চারদিকে ভোটের আমেজ, দরজায় কড়া নাড়ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আগামী বছরের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য এই নির্বাচনে অংশ নিতে এরই মধ্যে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টিসহ নিবন্ধিত ৩০টি রাজনৈতিক দল প্রার্থী মনোনয়নসহ নানান প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন করে ফেলেছে। অন্যদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে অধীনে নির্বাচন দাবিতে এখনও অবরোধ ও হরতালের মতো কর্মসূচিতে আটকে রয়েছে রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। ফলে বিএনপিহীন নির্বাচনের মাঠে এবার জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে প্রায় সব আসনেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার হিড়িক পড়েছে।
বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবির উত্তাপের মধ্যেই গত ১৫ নভেম্বর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। তফসিল অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচনের ভোট অনুষ্ঠিত হবে। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ সমমনা দলগুলো এই তফসিল প্রত্যাখ্যান করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে তফসিলকে স্বাগত জানিয়ে মনোনয়ন ফরম বিক্রি শুরু করে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও তৃণমূল বিএনপিসহ আরও বেশকিছু রাজনৈতিক দল। ইতোমধ্যে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৮টির দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করেছে আওয়ামী লীগ। এতে বেশ কিছু আসনে নতুন মুখ আসার পাশাপাশি তিন প্রতিমন্ত্রীসহ সত্তরের বেশি সংসদ সদস্য মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েছেন। অন্যদিকে রওশন এরশাদের আসন ফাঁকা রেখে ২৮৯টিতে দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে জাতীয় পার্টি। আর তৃণমূল বিএনপি ৩০০ আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত করলেও ২৮০টির তালিকা প্রকাশ করেছে।
এদিকে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে অনেকেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হচ্ছেন। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ থেকে এবার বেশি স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে দেখা যাচ্ছে। কেউ যেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হতে না পারেন, সেজন্য দলটি থেকে এবার অনেককে স্বতন্ত্র প্রার্থী দাঁড় করানোর কৌশল নেওয়া হয়েছে। এর ফলে নৌকার মনোনয়ন না পাওয়া অনেকে ইতোমধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে মনোনয়নপত্র কিনেছেন। এর মধ্যে জামালপুর-৪ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন মনোনয়ন বঞ্চিত আওয়ামী লীগের এমপি ডা. মুরাদ হাসান। এ ছাড়া আসনটিতে ক্ষমতাসীন দলের আরও দুই নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে হচ্ছেন। অন্যদিকে হবিগঞ্জ-৪ আসনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হচ্ছেন আলোচিত মুখ ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। এছাড়া রাজশাহী-১ আসনে নায়িকা মাহিয়া মাহি ও বাগেরহাট-৩ আসনে চিত্রনায়ক শাকিল খান স্বতন্ত্র প্রার্থী মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। চারদিকে ক্ষমতাসীন দল থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার হিড়িক পড়ে গেছে। শুধু গত মঙ্গলবার এক দিনেই ৩৩টি আসনে আওয়ামী লীগের অন্তত ১০ জন বর্তমান সংসদ সদস্যসহ ৫২ জন নেতার স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে কুমিল্লা-১ আসনে মোহাম্মদ সুবিদ আলী ভূঁইয়া এবার দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়তে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। অন্যদিকে গাজীপুর-৩ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন আসনটির বর্তমান সংসদ সদস্য মুহাম্মদ ইকবাল হোসেন। এ ছাড়া রাজশাহী-৪ আসনের আওয়ামী লীগের এমপি এনামুল হক, রাজশাহী-৩ আসনের আয়েনউদ্দিন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫ আসনের মোহাম্মদ এবাদুল করিম, সিরাজগঞ্জ-২ আসনের হাবিবে মিল্লাত, সুনামগঞ্জ-২ আসনের জয়া সেনগুপ্তা, হবিগঞ্জ-২ আসনের আবদুল মজিদ খান, ঝিনাইদহ-২ আসনের শফিকুল আজম খান ও নওগাঁ-৪ আসনের এমপি ইমাজউদ্দিন প্রামাণিক স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন।
আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যদের বাহিরেও অনেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও তৃণমূলের নেতারা মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। এর মধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পদত্যাগ করেছেন ঢাকার কেরানীগঞ্জ উপজেলার চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ,বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার চেয়ারম্যান সামসুল আলম চুন্নু, পাবনার চাটমোহর উপজেলার চেয়ারম্যান আব্দুল হামিদ মাস্টার, রাজবাড়ী সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট ইমদাদুল হক বিশ্বাস, নেত্রকোনার দূর্গাপুর উপজেলার চেয়ারম্যান জান্নাতুল ফেরদৌস আরা ঝুমা তালুকদার। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জ-১ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান ভূঁইয়া। পাশাপাশি নেত্রকোনা-৪ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন আওয়ামী লীগের সাবেক সহসম্পাদক শফী আহমেদ।
শুধু যে আওয়ামী লীগ থেকেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হচ্ছেন, তা কিন্তু নয়। দলীয়ভাবে নির্বাচনবিমুখ বিএনপির অনেক নেতাও স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে স্বতন্ত্র নির্বাচন করতে মনোনয়নপত্র কিনেছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ এ কে এম একরামুজ্জামান। বিএনপির শক্তিশালী ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত বগুড়ার চারটি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হচ্ছেন তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদ শোকরানা ও বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সাবেক সদস্য ও চারবারের সাবেক সংসদ সদস্য ডা. জিয়াউল হক মোল্লাসহ দলটির চার নেতা। এ ছাড়া স্বতন্ত্র নির্বাচন করতে নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও সাবেক সংসদ সদস্য মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিনের নামে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে। এর বাইরে দলটির তৃণমূলের অনেক নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে মনোনয়নপত্র কিনেছেন বলে জানা গেছে। যাদের মধ্যে কয়েকজন জেলা সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকও আছেন। দল শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে না গেলে তারা স্বতন্ত্র হিসেবেই নির্বাচন করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এর ফলে সবমিলিয়ে এবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রায় ৩০০ আসনেই একাধিক স্বতন্ত্র প্রার্থী হচ্ছেন। যার মোট সংখ্যা কয়েক হাজার ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
অন্যদিকে গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ ঘিরে সহিংসতার পর থেকে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস ও যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালসহ গ্রেপ্তার হওয়া শীর্ষ নেতারা এখনও জামিন পাননি। তবুও দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ না নিতে অনড় থেকে টানা অবরোধ আর হরতাল কর্মসূচি পালন করছে দলটি। এমন পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে বিএনপিকে ছাড়াই সংবিধান অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের পথে হাঁটছে দেশ।