ঢাকা, রবিবার ১৯ মে ২০২৪, ৪ঠা জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
স্বাধীন দেশে পরাধীন এক গ্রাম

ভূমিহীন তিনশ’পরিবার জিম্মি

বগুড়া প্রতিনিধি : | প্রকাশের সময় : শনিবার ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০১:৫৯:০০ অপরাহ্ন | দেশের খবর

এ যেন স্বাধীন দেশে পরাধীন এক গ্রাম। গ্রামে প্রায় ৪শ’ পরিবারের বসবাস। এরমধ্যে তিনশ’ পরিবারই প্রায় দুই যুগ ধরে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ। দিনের পর দিন উচ্ছেদ আতঙ্কে কাটে এখানকার মানুষের। প্রতিবাদের চেষ্টা করলেই করা হয়েছে পুলিশী হয়রানী। মামলা, হামলা, গ্রেপ্তারের শিকার হয়ে এখন প্রতিবাদ করার সব সাহসও হারিয়ে ফেলেছে মানুষগুলো। সম্প্রতি হাইকোর্ট বিভাগের স্থিতাবস্থার আদেশ লঙ্ঘন করে একটি ভূমিহীন পরিবারের বসতবাড়িটি ভেঙ্গে লুট করা হয়েছে। পুলিশ ও প্রশাসনের সহযোগিতার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরলেও মেলেনি কোনো সহায়তা। লুটপাটের প্রতিবাদ করায় উল্টো মিথ্যা মামলায় কারাভোগ করতে হয়েছে পরিবারের সদস্যদের।

বগুড়ার শেরপুর উপজেলার একটি প্রাচীন জনপদ ভবানীপুর। নাটোরের রাণী ভবানীর স্মৃতিবিজড়িত এই গ্রামের প্রায় তিনশ’ পরিবার স্থানীয় একটি মন্দির পরিচালনা কমিটি কর্তৃক বছরের পর বছর নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছে। স্থানীয় মুসলমান পরিবারসহ নিম্ন বর্ণের হিন্দু, আদিবাসী কেউই রেহাই পাননি এদের হাত থেকে।

গত ৪ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট বিভগের স্থিতাবস্থার আদেশ লঙ্ঘন করে মন্দিরের কেয়ারটেকার অপূর্ব চক্রবর্তী ভূমিহীন আলতাফ হোসেন এর বসতবাড়ি ভাঙ্গার কাজ শুরু করে। এসময় আলতাফ হোসেনের পূত্র সেলিম থানায় ফোন করে পুলিশের সহযোগিতা চান। পুলিশ এসে উল্টো আলতাফ হোসেন-এর ভাগ্নে মামুনকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। থানায় নিয়ে তার বিরুদ্ধে জঙ্গী, সন্ত্রাসীসহ বিভিন্ন তৎপরতার অভিযোগে মামলা রেকর্ড করার প্রক্রিয়া শুরু করেন থানার ওসি বাবু কুমার সাহা। পরে একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশে সন্ধ্যার পর তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। পরদিন মন্দির কমিটির লোকেরা বাড়িটি ভেঙ্গে যাবতীয় মালামাল লুট করে।

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০০৪ সালে মন্দির পরিচালনা কমিটি মন্দিরের প্রাচীর ভেঙ্গে মন্দিরে রক্ষিত ২টি বড় মাপের লোহার সিন্দুক, কাঁসার বাসনপত্র, স্বর্ণের গহণা, বেশকিছু গাছপালাসহ অনেক মূল্যবান জিনিসপত্র ট্রাকযোগে বগুড়ায় নিয়ে যায়। এ ঘটনার  প্রতিবাদ করেছিলেন মন্দিরের কার্যকরী সদস্য বগুড়ার সিনিয়র সাংবাদিক, বগুড়া থেকে প্রকাশিত দৈনিক দুর্জয় বাংলা পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক দীপঙ্কর চক্রবর্তী। 

এর কিছুদিন পরই ২০০৪ সালের ২ অক্টোবর রাতে নিজ বাড়ীর সামনে খুন হন তিনি। ১ যুগ পর পুলিশ দীপঙ্কর হত্যায় জেএমবিকে দায়ী করে প্রতিবেদন দাখিল করে।  তবে তার পরিবারের সদস্যরা পুলিশের এই রিপোর্ট প্রত্যাখান করেছেন। মন্দিরের মালামাল লুটের এই ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিলেন মন্দিরের তখনকার পুরোহিত ষষ্ঠী ঠাকুর। ষষ্ঠী ঠাকুরকে মন্দির কমিটির লোকেরা উল্টো দীপঙ্কর হত্যার সন্দেহভাজন আসামী করে। রিমান্ড ও কারাভোগে অসুস্থ হয়ে কিছুদিন পর তিনি মারা যান। 

নিজবাড়ির গাছ কাটায় ২০০৫ সালে ব্যবসায়ী শ্রী নীলমনিসহ কয়েকজনকে গাছ চুরির দায়ে আসামী করে বগুড়ার শেরপুর থানায় একটি মামলা দায়ের করে মন্দির কমিটি। মামলায় তারা জেল খেটে কিছুদিন পর জামিনে মুক্তি পান। মুক্তির কিছুদিন পর ভয়ে সপরিবারে দেশ ছেড়ে ভারতে পাড়ি জমায় নীলমনির পরিবার।

সরকারি খাস পুকুরে স্থানীয় মৎস্যজীবীদের সাথে নিয়ে মাছ চাষ করতেন জেলা ছাত্রলীগ নেতা কাফি। এসব পুকুর মন্দিরের দাবী করে ২০১৮ সালে কাফির বিরুদ্ধে লুটতরাজের একটি মামলা দায়ের করে মন্দির কমিটি। এই মামলায় বেশকিছুদিন জেল খাটার পর তিনি জামিনে মুক্তি পান। কাফি উপজেলা আওয়ামীলীগের সদস্য রফিকুল ইসলাম বুলুর পুত্র। 

গ্রামের আরেকজন সাধারণ কৃষক মহাদেব সাহা। নিজ জায়গায় বাড়ি করতে গেলে মন্দির কমিটি তাকে ও তার সন্তানদের নামে আরেকটি মামলা দায়ের করে। মামলায় ভীত হয়ে ভয়ে পরিবারটি চুপ হয়ে গেছে।

গ্রামের নাইওর পাড়ে বসবাস করেন হিন্দু ও সাঁওতাল আদিবাসীসহ প্রায় ৫০টি ভুমিহীন পরিবার। নাইওর পুকুর বৃটিশ আমল থেকেই সরকারি ১নং খাস খতিয়ানভুক্ত পুকুর। উপজেলা নির্বাহী অফিস থেকে বাৎসরিক লীজ নিয়ে এসব ভুমিহীন পরিবার সমবায় ভিত্তিক মাছ চাষ করে জীবীকা নির্বাহ করে। ২০১২ সালে মন্দির পরিচালনা কমিটি পুকুরটি মন্দিরের দাবী করে ভুমিহীনদের বসতবাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। পরবর্তীতে ইউএনও’র হস্তক্ষেপে ভুমিহীনরা সে যাত্রায় রক্ষা পান। 

দাগ নম্বর জালিয়াতির মাধ্যমে গত ২০২১ সালে একতরফা একটি রায়ের মাধ্যমে ভূমিহীন আলতাফ হোসেন-এর বাড়ির চারপাশে লাল পতাকা টানিয়ে দিয়ে যায় পুলিশ ও প্রশাসনের লোকজন। এরপর তিনিসহ গ্রামের ২৯ জন মিলে ২০২২ সালের জুন মাসে হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন দায়ের করলে, হাইকোর্ট রুল জারীসহ স্থিতাবস্থার আদেশ দেন। কিন্তু মন্দির কমিটি হাইকোর্ট বিভাগের সেই আদেশ লঙ্ঘন করে গত ৪ সেপ্টেম্বর বাড়িটি ভেঙ্গে নিয়ে যায়। 

গত ফেব্রুয়ারি মাসে প্রাচীর তুলে বাড়িটি অবরুদ্ধ করে কমিটির লোকেরা। এ সময় বাধা দিতে গেলে মন্দির পরিচালনা কমিটির সদস্য দিলীপ কুমার দেব মন্দিরের প্রাচীর ভাংচুরের অভিযোগে শেরপুর থানায় আলতাফ হোসেনের পুত্র সেলিম সরকার, ভাগ্নে মামুন শেখ ও সাবেক ইউপি সদস্য আব্দুল হান্নান খন্দকারকে আসামী করে শেরপুর থানায় একটি মিথ্যা মামলা দায়ের করেন। উক্ত মামলায় ৯ দিন কারাভোগের পর ভুক্তভোগী সেলিম জামিনে মুক্তি পান।

মন্দির কমিটি গত ২০০২ সালে থেকে ভবানীপুর মৌজার ১নং সিএস খতিয়ানভুক্ত প্রায় ৪৬ একর জমি শ্রী শ্রী ভবানী বিগ্রহের মর্মে দাবী করে আসছে। এসব সম্পত্তির উপর গ্রামের প্রায় তিনশ’ ভূমিহীন পরিবার ৫০ থেকে ৬০ বছর যাবত বসবাস করে আসছেন। এই তিনশ” পরিবারের অর্ধেক হিন্দু ধর্মাবলম্বী। এছাড়াও নালিশী এসব ভূমির উপর ইউনিয়ন ভূমি অফিস, ডাকঘর, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, এমপিওভুক্ত হাইস্কুল, হাট- বাজারসহ বিভিন্ন স্থাপনা রয়েছে। 

উপজেলা আওয়ামীলীগের সদস্য ও স্থানীয় অধিবাসী রফিকুল ইসলাম বুলু জানান, “মন্দির নিয়ে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। মন্দিরে যথারীতি পূজাপার্বন অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। মন্দিরটি ১নং খাস খতিয়ানভুক্ত সম্পত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। এটা একটা সরকারি মন্দির। বর্তমানে এই মন্দিরের সভাপতি জেলা প্রশাসক এবং সাধারণ সম্পাদক উপজেলা নির্বাহী অফিসার। কিন্তু তারা ডিসি ও ইউএনও’র কোনো কথাই শোনে না। মন্দির কমিটির কতিপয় সদস্য মিথ্যা মামলা, হামলা ও হয়রানী করে আমাদের বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে গ্রামটিকে বিরানভূমি বানাতে চাচ্ছেন। এদের সাথে পুলিশ ও প্রশাসনের উচ্চ পদস্থ হিন্দু কর্মকর্তারা জড়িত।”

মন্দির কমিটির দাবীকৃত কাগজপত্রকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে গ্রামবাসীর পক্ষে রীট করেছেন সাবেক ইউপি সদস্য আব্দুল হান্নান খন্দকারসহ ২৯ জন। তিনি বলেন, মন্দির কমিটির নির্যাতনে আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। তারা সংখ্যালঘুর দোহাই দিয়ে পুলিশ ও প্রশাসনের হিন্দু কর্মকর্তাদের ব্যবহার করে আমাদের উপর জুলুম-নির্যাতন চালাচ্ছে। অতীতে এসব সম্পত্তি কখনোই দেবোত্তর খতিয়ানভুক্ত ছিলন্ াএসব সম্পত্তি বৃটিশ আমল থেকেই ১নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত সম্পত্তি। তিনি জানান, মহামান্য আদালত আমাদের রিট আবেদন মঞ্জুর করে রুল জারী করেছেন এবং নালিশী সম্পত্তির উপর স্থিতাবস্থার আদেশ জারী করেছেন।

বগুড়ার জেলা প্রশাসকের রেকর্ড রুম থেকে জানা যায়, ১৯৩০ সালে প্রণীত ক্যাডেস্টাল সার্ভে বা সিএস রেকর্ড ১নং খতিয়ানভূক্ত। এসব সম্পত্তি ভারত সম্রাটের নামে এবং দখলকার হিসাবে জমিদার বিরেন্দ্র নাথ রায়, পিতা জিতেন্দ্র নাথ রায়, সাং নাটোর, জেলা রাজশাহী লেখা রয়েছে। এসব সম্পত্তি বৃটিশ আমল থেকেই সরকারি সম্পত্তি। তৎকালীন জমিদার সরকারি সম্পত্তির উপরই মন্দিরটি স্থাপন করেছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৫৬ সালের ১৪ এপ্রিল জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত করে ৪৮৩৯ এলআর গেজেট নোটিফিকেশনমূলে তা অধিগ্রহণ করা হয়। সেই অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশ পক্ষে কালেক্টর, বগুড়া এর নামে স্টেট অ্যাকুইজিশন রেকর্ড বা এসএ রেকর্ড ১নং খাস খতিয়ান হিসাবে চুড়ান্তভাবে প্রকাশ করা হয়। 

সুপ্রীমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মোঃ শামছুল হক জানান, প্রেসিডেন্ট অর্ডার নং ৯০/১৯৭২ অনুযায়ী সরকারিভাবে অধিগ্রহণকৃত সম্পত্তির বিরুদ্ধে কোনো মামলা করার বিধান নেই। আদেশে বলা হয়েছে, “জমিদারী উচ্ছেদ প্রজাস্বত্ব আইনের অধীনে কোনো সম্পত্তি সরকার অধিগ্রহণ করলে তার বিরুদ্ধে দেশের কোনো আদালতে কোনো মামলা মোকর্দ্দমা করা যাবেনা। কোনো মামলা চলমান থাকলে তাও বাতিল বলে গণ্য হবে। কোনো আদালত অধিগহণের বিরুদ্ধে কোনো রায় দিলে সেই রায়ের আইনগত কোনো কার্যকারিতা থাকবেনা।”

স্থানীয় ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেন, মন্দির পরিচালনা কমিটি অধিগ্রহণের এই তথ্য এবং প্রেসিডেন্ট অর্ডারের বিষয়টি গোপন করে সরকারি কৌশুলীর সাথে যোগসাজস করে সরকারি এসব সম্পত্তি হাতিয়ে নিতে গত ২০০২ সালে বগুড়ার যুগ্ন জেলা জজ আদালতে একটি স্বত্ব ঘোষণার মোকর্দ্দমা দায়ের করেন। ১৯৬৭ সাল থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ে এসব সম্পত্তির একটি অংশ স্থানীয়দের মাঝে সরকার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রদান করেছেন। এসব জায়গায় ভূমিহীনদের বসতবাড়ি বিদ্যমান। তথাপি এসব জমির মালিককে মোকর্দ্দমায় পক্ষভুক্ত না করে গোপনে মামলা পরিচালনা করে, মন্দির কমিটি একটি একতরফা রায় হাতিয়ে নেয়। রায়ের পর বিষয়টি জানতে পেরে স্থানীয়রা হাইকোর্ট বিভাগে ফার্স্ট আপীল দায়ের করেছেন। যা বর্তমানে বিচারাধীন আছে।