ঢাকা, রবিবার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১

বিশ্ববিদ্যালয় জয় করলেন কড়া সম্প্রদায়ের প্রথম ছেলে লাপোল

ইমরান আলী : | প্রকাশের সময় : রবিবার ৯ জানুয়ারী ২০২২ ০৫:০১:০০ অপরাহ্ন | শিক্ষা

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার এন্ড পারফমেন্স স্টাডিজ বিভাগে 

২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের স্মাতক (সম্মান) শ্রেণিতে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন লাপোল কড়া। এর মাধ্যমে 

আদিবাসী কড়া সম্প্রদায়ের প্রথম কেউ উচ্চশিক্ষার গণ্ডিতে প্রবেশ করলো। থিয়েটার অ্যান্ড 

পারফরম্যান্স সটাডিজ বিভাগে ভর্তির জন্য বৃহ¯পতিবার (৬ই জানুয়ারি) ব্যবহারিক পরীক্ষায় অংশ 

নেন তিনি।

 

লাপোলের আগে কড়া সম্প্রদায়ের কেউ মাধ্যমিকের গণ্ডিও পেরোতে পারেনি। নানা প্রতিকূলতার 

কারণে কড়া সম্প্রদায়ের মাত্র ২৮টি পরিবার এখনো বাংলাদেশে টিকে আছে। শ'খানেক মানুষের এই 

সম্প্রদায়টি অবশ্য 'বাংলাদেশ সরকার স্বীকৃত ৫০টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর' একটি। অবহেলিত কড়া 

সম্প্রদায়ের পাশে দাঁড়াতে উচ্চ শিক্ষার লড়াইয়ে অবিচল লাপোল কড়া। 

 

কড়া সম্প্রদায়ের বসবাস বাংলাদেশর উত্তরের জনপদ দিনাজপুরে। দিনাজপুরের বিরল উপেজলায় ২৪ 

টি ও জেলা সদরে বাকি ৪টি পরিবার কোনরকমে টিক আছে। নানা সঙ্কটে সম্প্রদায়টি ইতিমধ্যেই 

বিলুপ্তির পথে। 

 

লাপোল কড়া বিরল উপজেলার রানীপুকুর ইউনিয়নের রাঙ্গন গ্রামের রতন কড়ার ছেলে। কড়াদের 

মধ্যে লাপোলই প্রথম গত বছর এইচএসসি পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য লড়ছেন। ওই 

সম্প্রদায়ের ১০৪ জন সদস্যের মধ্যে লাপোল স্থানীয় রাঙ্গন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে সমাপনী, 

হালজায় উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও বোর্ড হাট মহাবিদ্যালয় থেকে এইচএসসি পাস করেন।

 

ব্যবহারিক পরীক্ষার পর প্রকাশিত চূড়ন্ত মেধাতালিকায় দেখা যায় লাপোলের অবস্থান ১৫তম। সে 

এসএসসি পরীক্ষায় ৩.৩৩ এবং এইচএসসিতে ৩.৫৮ জিপিএ নিয়ে উত্তীর্ণ হয়। বৃহ¯পতিবারের 

ব্যবহারিক পরীক্ষায় একশোর মধ্যে ৯০ পেয়েছে সে। 

 

মেধাতালিকায় ১৫তম হয়ে ভর্তির সুযোগ করে নেয়ায় আনন্দে আপ্লুত লাপোল বলেন, নাট্যকলা 

বিভাগে ১৫ তম হয়েছি। আজ চেনা অনূভুতিগুলো যেন অন্যরকম অনুভূত হচ্ছে। মনে হচ্ছে আজ 

যেন জীবনের সূর্যোদয় হয়েছে, অনিশ্চিত অন্ধকার কালো রাত পেরিয়ে যেন এক নতুন সূর্যোদয়। যে 

মহৎ আত্মার ব্যক্তিগণ আমাকে এই সফলতার জন্য সাহায্য করেছেন, তাঁদের সবাইকে আমি আমার 

আত্মার আত্নীয়তা স্বীকার করছি এবং হৃদয় নিংড়ানো অশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

 

নাট্যকলা বিভাগের ব্যবহারিক পরীক্ষার সময় উপস্থিত ছিলেন বিভাগীয় প্রধান মো. আল জাবির। তিনি 

বলেন, তার পারফরম্যান্স অসাধারণ ছিল। ভালো করেছে সে। কড়া একটি পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়। 

সেখান থেকে এখানে আসতে তাকে অনেক টানাপোড়েনের শিকার হতে হয়েছে। সে অবশেষে সব জয় 

করেছে। তাকে পেয়ে আমরা অত্যন্ত আনন্দিত। জীবেনর শত বাধা বিপত্তি পেড়িয়ে তার এই সংগ্রামকে 

আমরা শ্রদ্ধা জানাই। জীবনের পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা তাকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করতে 

চাই। আমরা চাই তার মাধ্যমে কড়া সম্প্রদায় জেগে উঠবে। সে হবে কড়াদের অনুপ্রেরণা।

 

লাপোল কড়া বলেন, 'আমি এইচএসসি পাস করার আগ পর্যন্ত আমাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে সবচেয়ে 

উচ্চ শিক্ষিত ছিলেন কৃষ্ণ মামা। ভূমিদস্যুদের সঙ্গে লড়াই করে আমাদের গ্রামটাকে রক্ষা করতে গিয়ে 

দশম শ্রেণির চৌকাঠ পেরোতে পারেননি কৃষ্ণ মামা। কিন্তু তিনিই প্রেরণা হয়েছেন এগিয়ে যাওয়ার। 

কৃষ্ণ মামার অনুপ্রেরণায় প্রতিকূল অবস্থাকে উপেক্ষা করে প্রবল আত্মবিশ্বাস নিয়ে পড়ালেখার প্রতি 

মনযোগী হয়েছি। অনুধাবন করেছি- অবহেলিত, নির্যাতিত কড়া সম্প্রদায়ের পাশে দাঁড়াতে শিক্ষা আর 

উচ্চশিক্ষার কোনো বিকল্প নেই।'

 

কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও বিশিষ্ট লেখক মেহেদী উল্লাহ 

বলেন, অনগ্রসর আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে কড়া সম্প্রদায়ে শিক্ষা দীক্ষার হার কম। তবে যে কোনো 

ধরনের জাতিসত্তার পিছিয়ে থাকার সুযোগ নেই। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে প্রতিটি মানুষেরই শিক্ষার 

মৌলিক অধিকার থাকে। অনেকে নানা আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটের কারণে পিছিয়ে যায়। তাদেরকে 

এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে সংকটগুলো থাকে, সেগুলো দূরীকরণের মাধ্যমে তাদেরকে বেরিয়ে 

আসার সুযোগ দিতে হবে। যদি কেউ সকল প্রতিকূলতা প্রতিহত করে নিজের স্বাতন্ত্র, সংস্কৃতি রক্ষা 

করতে চায়, তবে অবশ্যই তাকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। এতে তার সংস্কৃতি টিকে থাকবে। 

জাতিসত্তা ও জনগোষ্ঠীগুলো পিছিয়ে আছে শিক্ষার হারে। তারা যদি শিক্ষায় এগিয়ে আসে তাহলে রাষ্ট্র 

উপকৃত হবে।