বিএনপিতে আবারও দেখা দিয়েছে মামলা ও সাজা আতঙ্ক। নতুন করে মামলা দায়েরের পাশাপাশি পুরনো মামলাগুলোর কার্যক্রম দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। ঢাকাসহ জেলা-উপজেলা পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা কয়েক শ মামলা এখন রায় ঘোষণার অপেক্ষায় রয়েছে। ফলে নেতা-কর্মীদের মধ্যে নতুন করে আবারও ব্যাপক আতঙ্ক শুরু হয়েছে। কেন্দ্রীয় নেতাদেরসহ সারা দেশে দল ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের নামে কারণে-অকারণে নতুন করে মামলা দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে দলটি। জেলা পর্যায়ের সাম্প্রতিক সমাবেশকে কেন্দ্র করে গত এক মাসে ১৮ জেলায় মামলা হয়েছে অর্ধশতাধিক। কেন্দ্রীয় দফতরের হিসাব অনুযায়ী দেশব্যাপী মামলার আসামি হিসেবে বর্তমানে বিএনপি নেতা-কর্মীর সংখ্যা ৩৬ লাখ ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে গত কয়েক মাসে ২৯টি জেলা-উপজেলায় দায়ের করা শতাধিক মামলায় জ্ঞাত ও অজ্ঞাত আসামির সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে এক লাখেরও বেশি। বেশির ভাগ মামলাই হয়েছে ভাঙচুর, ককটেল বিস্ফোরণ, মন্দির ও মূর্তি ভাঙচুর, নাশকতা, সরকারি কাজে বাধাদান, অগ্নিসংযোগ ও হত্যাকান্ডের অভিযোগে। এসব মামলার কার্যক্রম সম্প্রতি দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। মাত্র চার দিন আগে রাজধানীর একটি আদালতে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের এক মামলায় বিএনপির ১০ নেতা-কর্মীকে পাঁচ বছর করে সশ্রম কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ প্রসঙ্গে বলেন, যে কোনো ইস্যুতেই বিএনপি নেতা-কর্মীদের নামে সরকার মামলা করছে, হামলা চালাচ্ছে। সভা-সমাবেশ বানচাল করে দিচ্ছে। এটাই প্রমাণ করছে সরকারের অবস্থান গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে। বিএনপিকে নেতৃত্বশূন্য করতেই সরকারের এ উদ্যোগ। এসব মূলত সরকারের স্বেচ্ছাচারিতা এবং স্বৈরতন্ত্রের বহিঃপ্রকাশ। বিরোধী দলকে নেতৃত্বশূন্য তথা নির্মূল করার জন্যই এই অপচেষ্টা। তবে আদালতে ন্যায়বিচার হলে এসব মামলার একটিও ধোপে টিকবে না। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘সরকার বিএনপিকে ধ্বংস করার জন্য যা কিছু করা দরকার, তার সবকিছুই করছে। কিন্তু এসব নিয়ে আমরা মোটেও চিন্তিত নই। কারণ জেল খাটার অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। আমাদের আর জেলের ভয় দেখিয়ে কোনো লাভ নেই। তবে এ সরকারের সময় ঘনিয়ে এসেছে। সারা দেশের মানুষ জেগে উঠেছে। গণআন্দোলনের মাধ্যমে এ সরকারকে বিদায় করে দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করা হবে ইনশা আল্লাহ।’
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, মাস দুয়েক আগেও দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নামে সর্বশেষ গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে আদালত। দলের সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদের বিরুদ্ধে প্রতি মাসেই দেশের কোথাও না কোথাও থেকে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হচ্ছে। গত মাসে ৩২ জেলায় বিএনপির সমাবেশ কর্মসূচি চলাকালে কমপক্ষে ১৮টি জেলায় কয়েক হাজার নেতা-কর্মীর নামে অর্ধশত মামলা দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি। এর আগে দল ও অঙ্গসংগঠনের পক্ষ থেকে ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালনকালেও অসংখ্য নেতা-কর্মীর নামে মামলা দেওয়া হয়। এ ছাড়া দলের মহাসচিব ও স্থায়ী কমিটির সদস্যদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলোতেও একের পর এক চার্জশিট প্রদানসহ গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হচ্ছে।
সারা দেশে আসামি বিএনপির ৩৬ লাখ নেতা-কর্মী : বিগত ১২ বছরে বিএনপির ৩৬ লাখ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার। পুলিশ, আদালত ও বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ থেকে গত বছর জুলাই পর্যন্ত ৩৫ লাখ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে ১ লাখ ৭ হাজার মামলা হয়েছে। বেশির ভাগ মামলা হয়েছে ২০১৩ ও ২০১৫ সালে সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে। মামলা হয়েছে কেন্দ্র, জেলা, উপজেলা ও গ্রাম পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের নামেও। ভাঙচুর, ককটেল বিস্ফোরণ, অগ্নিসংযোগ ও হত্যাকান্ডের অভিযোগে এসব মামলা হয়েছে। তবে বিএনপি শুরু থেকেই মামলাগুলোকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে অভিযোগ করে আসছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, কারারুদ্ধ বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৩৭টি। এর মধ্যে দুটি মামলায় তাঁর সাজা হয়েছে। উচ্চ আদালতে ১৬টি মামলার কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। তার বিরুদ্ধে মূলত মামলা হয়েছে দুর্নীতি, মানহানি, রাষ্ট্রদ্রোহসহ হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও নাশকতার অভিযোগে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগে মামলা হয়েছে ৬৭টি। তিনি বর্তমানে লন্ডনে নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৮৭টি। এর মধ্যে ৩৫টি মামলার কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে উচ্চ আদালতে। বাকিগুলো চলমান রয়েছে।
এ ছাড়া স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ১৬টি। ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকারের বিরুদ্ধে চারটি, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়ার বিরুদ্ধে ছয়টি, মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে ৫৪টি, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের বিরুদ্ধে ৫৯টি, নজরুল ইসলাম খানের বিরুদ্ধে পাঁচটি, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে ১৩টি, সেলিমা রহমানের বিরুদ্ধে ছয়টি, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর বিরুদ্ধে ৯টি এবং ভারতের শিলংয়ে অবস্থানরত সালাউদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে ১৭টি মামলা রয়েছে। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ১৩৪টি। সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে দলটির যুগ্ম-মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেলের বিরুদ্ধে ২৫৭টি। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে সাতটি, ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমরের বিরুদ্ধে চারটি, আলতাফ হোসেন চৌধুরীর বিরুদ্ধে ছয়টি, শওকত মাহমুদের বিরুদ্ধে ৬০টি, আবদুল্লাহ আল নোমানের বিরুদ্ধে চারটি, বরকতউল্লাহ বুলুর বিরুদ্ধে ৩৭টি, আবদুল আউয়াল মিন্টুর নামে ছয়টি এবং মোহাম্মদ শাহজাহানের বিরুদ্ধে ২৮টি মামলা রয়েছে।
এ ছাড়া অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেনের বিরুদ্ধে ২৪টি, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমানের বিরুদ্ধে ১২৩টি, আবদুস সালামের বিরুদ্ধে ৩৭টি, মিজানুর রহমান মিনুর বিরুদ্ধে ৩৭টি, জয়নাল আবেদিন ফারুকের বিরুদ্ধে ২৩টি, যুগ্ম-মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনের বিরুদ্ধে ১৩টি, মজিবর রহমান সরোয়ারের বিরুদ্ধে ৫৭টি, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের বিরুদ্ধে ১৩৪টি ও খায়রুল কবির খোকনের বিরুদ্ধে ৫৭টি মামলা রয়েছে। অন্যদিকে সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর বিরুদ্ধে ১০৭টি, আসাদুল হাবিব দুলুর বিরুদ্ধে ৫৭টি, প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক এ বি এম মোশাররফের বিরুদ্ধে ৪৭টি, যুবদল সভাপতি সাইফুল আলম নিরবের বিরুদ্ধে ৮৬টি, সাধারণ সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর বিরুদ্ধে ১৫৩টি, স্বেচ্ছাসেবক দলের আবদুল কাদির ভুঁইয়া জুয়েলের বিরুদ্ধে ৫৩টি এবং ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব সাবেক ফুটবলার আমিনুল হকের বিরুদ্ধে ১৩টি মামলা রয়েছে।
হবিগঞ্জে দুই হাজার নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা : সম্প্রতি হবিগঞ্জে পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনায় দুই হাজার নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ২৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় সদর থানার এসআই নাজমুল ইসলাম বাদী হয়ে মামলাটি করেন। মামলায় বিএনপির কেন্দ্রীয় সমবায় বিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক মেয়র জি কে গউছকে প্রধান আসামি এবং জেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মো. এনামুল হক সেলিমকে আসামি করা হয়েছে। এ ঘটনায় আটক ১০ জনকে মামলার পর গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
চট্টগ্রামে বিএনপির আহ্বায়কসহ ৭৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা : ৫ জানুয়ারি চট্টগ্রামে পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় মামলা হয়েছে। মামলায় আসামি করা হয়েছে মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক ডা. শাহাদাত হোসেন ও সদস্য সচিব আবুল হাশেম বক্করসহ মোট ৭৫ জনকে। ১০০ জনের অংশগ্রহণে একটি মানববন্ধন করার মৌখিক অনুমতি নেওয়ার পর লোকসমাগম বেশি হওয়ায় পুলিশ বাধা দেয়। সেই বাধা অমান্য করে সমাবেশ করায় পুলিশ মামলা দেয় এবং ঘটনাস্থল থেকে ৪৯ জনকে আটক করে।
জামালপুরে মামলা : জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে ২২ নভেম্বর বিএনপির অর্ধশতাধিক নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে পুলিশ। পৌর বিএনপির সহ-সভাপতি গোলাম রব্বানি লিকুকে প্রধান করে মামলায় ১৮ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা আরও ৫০-৬০ জনকে আসামি করা হয়েছে এতে।
সিরাজগঞ্জে চার মামলায় আসামি ৮০০ : সিরাজগঞ্জে ৩০ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতা-কর্মীদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনায় চারটি মামলা হয়েছে। সংঘর্ষে অংশ নেওয়া চিহ্নিত যুবলীগের অস্ত্রধারীরা কেউ আটক না হলেও এ ঘটনায় চারটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে পুলিশ বাদী হয়ে তিনটি মামলা ও একজন স্থানীয় বাসিন্দা বাদী হয়ে একটি মামলা করেছেন। চারটি মামলায় আট শতাধিক আসামি ও অজ্ঞাত এক হাজার জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। স্থায়ী কমিটির অপর সদস্য বেগম সেলিমা রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমাদের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা নতুন কিছু না। আমরা ঘরে বসে থাকলেও মামলা দেয়। নেতা-কর্মীরা আন্দোলনের মাধ্যমে এসব মোকাবিলা করবে। সরকারের পতন ঘটিয়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা হবে।’ দলের সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ এ বিষয়ে বলেন, ‘আমাদের মূল শক্তি হচ্ছে দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীরা এখন ঐক্যবদ্ধ। আমাদের এই ঐক্যে কেউ ফাটল ধরাতে পারবে না। ঐক্যবদ্ধভাবে আমরা এসব মামলা মোকাবিলা করব।’
১০ নেতা-কর্মীর পাঁচ বছর করে কারাদন্ড : বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলায় বিএনপির ১০ নেতা-কর্মীকে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদন্ড দিয়েছে আদালত। ১০ জানুয়ারি ঢাকার দ্রুত বিচার আদালত-৯-এর বিচারক মো. আমিরুল ইসলাম এ রায় ঘোষণা করেন। দন্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন সুমন চন্দ্র, মো. জসিম, মো. আমিনুল ইসলাম, সোহেল, কাউছার, জুয়েল, আবদুর রহমান, শহিদ, মহসিন ও লিটন।