বাণিজ্যিকভাবে চাষের পয়লা বছরেই লটকন'র বাম্পার ফলন হয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সীমান্তঘেঁষা উপজেলা বিজয়নগরে। গত দুই বছর ধরে এখানে লটকন চাষ হলেও এবারই প্রথম বাণিজ্যিকভাবে লটকন চাষ করা হয়েছে। এখানকার উৎপাদিত তিন ধরণের লটকন ইতোমধ্যে বাজারে বিক্রিও শুরু হয়েছে। প্রতিকেজি লটকন আশি-দেড়শ' টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। চলতি বছর বিজয়নগর উপজেলায় প্রায় ৮০ লাখ টাকার লটকন বিক্রির সম্ভাবনা নিশ্চিত করেছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ। এদিকে ফলন ভালো হওয়ায় লটকন চাষ নিয়ে স্থানীয় চাষীদের মধ্যেও বেড়েছে তুমুল আগ্রহ।
এক সময়ের নেহায়েত বুনো ফল লটকন এখন হয়ে ওঠেছে ব্যাপক জনপ্রিয়। গোলাকৃতির এই ফলটি পাকলে হলুদ বর্ণ ধারণ করে। উপরকার খোসা ছাড়ালেই মিলে রসালো অম্লমধুর স্বাদের ৩/৪ টি বীজ। অত্যন্ত পুষ্টিকর এবং ঔষধিগুণে ভরপুর এই ফলে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন সি থাকার পাশাপাশি রয়েছে খনিজ উপাদানও। লটকন ফলে বিদ্যমান উপাদান ত্বক, দাঁত ও হাড় সুস্থ রাখে। লটকন খেলে বিভিন্ন রোগ থেকে নিস্তারের পাশাপাশি এটি মানব দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়ায়। বর্তমানে দেশের নির্দিষ্ট কিছু জেলায় এই লটকন চাষ হচ্ছে। তন্মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলায় এবছরই প্রথমবারের মতো বাণিজ্যিকভাবে শুরু হয়েছে লটকন চাষ। গোটা উপজেলায় লটকন চাষ হয়েছে অন্তত ১৫ হেক্টর জমিতে। পাহাড়ি লাল মাটি অধ্যুষিত বিজয়নগরের লটকন বেশ রসালো, টক ও মিষ্টিতে ভরপুর হওয়ায় সমগ্র দেশব্যাপী রয়েছে এর ব্যাপক চাহিদা।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা এবং বিজয়নগর উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, ভারতীয় সীমান্তঘেঁষা উপজেলা বিজয়নগরের টিলা ভূমির লাল মাটি লটকন চাষের জন্য খুবই উপযোগী। গেল দুই বছর ধরে বিজয়নগরে লটকন চাষ হলেও এবারই প্রথম বাণিজ্যিকভাবে শুরু হয় লটকন চাষ। উপজেলার চম্পকনগর, সিঙ্গারবিল, বিষ্ণুপুর এবং পাহাড়পুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামেই রয়েছে লটকনের বাগান। চলতি বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকা এবং কোনো ধরণের রোগ বালাই না হওয়ায় লটকনের ফলনও হয়েছে বাম্পার। উপজেলার চারটি ইউনিয়ন এলাকার প্রায় ১৫ হেক্টর জমিতে লটকন চাষ করা হয়েছে। গত ঈদ-উল আজহার পর থেকে বাজারে লকটন বিক্রি করাও শুরু হয়েছে। কৃষি সংশ্লিষ্টরা জানায়, চলতি বছর বেলার বিজয়নগর উপজেলা থেকে অন্তত ৮০ লাখ টাকার লটকন বিক্রির সম্ভাবনা রয়েছে। ফলন ভালো হওয়ায় লটকনের চাষ নিয়ে চাষীদের মধ্যেও বাড়ছে ব্যাপক আগ্রহ। স্থানীয় চাষীরা জানান, বিজয়নগর উপজেলা এলাকায় উৎপাদিত লটকন রসালো, টক ও মিষ্টিতে ভরপুর হওয়ায় বাজারে রয়েছে এর ব্যাপক চাহিদা। প্রতিদিন সকালে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে পাইকাররা বিজয়নগর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের বাগানে এসে লটকন কিনে নিয়ে যাচ্ছেন চাষীদের কাছ থেকে। তাছাড়া স্থানীয় বাজারে এবং জেলা সদরে তিন ধরণের লটকন বিক্রি হচ্ছে। ছোট সাইজের প্রতিকেজি লটকন খুচরা ৮০ টাকা দরে, মাঝারি সাইজের প্রতিকেজি লটকন ১২০ টাকা এবং বড় সাইজের লটকন প্রতি কেজি দেড়শ' টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
উপজেলার সিঙ্গারবিল ইউনিয়নের মেরাশানী গ্রামের একজন সফল লটকন চাষী বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন। তিনি জানান, 'গত ৭/৮ বছর আগে আমি ময়মনসিংহ জেলা থেকে ১০০টি লটকনের চারা এনে একটি বাগান করি। প্রথমে যখন লটকনের বাগান করি, তখন এলাকার অনেকে এই নিয়ে হাসি-ঠাট্টাও করতো। গত দুই বছর ধরে কিছু কিছু গাছে লটকন ধরা শুরু হলেও এই বছর আমার বাগানের সব গাছেই লটকন ধরেছে। এবার লক্ষাধিক টাকার লটকন বিক্রি করতে পারবো বলে আশা করছি। কৃষি অফিসের লোকজন সবসময় আমাকে পরামর্শ দিচ্ছেন। তবে সরকারিভাবে সহযোগিতা পেলে আমি বাণিজ্যিকভাবে লটকনের চাষ করবো।' উপজেলার পাহাড়পুর ইউনিয়নের পাহাড়পুর গ্রামের আরেক লটকন চাষী বাবুল মিয়া বলেন, 'এবছর আমাদের এলাকায় লটকনের বাম্পার ফলন হয়েছে। প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে পাইকাররা এসে বাগান থেকেই লটকন কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। আমার বাগান থেকে অন্তত দুই লাখ টাকার লটকন বিক্রি করতে পারবো বলে আশা করছি।'
বিজয়নগর উপজেলা কৃষি অফিসার মো. শাব্বির আহমেদ বলেন, 'বিজয়নগরের মাটি লটকন চাষের জন্য খুবই উপযোগী। এই বছরই প্রথম বিজয়নগর উপজেলায় বাণিজ্যিকভাবে লকটন চাষ শুরু করা হয়েছে। উপজেলার ২০/২৫ জন চাষী তাদের ১৫ হেক্টর জমিতে লটকনের বাগান করেছেন।উপজেলা কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে বাগান মালিকদের সব ধরণের পরামর্শ এবং সহযোগিতা দেয়া হচ্ছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এ বছর উপজেলায় লটকনের বাম্পার ফলন হয়েছে। আশা করি, চলতি বছর উপজেলার চাষীরা প্রায় ৮০ লাখ টাকার লটকন বিক্রি করতে পারবেন।' বিজয়নগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এ.এইচ. ইরফান উদ্দিন আহমেদ বলেন, 'সরকারিভাবে লটকন চাষীদের সারসহ বিভিন্ন কৃষি উপকরণ দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া চাষীদেরকে বিভিন্ন ধরণের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে গড়ে তোলা হচ্ছে।'
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ব্রাহ্মণবাড়িয়া কার্যালয়ের জেলা প্রশিক্ষণ অফিসার মুন্সী তোফায়েল হোসেন বলেন, 'চলতি বছর জেলার বিজয়নগর উপজেলায় ১৫ হেক্টর জমিতে লটকন চাষ হয়েছে। তাছাড়া বাণিজ্যিকভাবে বিজয়নগর উপজেলায় লটকন চাষ এবারই প্রথম। আর প্রথম বছরেই ফলনও হয়েছে বাম্পার। ইতোমধ্যেই লকটন বিক্রি শুরু হয়েছে। আশা করছি, চলতি বছর বিজয়নগরে প্রায় ৮০ লাখ টাকার লটকন বিক্রি করা হবে। ফলন ভালো হওয়ায় লটকনের চাষ নিয়ে চাষীদের মধ্যেও আগ্রহ বাড়ছে।'