স্থানীয় নির্বাচন যেমন তেমন, জাতীয় নির্বাচন নিয়ে এ দেশে বিতর্কের অন্ত আগেও যেমন ছিলো না এখনও তেমনি নেই। পুরনো মদকে নতুন বোতলে ঢেলে যেমনি মোড়ক পাল্টানো হয় তেমনি নির্বাচনী বিতর্কও নতুন ঢঙ এ ঢোল করতাল বাজিয়ে নতুন কীর্ত্তনের অবয়ব ধারণ করে বৈ কি। এটি নতুন বা ব্যতিক্রমী কিছু নয়।
পাকিস্তানি জমানার গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন ছিল ১৯৭০ সনের সাধারণ নির্বাচন। শত ভাগ স্বচছতার এ নির্বাচনে জাতীয় পরিযদে আওয়ামী লীগের নিরঙকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের পর জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এনে বলেছিল- পুর্ববাংলায় ছাত্রলীগের নেতা কর্মীরা ব্যাপক জাল ভোটের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে জয়ী করেছে। তারপরেতো অন্য ইতিহাস।
বাংলাদেশী মুদ্দতে কোন নির্বাচনটি বিতর্কহীন ছিল? কোননা কোন কলংক তীলক কপালে লাগিয়ে সবকটিকে বিতর্কিত করা হয়েছে।যে পক্ষ জয়লাভ করে সেইপক্ষ নির্বাচনকে সুষ্টু বলে। যারা হারে তারা বলে কারচুপির নির্বাচন। এটিতো রেওয়াজে পরিণত হয়েছে।খোদ ভগবান যদি এই মুল্লুকে নেমে নির্বাচনের আয়োজনও পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহন করেন,তারপরও এখানে কারচুপির অভিযোগ আসবে। যারে দেখতে নারি তার চলনতো বাঁকা হবেই।
সদ্য অনুস্টিত ১২তম সংসদ নির্বাচনের আগায় ও পাছায় কলংকলেপন শুরু হয়েছে মাত্র। ডিজিটাল ডিভাইসের কারুকাজে দেখানো হচছে শিশুরা ভোট দিচ্ছে। কেন্দ্রের নাম দেওয়া হয়নি কৌশলে। মোদ্দা কথায় ভোটকে বিতর্কিত করার সবকটি পদ্ধতি অবলম্বন করা হবে। তাতে কোন ফল ধরবে তা ভবিতব্যই বলে দেবে। তবে এবারের নির্বাচন অতীতের নির্বাচনগুলোর সমান্তরালে পৃথক বৈশিষ্ট্য এবং সুষমায় মন্ডিত বলেই প্রতীয়মান। যারা সুস্থ বিবেক সম্পন্ন তারা এ সত্যটিকে অস্বীকারের কোন পথ নেই। সরকার দলীয় মন্ত্রীসভার তিন রানিং প্রতিমন্ত্রী যথাক্রমে মাহবুব আলী, এনামুর রহমান এবং সুপন ভট্টাচার্য্য নির্বাচনে ধরাশায়ী হয়েছেন। অতীতের দুই ডাকসাইটে মন্ত্রী যথাক্রমে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এবং হাসানুল হক ইনুরও একই দশা ধরেছে। অন্যদিকে হেভীওয়েট বলে খ্যাত রানিং ১৯ এমপিরও পরাজয় ঘটেছে। আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারী বোর্ডের ভুল মনোনয়নকে আমলে নেয়নি সচেতন ভোটার মহল। অতীতের নির্বাচন সমূহে এমন ঊদাহরণ বা নজির আছে কি না সেটি পর্য্যালোচনা বা অনুসন্ধানের বিষয়।
নানামুখী বৈপরীত্য এবং প্রতিকূলতার মধ্যে এ নির্বাচন যে অনুস্টিত হয়েছে তাতো মানতেই হবে। নির্বাচনকে বিতর্কিত এবং ভন্ডুল করে দেওয়ার জন্য বিরোধী পক্ষ যত পথে হাটার ততপথেই হেটেছে। এ সত্যটুকু দিবালোকের মতো স্পস্ট। তার পরও জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক কড়া নজরদারিতে অনুস্টিত এ নির্বাচনী আয়োজন সফল নাকি ব্যর্থ হয়েছে সে মূল্যায়ন অবশ্যই বেরিয়ে আসবে।
সদ্য অনুস্টিত সংসদ নির্বাচনের দুর্বলতার একটিমাত্র দিক হচছে তূলনামূলক ভোটার অনুপস্তিতি। তার নানাবিধ কারণও বিদ্যমান।নির্বাচন বর্জনকারী দলসমূহ ভোটারদেরকে নির্বাচন বর্জন করার পক্ষে যতটুকু প্রচারণা করার ততটুকু করেছে। তাতে ভোটার মহলে প্রতিক্রিয়াতো ছিলোই। কিন্তু এ প্রতিক্রিয়া সুস্থ ভোটের জন্য তেমন অন্তরায় ছিলোনা। কিন্তু নির্বাচনের আগে বিভিন্ন স্থানে ভোট কেন্দ্রে আগুন দেয়া ,ককটেল ফোটানো এবং হুমকি প্রদর্শনের কারণে এক শ্রেণীর ভোটারদের মনে ভীতি ছড়িয়ে পড়েছিল। যারফলে ভোটকেন্দ্রে মহিলা ভোটাটদের উপস্থিতি ছিল কম। আরেকটি কারণ হচ্ছে দুর্বল এবং অখ্যাত প্রতিদ্ধন্দি। আওয়ামী লীগের শতাধিক ডাকসাইটে প্রার্থীর বিপরীতে নাম সর্বস্ব দলের অখ্যাত কেনডিডেট থাকায় নির্বাচনী আমেজ তেমন ছিলোনা। ভোটাররা মনে করেছে -এখানেতো এমনিতেই পাশ। তাই ভোট দিতে আসেনি অনেক ভোটার। কিন্তু যেখানে হাডডা হাডডি লড়াই হয়েছে সেখানতো ভোটারের কমতি ছিলো না। এই বাস্তবতাকে মানতে হবে।
অতীত ভোট সমূহের চিত্র এখানে টেনে আনার ইচ্ছা এখানে তিরোহিত। তবু কিঞ্চিত উদাহরণ টানতে হয় প্রসংগের কারণে।। ১৯৭৯ সনের সংসদ নির্বাচনে ন্যাপ প্রধান অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ কুমিল্লার একটি আসনে এবং চৈনিক বামের কমরেড তোয়াহা নোয়াখালিরএকটি আসনে বি এন পি প্রার্থীদের নিকট বিব্রতকর অবস্থানে ছিলেন। সুতোর টানে তখন নির্বাচন কমিশন এই দুই আসনের ফলাফল দুইদিন স্থগিত রেখে দুজনকে নির্বাচিত ঘোষণা করেছিল তথকালীন রাজনৈতিক হিসাব নিকাশের আলোকে। ২০০১ সনের নির্বাচনে সুনামগঞ্জের একটি আসনে সামাদ আজাদ সাহেব ইসলামী ঐক্যজোটের শাহীনূর পাশার জালে আটকা পড়েছিলেন। নির্বাচনের আগেই তখন বিএনপি ক্ষমতার পাশেই ছিলো। তখন সিলেট অঞ্চলের বিএনপির প্রভাবশালী এক নেতা নানান হিসাব নিকাশের আলোকে সামাদ আজাদকে উদ্ধার করেছিলেন। এমন উদ্ধারের নজিরতো এ নির্বাচনে নেই। থাকলে তৃণমূল বি এন পির শমশের মোবিন চৌধিরী, তৈমুর আলম খন্দকার, বি এন এফ এর শাহ আবু জাফর কিংবা বাঘা সিদ্দিকী বোধ হয় ধরাশায়ী হতেন না। অতএব বুঝহে সুজন যার আছে বোধি।
এবারের নির্বাচনের আরেকটি ব্যতিক্রমও লক্ষ্যণীয়। অটো কিংবা আনকনটেস্ট এমপিদের বালাই নেই। যেমন করেই হোক প্রতিদ্ধন্দিতা করে প্রত্যেক এমপিকে নির্বাচিত হতে হয়েছে।
অন্যদিকে পরের ধনে পোদ্দারীর অবকাশও বোধ হয় রহিত হয়েছে। গিফটের ২৬ টি আসনের মধ্যে জাপার ১৫টি আসন হাতছাড়া হয়েছে। তাতে দলীয় সাংগঠনিক অবক্ষয় এবং জনসমর্থন হীনতার ঘাটতিরই ইংগিত ফুটে উঠছে। এই দুর্বলতাকে কথিত কারচুপির অভিযোগ দিয়ে ঢাকা যাবেনা। যেই হালে বিকাশ সেই হালে নিকাশের ঘন্টা বেজে উঠছে। সমগোত্রীয়দের বেলায় একই সূত্র প্রযোজ্য হচ্ছে।