বাসার পাশের রাস্তায় নাতির হাত ধরে বৈকালিক হাঁটাহাটি করছিলেন হক সাহেব। হঠাৎ লক্ষ করলেন বাসার গেটে তিনজন অতিথি গার্ডের সাথে কথা বলছেন। হাঁটার গতি বাড়িয়ে কাছে যেতেই বুঝলেন তাঁর ক্লাসমেট দুই বন্ধু এবং এক বন্ধুর ছোট বোন সুরভী। সুরভীই মুলতঃ এ গল্পের মূল চরিত্র।
কুশল বিনিময়ের মাঝেই গার্ড গেইট খুলে দিয়েছে। লন পেরিয়ে বসার ঘরে প্রবেশের মুখে কিশোরী নাতনির মুখদর্শন ঘটলো।
- আপু তোমার দাদির নামাজ শেষ হয়েছে?
- জ্বি ভাইয়া
- দাদিকে বলো আমাদের গ্রামের মেহমান এসেছে।
নাতনি সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে হাঁক ছাড়লো - দাদু আপু মেহমান এসেছে, নীচে এসো।
মিনিট দশেকের মধ্যে হাতে চানাচুর যোগে মুড়ি মাখার বোউল নিয়ে নেমে এসে সেন্টার টেবিলে রেখে মেহমানদের সাথে কুশলাদি বিনিময় শেষে মুড়ি মাখা খেতে খেতে গল্প করার আহবান জানিয়ে গৃহকর্ত্রী বললেন,
- আমি কিচেনে যাচ্ছি আপনাদের জন্য একটু চা নাস্তার ব্যবস্থা করি।
রান্না সহকারী বাটি চামিচ বোউলের পাশে রেখে গৃহকর্ত্রীকে অনুসরণ করলো।
নিরবতা ভাঙ্গলো বন্ধু কামাল।
- দোস্ত ঢাকা শহরের এই এলাকায় এতো বড় জায়গায় বাড়ি করেছিস! বাউন্ডারি ওয়ালের ভিতরে পুকুর, ফুল-ফলের এতো গাছ, টেনিস কোট! খুব ভালো লাগলোরে দেখে। ভাইয়ের কথার সমান্তরালে সুরভিকে কেমন যেন ভারাক্রান্ত দেখতে লাগছিলো।
লাভলু বললো, এতো বড় জায়গায় মাত্র একটা ডুপ্লেক্স বাড়ি! অনায়াসে দুইটা টাওয়ার বানানো যেতো।
লাভলুর কথার মাঝে ফিরে এসেছেন গৃহকর্ত্রী। লাভলুর কথার রেস ধরে বললেন, দেখেন ভাই, আপনার বন্ধুর ব্যবসা যথেষ্টই ভালো। ছেলে জয়েন করার পর ব্যবসার পরিধি অনেক বাড়িয়ে দিয়েছেন। ঢাকা মেডিকেল-এর বিভাগীয় প্রধান হিসাবে আমার আয়রোজগারও কম নয়। তাছাড়া বউমা সিএমএইস-এর ডাক্তার এবং আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল কলেজের এসোসিয়েট প্রফেসর। আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ যথেষ্ট দিয়েছেন আমাদের। তাই বাড়ি ভাড়া দিয়ে আয় করার চেয়ে সাচ্ছন্দ্যে বসবাস করাটাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছি আমরা।
কামাল কিছুটা সংকোচ নিয়ে কি যেন একটা বলবে বলবে করেও শুরু করতে দ্বিধা করছে দেখে আনিস হক বললেন, দেখ্ কামাল সংকোচ করার কি আছে? কি বলতে চাস্ নিঃসংকোচে বলে ফেল্।
- দেখ্ দোস্ত, সুরভী খুবই অসুস্থ। আনকন্ট্রোলড ডায়াবেটিস থেকে ধীরে ধীরে কিডনি অকেজো হয়ে পড়েছে। একদিন পর পর ডায়ালাইসিস করতে হয়। তোর তো নিশ্চয়ই চিকিৎসার খরচাপাতি সম্পর্কে ধারণা আছে। আমি কিছুটা হেল্প করার চেষ্টা করি, আমার তো সীমিত আয়। কতটুকুইবা করতে পারি। কয়েক বছরে ওদের সঞ্চয়ের সবটুকুই প্রায় শেষ। ওর হাসবেন্ডের আহামরি আয় রোজগার নাই। ছেলেটা সবে মাস্টার্স কমপ্লিট করলো। ডাঃ রেজাউল ভাই বললেন তুই চিকিৎসার জন্য অনেককেই সাহায্য করিস। সেজন্যই তোর কাছে আসা। ঠিকানা রেজাউল ভাইই দিয়েছেন।
কামালকে থামিয়ে আনিস হক জানতে চাইলেন - সুরভী, তুমি তো ডাক্তার, তা কোথায় আছো এখন?
এবার আর অশ্রু ধারা আটকে রাখতে পারলো না সুরভী। কাঁপা গলায় বললো, তুমি তো থার্ড ইয়ার পর্যন্ত জানো। তারপর আর এগোতে পারিনি।
- কেন?
- ব্যারিস্টার খালাতো ভাইয়ের সাথে বিয়ের খবর নিশ্চয়ই জেনেছিলে। আসলে ওটা বিয়ে ছিল না, ছিলো প্রতারণা। আব্বার কাছ থেকে টাকা আদায় করার ফন্দি। আমাকে লন্ডন বেড়াতে নিয়ে জিম্মি করে ফেলেছিলো। দুই বছর পর পাশের বাড়ির বাংলাদেশী একটি পরিবারের সাহায্যে প্রাণটা নিয়ে পালিয়ে দেশে এসেছিলাম।
আনিসের মনের লকারে তালাবদ্ধ সেলুলয়েড রীলটি স্বয়ংক্রিয় ভাবে অবমুক্ত হয়ে চলতে শুরু করে দিলো।
আনিস তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স থার্ড ইয়ারে। ডাকসুর সমাজসেবা সম্পাদক এবং জাতীয় বিতর্ক প্রতিযোগিতায় বিশ্ববিদ্যালয় দলের দলপতি। এ ছাড়াও দেশের সবচেয়ে বড় ছাত্র সংগঠনের জাতীয় কমিটির একজন সম্পাদক।
একদিন ডাকসু অফিস থেকে বেরোতেই কানে ভেসে এলো, আনিস ভাইয়া... । পাশ ফিরে দেখতে পেলো এলাকার সেরা সুন্দরী বন্ধু ভগ্নী সুরভী দাঁড়িয়ে।
- কি ব্যাপার? তুমি এখানে?!
- তোমার কাছেই এসেছি।
- ঢাকা এসেছো কবে? উঠেছো কোথায়?
- গতকাল এসেছি, শিউলি আপার বাসায় উঠেছি।
- কিন্তু আমার কাছে এসেছো কেন?
- এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই বলবো?
- না, চলো মধুর কেন্টনে বসি।
কেন্টনে ঢুকতেই কোণার একটা টেবিল খালি করে তাদের প্রিয় আনিস ভাইকে মেহমান নিয়ে বসার আহবান জানালো তিনজন জুনিয়র ছাত্র-ছাত্রী। বসতে বসতে সুরভী বললো, ও মাই গড, তুমি দেখি বিরাট ভিআইপি হয়ে গেছো।
- টিটকারি মারছো?
- আরে নাহ্, যা দেখলাম তা থেকেই বললাম।
- যাকগে, তোমার কাজের কথা বলো। তার আগে বলো, কি খাবে?
- তোমার যা ইচ্ছা খাওয়াতে পারো, তবে আমি কিন্তু বাসা থেকে ভাত খেয়ে বেরিয়েছি। এবার তোমার প্রশ্নের উত্তর দেই। তুমি হয়তো জানো যে আমার খুব ইচ্ছা ঢাকা মেডিকেলে পড়ার, কিন্তু এসএসসি আর এইচএসসি প্রাপ্ত নম্বরে মনে হয় চান্স পাবো না। বড় ভাইয়া এবং আরও কয়েকজন বলেছে তুমি হেল্প করতে পারবে।
- আরে, আমি কি ঢাকা মেডিকেলের কেউ?
- নাহ্, তবুও অনেকেই বলেছে, তুমি ডাকসুর নির্বাচিত সম্পাদক এবং আরও অনেক কিছু। বাকিটা নির্ভর করছে তুমি আমাকে হেল্প করতে চাও কিনা।
- শেষ বাক্যটায় আনিসের ব্যক্তিত্বে সামান্য হলেও আঘাত করলো।
- ঠিক আছে, দেখছি কি করা যায়।
এমন সময় কেন্টিনে ঢুকেই হাক ছাড়লেন শিশির আপা, দলের সিনিয়র নেতা - কিরে আনিস, তুই দেখছি ডুমুরেরফুল হয়ে যাচ্ছিস্!
- দেখো আপা, সামনে আমার অনার্স ফাইনাল এবং বিসিএস রিটেনের প্রস্তুতি। লেখাপড়া না করলে কি পাড় পাবো?
- ঠিক বলেছিস, সেরা ছাত্র সংগঠনের নেতাদের রেজাল্টও সেরা হতে হবে। তা এই মেয়েটি কে?
- আপা, ও ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি-ইচ্ছুক, আমার এক বন্ধুর ছোট বোন, একই গ্রামে বাড়ি আমাদের। ওর প্রাপ্ত নম্বর নিয়ে শঙ্কিত যে ভর্তি হতে পারবে না হয়তোবা। তুমি যদি মেডিকেলের ভিপি সাজিদকে একটু বলে দিতে।
- ওকে তুই বললেই তো যথেষ্ট। আমার বলা লাগবে?
- আমি বললে আপ্রাণ চেষ্টা হয়তো করবে কিন্তু তুমি বললে কাজটা যেভাবেই হোক করেই ছাড়বে।
- ঠিক আছে আগামীকালের মিটিংয়ে আয়, সামনাসামনি বলে দিবো।
যেভাবেই হোক সুরভী ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হবার সুযোগ পেলো। রেজাল্টের দুই দিন পর এসে বললো, আমার সাথে চলো ভর্তির সময় তুমি আমার সাথে থাকবে। ভর্তি সম্পন্ন হলো, হোস্টেলে সিট বরাদ্দ পেলো।
আনিস বললো, এবার আমার ছুটি। মানুষের সেবার ব্রত নিয়ে ভালোভাবে লেখাপড়া করে বড় ডাক্তার হও। রোগী হয়ে যাবো তোমার কাছে।
মুচকি হেসে সুরভী বললো, তোমার ছুটির সুযোগ একদমই নাই। এই কয়েকদিনে সে সুযোগ তুমি হারিয়ে ফেলেছো। প্রতি সপ্তাহে ছুটির দিনে তুমি আমাকে ঢাকা শহর দেখাবে, ফুচকা, চটপটি, আইসক্রিম খাওয়াবে, সিনেমা দেখাবে, বেইলি রোডে নাটক দেখাবে। এটা তোমার পারমানেন্ট চাকরী। নো ছুটি বুঝলে?
- মানে!?
- কোন মানে নাই।
সুরভী'র দেয়া চাকরিটা মন্দ লাগলো না আনিসের যদি অতো বাড়তি সময় নেই ওর হাতে। তবুও কেমন করে যেন একটা ঘোরের মধ্যেই কেটে গেল প্রায় তিনটি বছর।
ততোদিনে আনিসের অনার্স এবং বিসিএস খুবই ভালো ফলাফল সহ কমপ্লিট হয়ে গেছে। প্রায় এক যুগ পর ডিপার্টমেন্টে অনার্সে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। বিসিএস-এ মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্হান। মাষ্টার্স ফাইনাল দিয়ে রেজাল্টের অপেক্ষায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা তার প্রথম পছন্দ। নাহলে বিসিএসটা কাজে লাগাবে।
যথারীতি এক সাপ্তাহিক ছুটির দিনে সুরভীর হোস্টেলে গিয়ে ভীষণ রকম এক ধাক্কা খেলো। জানতে পারলো যে সুরভী গত পরশু বাবার সাথে বাড়িতে গেছে। ছোট একটা প্রশ্ন অনেক বড় আঘাত করলো মনে। আমাকে না জানিয়েই চলে গেল?
তিনদিন পর সুরভীর একটা চিঠি পেল হাতে।
"আব্বা হঠাৎ আমাকে বাড়িতে নিয়ে এসেছে। এসে শুনি সদ্য বিলাত ফেরত ব্যারিস্টার খালাতো ভাই-এর বাগদত্তা আমি। এখনই বিয়ে হবে। কোন বিকল্প নাই!"
চিঠির প্যাডের উপর অশ্রুপাতে চিহ্ন স্পষ্ট।
গৃহকর্ত্রীর কন্ঠ কানে আসতেই সম্বিত ফিরে পেলো আনিস।
- নাস্তা দিয়েছি টেবিলে, ওনাদের নিয়ে চলে এসো।
আনিসের দুই বন্ধু খুব মজা করে কাবাব-নান খেতে থাকলেও সুরভীর গলা দিয়ে নামছিল না তার অতি পছন্দের খাবার। গৃহকর্ত্রী সুরভীর উদ্দেশ্যে বললেন, কি ব্যাপার আপনি তো খাচ্ছেনই না!
- ভাবী, আমার যখন খারাপ লাগে তখন খেতে ইচ্ছা করে না। আর আমাকে তুমি করে ডাকলে খুশি হবো।
- খারাপ লাগে কেন? ব্লাড প্রেসার কি খুব উঠানামা করে?
- হুম।
- কোন ডাক্তার দেখান?
- সোহরাওয়ার্দীতে ডায়ালাইসিস এবং অন্যান্য চিকিৎসা করাই, যে ডাক্তার ডিউটিতে থাকে তিনি দেখেন।
- ওহ্...
এরপর (আনিসেরর উদ্দেশ্যে) একটা কাজ করো তো, জনবান্ধব নগর হসপিটালে তোমার একাউন্ট অটো ডেবিট ইনস্ট্রাকশন দিয়ে ওর ডায়ালাইসিস-এর ব্যবস্থা করে দাও। আর আমি জেনারেল ফারুক ভাইকে বলে ওর ফলোআপ এনসিউরড করে দিবো। আমার ধারণা একদিন পরপর নয়, দুইদিন পরপর ডায়ালাইসিস করলেই যথেষ্ট হবে।
- ভাবী, কি যে উপকার করলেন আমার। আপনাদের এ ঋণ কোনদিন শোধ করতে পারবো না। কৃতজ্ঞতা জানালো লাভলু।
- আরে ভাই উনি আমাদের এলাকার মানুষ, তার উপর সাহেবের বন্ধুর বোন। এটা আমাদের সামাজিক দ্বায়িত্ব। তা ভাই আপনার পরিচয় তো ঠিক বুঝতে পারছি না।
তড়িৎ উত্তর দিলো কামাল, ও আমাদের বন্ধু এবং সুরভীর হাসব্যান্ড।
- মানে? হতচকিত প্রশ্ন আনিসের।
- আসলে খালাতো ভাইয়ের সাথে বিয়েটা টিকে নি। বেশ কয়েক বছর পর লাভলু ওর বাবা-মা সহ বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে। সুরভী বিয়েতেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলো। অনেক বুঝিয়ে রাজি করিয়েছি ওকে।
আনিস উঠে দিয়ে একটি ফরম সাইন করে লাভলুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, উপরের অংশটি ফিলাপ করে সকাল নয়টার মধ্যে হসপিটালের কাউন্টারে দেখালেই তোদেরকে ম্যানেজারের রুমে নিয়ে যাবে। সব কিছু ঠিকঠাক করে একটি কার্ড দিবে এবং সিডিউলও দিয়ে দিবে। লাভলু বলতো কোন সময়টা সুবিধাজনক হবে তোদের জন্য, আমি সেভাবে এখনই ম্যানেজারকে বলে দিব।
- দোস্ত, হসপিটালটা আমাদের বাসার কাছেই। অফিস টাইমের পর হলে ভালো হয়।
- ঠিক আছে, সন্ধ্যা ৭টা-১০টার স্লটটা দিতে বলি।
- কামাল আর লাভলু উঠতে উঠতে কৃতজ্ঞচিত্তে বললো, তোকে ধন্যবাদ জানানোর ভাষা নাইরে। ভালো থাকিস।
- ধন্যবাদ জানানোর মতো কিছুই করিনি। যা করছি দ্বায়িত্ববোধ থেকে করছি। হসপিটালে কোন সমস্যা হলে ফোন করিস। দরকার না হলেও কাজ শেষ হওয়ার পর ফোন জানিয়ে জানিয়ে দিস আমাকে।
চোখ মুছতে মুছতে সুরভী কি যেন বলতে চাচ্ছিলো কিন্তু বুকফাঁটা কান্নার চাপে মিলিয়ে যাচ্ছিলো বারবার। আমাদের কিশোরী নাতনি ততক্ষণে সুরভীকে জড়িয়ে ধরে বলছে, এই আপু তুমি বাচ্চাদের মতো কাদছো কেন? দেখো, ফারুক দাদুর ওষুধ খেয়ে তুমি সুস্থ হয়ে যাবে।
একে