে ২০১০-২০ সালকে ‘সড়ক নিরাপত্তা দশক’ ঘোষণা করে সংস্থাটি। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ায় ২০৩০ পর্যন্ত বাড়ানো হয় সময়সীমা।

 

নিরাপদ সড়ক চাই’র মহাসচিব লিটন এরশাদ  বলেন, প্রথমে ইলিয়াস কাঞ্চনের সড়ক দুর্ঘটনা গুরুতর আহত হওয়া, পরে মর্মান্তিক আরেক দুর্ঘটনায় তার স্ত্রীর অপমৃত্যু। দুটো ঘটনাই ব্যক্তি ইলিয়াস কাঞ্চনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। বিশেষ করে স্ত্রীর মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি তিনি। ফলে 'নিরাপদ সড়ক চাই' পদযাত্রাটি ক্রমান্বয়ে রূপ নিলো একটি সার্থক ও সফল আন্দোলনে। পদযাত্রা থেকে যে ২২ দফা সুনির্দিষ্ট দাবির প্রস্তাব উত্থাপন করেন ইলিয়াস কাঞ্চন, তা দেশের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের মূল স্পিরিট হিসেবে কাজ করেছে।

 

গড়ে উঠেছে আরও সংগঠন

 

নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)-এর পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে একে একে আরও তিনটি সংগঠন গড়ে উঠেছে। এরমধ্যে ২০০৬ সালে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি, ২০০৭ সালে সেভ দ্য রোড এবং ২০১৭ সালে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব সংগঠন সড়কের পাশাপাশি রেল, নৌ ও আকাশ পথে দুর্ঘটনা নিয়েও কাজ করছে। বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে বর্তমান সময়ে সড়কে সবচেয়ে বেশি প্রাণঘাতী মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার চিত্র।

 

নিরাপদ সড়ক চাই ২০১২ সাল থেকে, যাত্রী কল্যাণ সমিতি ২০১৫ সাল থেকে, সেভ দ্য রোড ২০১৪ সাল থেকে এবং রোড সেফটি ২০১৯ সাল থেকে সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে। মাস ও বছরভিত্তিক প্রতিবেদনের পাশাপাশি বর্তমানে ঈদযাত্রার সময়েও আলাদা প্রতিবেদন প্রকাশ করছে সংগঠনগুলো। এসব প্রতিবেদনে কোন যানবাহনে কী পরিমাণ দুর্ঘটনা ঘটছে, কেন দুর্ঘটনা ঘটছে, কোন ধরনের মানুষ দুর্ঘটনার কবলে পড়ছে এসব-সহ দুর্ঘটনা কমাতে বেশ কিছু সুপারিশও তুলে ধরছে তারা।

 

 

নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে ইলিয়াস কাঞ্চন

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব সংগঠনের তৎপরতার কারণে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন যেমন বেগবান হয়েছে, তেমনি সড়ক দুর্ঘটনা নিয়েও সাধারণ মানুষের মাঝে সচেতনতা বেড়েছে। কিন্তু তারপরেও নিরাপদ করা যাচ্ছে না সড়ক-মহাসড়ক, কমছে না দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যাও।

 

নিরাপদ সড়কের আন্দোলনে সবশেষ যুক্ত হওয়া রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান লেন, এখন অনেক সংগঠন কাজ করায় কিছু তো অগ্রগতি হয়েছে। তবে সেটি সামগ্রিক বিবেচনায় আশাব্যঞ্জক না। আমরা জনগণকে সচেতন করার, প্রেসার গ্রুপ হিসেবে কাজ করার চেষ্টা করছি। আরও গঠনমূলক কাজ করতে হবে। জনমত গড়ে উঠলে নিরাপদ সড়কের আন্দোলন আরও বেগবান হবে। মানুষকে আরও সচেতন করতে হবে। পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের সচেতন হতে হবে। বিআরটিএকেও তাদের দায়িত্বটা সঠিকভাবে পালন করতে হবে।

 

বড় দুই অর্জন

 

নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন জোরদার হলে ২০১৭ সাল থেকে প্রতিবছর ২২ অক্টোবরকে ‘জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস’ হিসেবে পালনের ঘোষণা দেয় সরকার। ওই সময় জাতীয় সংসদ ভবনের ক্যাবিনেট কক্ষে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভা বৈঠকে প্রস্তাবটি অনুমোদনের পর তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেছিলেন, জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস পালনের জন্য ১১ জুলাই ও ২২ অক্টোবর প্রস্তাব করা হয়। যার মধ্যে ২২ অক্টোবরকে মন্ত্রিপরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।

 

কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি আরও বলেন, ২০১১ সালের ১১ জুলাই চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় ৪০ স্কুল ছাত্র নিহত হয়। আর ১৯৯৩ সালের ২২ অক্টোবর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান চলচ্চিত্র অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চনের স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চন। এরপর থেকে ইলিয়াস কাঞ্চন এদিনটিকে নিরাপদ সড়ক দিবস হিসেবে পালন করে আসছেন, যা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এজন্য ২২ অক্টোবরকে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এটি ‘খ’ শ্রেণির দিবস হিসেবে পালিত হবে।

 

বর্তমানে ২২ অক্টোবর জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস উপলক্ষে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান নানা কর্মসূচি গ্রহণ করছে। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী দিবসটির প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে পৃথক বাণী দিচ্ছেন। নিরাপদ সড়ক দিবস পালনে জনসাধারণকে সচেতন করার কর্মসূচি নিচ্ছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)।

 

বিআরটিএ’র কর্মসূচির মধ্যে থাকছে- নিরাপদ সড়ক দিবসে পত্রিকায় ক্রোড়পত্র প্রকাশ, শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা, সাজসজ্জা, গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও সড়কে নিরাপত্তা বিষয়ক পোস্টার, ব্যানার, স্টিকার প্রদর্শনসহ লিফলেট বিতরণ, রোড শো, বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ বেসরকারি টিভি চ্যানেলে দিবসের গুরুত্ব তুলে ধরে আলোচনার আয়োজন। এছাড়া নিরাপদ দিবসের প্রতিপাদ্য দিয়ে মোবাইল এসএমএসের মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়। কেন্দ্রীয়ভাবে কর্মসূচি পালন ছাড়াও জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে র‌্যালি ও আলোচনা সভার আয়োজন করা।

 

সড়ক পরিবহন আইন সংশোধন

 

২০১৮ সালে নিরাপদ সড়কের দাবিতে দেশব্যাপী আন্দোলন হয়। এরপরই বিদ্যমান আইন সংশোধন করে ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ করা হয়। ওই বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮-বিল’ সংসদে তোলা হয়। পরে ১৯ সেপ্টেম্বর তা সংসদে পাস হয়। রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের পর আইনটি ২০১৯ সালের ২২ অক্টোবর গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। সে বছরের ১ নভেম্বর থেকে এই আইন কার্যকর হওয়ার কথা জানানো হয়।

 

নিরাপদ সড়ক আন্দোলন

এই আইনে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হত্যাকাণ্ডের জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধানসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা রাখা হয়েছে। তবে এসব ধারার মধ্যে অধিকাংশের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেন পরিবহন শ্রমিক-মালিকরা। মূলত মালিক শ্রমিকদের আপত্তির কারণেই গেজেট প্রকাশে দেরি হয়। সংশোধিত এই আইন ফের সংশোধনের দাবি ওঠে বিভিন্ন সংগঠন ও সুশীল সমাজের পক্ষ থেকেও। এরমধ্যেই ২০১৯ সালে সড়ক পরিবহন আইন কার্যকরে মোবাইল কোর্ট আইনের তফসিলে সংশোধন আনা হয়।

 

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা

 

২০১৯ সালের ৬ আগস্ট মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে সড়ক পরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে প্রধানমন্ত্রী ছয়টি নির্দেশনা দিয়েছিলেন। নির্দেশনাগুলো হলো— ১. দূরপাল্লার গাড়িতে বিকল্প চালক রাখতে হবে। ২. একজন চালক দৈনিক পাঁচ ঘণ্টার বেশি গাড়ি চালাবেন না, সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। ৩. গাড়ির চালক ও তার সহকারীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। ৪. নির্দিষ্ট দূরত্বে সড়কের পাশে সার্ভিস সেন্টার বা বিশ্রামাগার তৈরি করতে হবে। ৫. অনিয়মতান্ত্রিকভাবে রাস্তা পারাপার বন্ধ করতে হবে বা সিগন্যাল মেনে পথচারী পারাপারে জেব্রা ক্রসিং ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। ৬. চালক ও যাত্রীদের সিটবেল্ট বাঁধা নিশ্চিত করতে হবে।

 

সঠিক প্রয়োগ নেই আইনের

 

এ বিষয়ে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী  বলেন, আগের আইনে সংশোধনী আনা হয়েছে সময়ের চাহিদা অনুযায়ী। কিন্তু বেশ কিছু কারণে এটি অসামঞ্জস্যতা দূর করতে পারেনি। একপেশে আইনে পরিণত হয়েছে। সে কারণে নতুন আইনের পরও সড়কে, পরিবহন খাতে বিশৃঙ্খলা রয়ে গেছে। খুব বেশি উন্নতি হয়নি পরিস্থিতির, প্রত্যাশার জায়গায় বড় ঘাটতি রয়ে গেছে। আইনটি মালিক ও শ্রমিকবান্ধব হয়েছে, যাত্রীবান্ধব হয়নি। পরিচালন পদ্ধতিতে ত্রুটি থাকায় শৃঙ্খলা আসছে না। পরিবহন মালিক-শ্রমিক নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনা করছে সরকারি কর্তৃপক্ষ। কিন্তু জনস্বার্থ, পরিবহনের শৃঙ্খলা আনতে কমিটিতে, এমনকি বৈঠকেও ডাকা হয় না সংগঠনগুলোর নেতৃত্বকে।

 

পদে পদে সীমাবদ্ধতা

 

সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের মাস ও বছরভিত্তিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে নিরাপদ সড়ক নিয়ে কাজ করা বেসরকারি চারটি সংগঠন। সংগঠনগুলোর দেওয়া পরিসংখ্যানে এক একরকম তথ্য মিলছে। বেসরকারি সংগঠনগুলো প্রধানত গণমাধ্যম থেকে দুর্ঘটনা ও হতাহতের তথ্য সংগ্রহ করায় তথ্য বিভ্রাট হচ্ছে। নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবীদের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রেও নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এছাড়া বিআরটিএ এতদিন সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের তথ্য প্রকাশ না করায় সমস্যায় পড়ছেন সংশ্লিষ্টরা।

 

 

নিরাপদ সড়ক আন্দোলন

সমালোচনার মুখে চলতি বছর মাসভিত্তিক এসব তথ্য সংস্থাটি প্রকাশ করলেও তার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে বলে অভিযোগ আছে। বিআরটিএ যে হিসাব দিচ্ছে, তার সঙ্গে বেসরকারি সংগঠনগুলোর দেওয়া তথ্যের বিস্তর ফারাক রয়েছে। এ নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে বাদানুবাদের ঘটনাও ঘটছে। ফলে সঠিক তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ থাকছেন বিভ্রান্তিতে।

 

এ বিষয়ে সেভ দ্য রোডের মহাসচিব শান্তা ফারজানা বলেন, দীর্ঘদিন ধরে সড়ক দুর্ঘটনার ওপর প্রতিবেদন করে আসছি আমরা। এই কাজটি করার কথা ছিল বিআরটিএ’র। তারা করছে না বলেই আমরা করছি কাজটি। এ ক্ষেত্রে আমাদের প্রধান সোর্স গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ হওয়ায় গণমাধ্যমের সংখ্যার কম-বেশি থাকায় একেক সংগঠনের তথ্য একেক রকম হচ্ছে। অনেক দুর্ঘটনা গণমাধ্যমে না আসায় ওই তথ্যগুলো আমাদের পক্ষে সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে না। বিআরটিএ চলতি বছর জানুয়ারি থেকে যে প্রতিবেদন দিয়ে আসছে তা বেসরকারি একটি সংগঠনেরও ধারে-কাছে নেই। তাদের প্রতিবেদনে দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা এতটাই কম দেখা যাচ্ছে, যার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে অনেকেরই প্রশ্ন রয়েছে।

 

বেড়েছে মৃত্যুর মিছিল

 

এক দশকে দেশের সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনা ও হতাহতের ঘটনা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। সরকারিভাবে এসব তথ্য কেন্দ্রীয়ভাবে না রাখায় সঠিক তথ্য মিলছে না। এই খাত নিয়ে কাজ করা কয়েকটি বেসরকারি সংগঠন প্রতিমাস ও বছরভিত্তিক সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে নিয়মিত। এই প্রতিবেদন পরিপূর্ণ না হলেও তাতে যে ভয়াবহ চিত্র উঠে আসছে, সেটি একই সঙ্গে চিন্তার ও উদ্বেগের বিষয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

 

নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)-এর হিসাবে ২০১৫ সালে ২ হাজার ৬২৬টি দুর্ঘটনায় নিহত হন ৫ হাজার ৩ জন, আহত ৬ হাজার ১৯৭ জন। ২০২২ সালে এসে ৭ হাজার ২৪টি দুর্ঘটনায় নিহত হন ৮ হাজার ১০৪ জন, আহত ৯ হাজার ৭৮৩ জন।

 

সেভ দ্য রোড বলছে, ২০১৫ সালে ১০ হাজার ২৬১টি দুর্ঘটনায় নিহত হন ৪ হাজার ৩০৩, আহত ১০ হাজার ১৭৮। আর ২০২২ সালে ৫২ হাজার ৪৮টি দুর্ঘটনায় নিহত হন ৯ হাজার ৪৩৪, আহত ৪৫ হাজার ৩৩৭।

 

যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, ২০১৫ সালে ৬ হাজার ৫৮১টি দুর্ঘটনায় নিহত হন ৮ হাজার ৬৪২ জন, আহত ২১ হাজার ৮৫৫ জন। কিন্তু ২০২২ সালে ৬ হাজার ৭৪৯টি দুর্ঘটনায় নিহত হন ৯ হাজার ৯৫১ জন, আহত ১২ হাজার ৩৫৬ জন।

 

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে ২০১৯ সালে ৪ হাজার ৬৯৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন ৫ হাজার ২১১ জন, আহত ৭ হাজার ১০৩ জন। যা ২০২২ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৮২৯টি সড়ক দুর্ঘটনায়। এসব দুর্ঘটনা নিহত হন ৭ হাজার ৭১৩ জন, আহত হন ১২ হাজার ৬১৫ জন।

 

এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ড. এম শামসুল হক বলেন, আমাদের পুরো সিস্টেমে সমস্যা আছে। সেফটির বিষয়টি, রাস্তার পাশের সাইন-সিগনালগুলো সঠিকভাবে হওয়া, যানবাহনের রক্ষণাবেক্ষণ করা, ব্যবহারযোগ্য রাখা ইত্যাদি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এ ক্ষেত্রে। হাইওয়ে পুলিশ ও মেট্রোপলিটন পুলিশ সেফটি রিলেটেড কাজটা ঠিকভাবে করছে না। উন্মুক্তভাবে ফিটনেসবিহীন গাড়ি চললেও তারা অনিয়মগুলো সেভাবে খেয়াল করছে না। লাইসেন্স দেওয়া, ছাড়পত্র দেওয়ার ক্ষেত্রে সেভাবে হচ্ছে না, গতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ফিটনেসবিহীন গাড়ি বন্ধ করতে হবে। নিরাপদ সড়কের আন্দোলনের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় আইন প্রয়োগ কাঠামোর জায়গাটাও শক্তিশালী করতে হবে বলে তিনি মনে করেন।