মৌলভীবাজারের ৭টি উপজেলার নদী তীরবর্তী এলাকায় বন্যা পরিস্থিতিতে উন্নতির দিকে থাকলেও হাওর এলাকায় পানি কমেনি, হাকালুকি হাওর তীরবর্তী এলাকায় দীর্ঘ জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছে হাকালুকি হাওরপারের বানভাসীরা।
জুড়ী নদী ছাড়া সব নদনদীর পানি বিপৎসীমার অনেক নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে লোকালয় থেকে পানি নামছে। তবে ধীরগতিতে পানি নামায় এখনও দুর্ভোগ কমেনি বন্যাদুর্গত এলাকায়। শুধু কুলাউড়াতেই পানিবন্দি লক্ষাধিক মানুষ।
বানের পানি নামতে শুরু করায় নদীতীরবর্তী বিভিন্ন গ্রামের ঘরবাড়ি ছাড়া মানুষ নিজ ভিটায় ফিরতে শুরু করেছেন। তবে জেলার সীমান্তঘেঁষা জুড়ী নদীর পানি এখনও বিপৎসীমা স্পর্শ করে থাকায় আতঙ্ক কাটেনি। নদীতে পানির প্রবাহ বেশি থাকায় কমেনি হাকালুকি হাওরের পানি। হাওরবেষ্টিত এলাকার পানি কমছে ধীরগতিতে। এ কারণে বড়লেখা, জুড়ী ও কুলাউড়া উপজেলার হাওরপারের বিভিন্ন গ্রামের মানুষ পানির জিম্মিদশা থেকে রেহাই পাচ্ছেন না।
জানা যায়, সীমান্তবর্তী জুড়ী নদীর পানি হাকালুকি হাওরে পতিত হয়। ফলে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত এ নদীর পানিতে ভাসছে হাকালুকি হাওরের মানুষ। হাওরপারের কুলাউড়া উপজেলার ভুকশীমইল, বরমচাল, ভাটেরা, জয়চণ্ডী, জুড়ীর পশ্চিম জুড়ী, জায়ফরনগর, গোয়ালবাড়ি, বর্ণি, তালিমপুর, দাশেরবাজারসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের শত শত গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ। এতে করে হাওরপারের বন্যাপীড়িত মানুষ বানের পানির কবল থেকে রেহাই পাননি।
কুলাউড়ার গৌড়করণ গ্রামের সোহেল আহমদ বলেন, ভুকশীমইল ইউনিয়নের শতভাগ রাস্তা ও ৬০ ভাগ মানুষের ঘরবাড়ি বানের পানিতে ডুবে গিয়েছিল। এখন কিছু কিছু রাস্তার অংশ ভাসতে শুরু করেছে। তবে সব রাস্তায় চলাচল এখনও স্বাভাবিক হয়নি। এখনও পানিতে ডুবে আছে স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন স্থাপনা।
স্থানীয়দের দাবি, প্রায় প্রতিবছর বন্যার পানির সঙ্গে লড়াই করে এ এলাকার মানুষকে বাঁচতে হয়। বন্যার স্থায়ী সমাধানে পানি উন্নয়ন বোর্ড কোনো কার্যকরী ব্যবস্থা না নেওয়ায় বর্ষা মৌসুম এলেই প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হন তারা। জুড়ী নদীসহ হাকালুকি হাওরের নদনদী, খাল-বিল, নালা খনন না হওয়ায় তলদেশ দিন দিন ভরাট হচ্ছে। ফলে নদনদী টইটম্বুর হয়ে পানি ধারণের ক্ষমতা কমে যাওয়ায় বৃষ্টি ও উজানের ঢলের পানি দ্রুত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
এদিকে ভুকশীমইল গ্রামের এম এস আলী জানান, আশ্রয় কেন্দ্রে থাকা মানুষ খাদ্য সংকটের সঙ্গে বিশুদ্ধ পানির সমস্যায় ভুগছে। এতে পানিবাহিত রোগজীবাণুতে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে হাওর এলাকায়।
ভুকশীমইল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান মনির বলেন, তাঁর ইউনিয়নে ৫ হাজার পরিবার পানিবন্দি। তার মাঝে তিন হাজার পরিবারকে ১০ কেজি করে চাল দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এবারের বন্যায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রাস্তা ও কাঁচা ঘরবাড়ি। গভীর নলকূপগুলো ডুবে যাওয়ায় ইউনিয়নে বিশুদ্ধ পানি তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।
মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জাবেদ ইকবাল বলেন, কুশিয়ারা নদীর পানি ধীরগতিতে কমায় হাকালুকি হাওরের পানিও ধীরে কমছে। কুশিয়ারা ও সুরমা নদী ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের আওতায় নিতে সিলেট থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ড কাজ করছে। এতে করে সমস্যা কিছুটা কমবে বলে আশা করা যায়।
কুলাউড়ায় বন্যায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি রয়েছেন। এখানকার মানুষের বাসাবাড়িসহ গুরুত্বপূর্ণ নানা প্রতিষ্ঠান বন্যার পানিতে ডুবে আছে। এতে করে এখনও স্বাভাবিক হয়নি এ উপজেলার মানুষের দৈনন্দিন জীবন। বন্যার শুরু থেকে জনপ্রতিনিধি ও উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা বন্যার্তদের পাশে রয়েছেন। তবে বিরূপ প্রকৃতির রোষে বেসামাল সবাই।
উপজেলার বিভিন্ন এলাকার ২৮টি আশ্রয়কেন্দ্রে বর্তমানে দুই হাজারেরও বেশি মানুষ আশ্রিত। প্রতিদিনই আশ্রয়কেন্দ্রসহ বন্যাকবলিত এলাকায় শুকনো খাবারের পাশাপাশি রান্না করা খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও ওষুধ বিতরণ করা হচ্ছে। তবে চাহিদার তুলনায় সেসব কম বলে জানিয়েছেন বন্যাদুর্গত এলাকার অনেকেই।
বন্যায় এখানকার প্রায় ৫০ কিলোমিটার রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৮২০ হেক্টর ফসলি জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। মৎস্য সম্পদেরও ক্ষতি হয়েছে প্রায় কোটি টাকার। ২ হাজার ৩০০ কৃষক ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। তাদের মাঝে বীজ ও সার বিতরণ করা হচ্ছে বলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) লুসিকান্ত হাজং জানিয়েছেন।