কুমিল্লার মুরাদনগরে অবৈধ ড্রেজার দিয়ে চলছে মাটি কাটার মহোৎসব। এতে বিলীন হচ্ছে উপজেলার তিন ফসলি জমি। উপজেলার ২২টি ইউনিয়নে দুই শতাধিক ড্রেজার দিয়ে প্রতিনিয়ত কৃষি জমি থেকে মাটি উত্তোলন করছে স্থানীয় কিছ প্রভাবশালী চক্র। ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় অর্ধ শতাধিক জমির মালিক সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বরাবর অভিযোগ করে নিরুপায় হয়ে তারা এখন ড্রেজার ব্যবসায়ী চক্রের কাছে জিম্মি।
জানা গেছে, প্রথমে একটি জমিতে ড্রেজার বসিয়ে মাটি কেটে গর্ত করে পরবর্তীতে পার্শ্ববর্তী সকল জমি মালিকদের জিম্মি করে কম দামে জমি বিক্রিতে বাধ্য করে চক্রটি। অভিযোগের প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা অভিযানে বের হলে ঘটনাস্থলে পৌঁছার আগেই টের পেয়ে যায় ড্রেজার ব্যবসায়ীরা। ফলে ঘটনাস্থলে গিয়ে তাদেরকে পাওয়া যায় না। অভিযান শেষে ফিরে যাওয়ার ঘন্টা পার না হতেই আবারো পুরো দমে চলে মাটি উত্তোলন। ফলে স্থানীয়দের মুখে এখন একটাই শব্দ অভিযান কি শুধু লোক দেখানো!
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলার ৩১২টি গ্রামের মধ্যে প্রায় দুই শতাধিক গ্রামের কোন না কোন স্থানে ড্রেজার মেশিন চলছে। মাইলের পর মাইল পাইপ সংযোগ দিয়ে ড্রেজিংয়ের মাটি দিয়ে কোথাও ফসলি জমি আবার কোথাও বা পুকুর ভরাট করা হচ্ছে। বর্তমানে অবৈধ ড্রেজিংয়ের কারণে ৫০-৬০ ফুট গভীর থেকে মাটি ও বালি উত্তোলনের ফলে আশ-পাশের তিন ফসলের জমিগুলো পরিণত হচ্ছে কূপে।
উপজেলার দারোরা ইউনিয়নের কাজিয়াতল গ্রামের সুরুজ মিয়া, মফিজ মিয়া, আবুল কাশেমসহ বেশ কয়েকজন কৃষক বলেন, প্রশাসনের লোকজন আসার আগেই কিভাবে যেন তারা টের পায়। পরে মেশিনপত্র বন্ধ করে চলে যায়। পরক্ষণে প্রশাসনের লোকজন চলে গেলে তারা আবারো মাটি কাটার উৎসবে মেতে ওঠে। শুনেছি সবাই নাকি থানা ও ভূমি অফিসের লোকজনেরে টাকা দিয়ে ড্রেজার চালায়।
তারা আরো বলেন, দারোরা ইউনিয়নের মধ্যেই প্রায় ২০টি ড্রেজার বসিয়ে মাটি কাটার কারনে তাদের তিন ফসলী জমি ড্রেজিং গর্তে বিলীন হয়ে গেছে। কেউ ইচ্ছা করে জমি দিতে না চাইলেও শেষ পর্যন্ত ড্রেজার মালিকদের কাছে কম দামে জমি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় সাধারণ কৃষক। ড্রেজার সিন্ডিকেটরা জমির মালিকদের বিভিন্ন ভাবে হুমকি-ধমকি দিয়ে জিম্মি করে রাখে এবং রাজনৈতিক নেতাদের নাম ভংগায়।
ড্রেজার ব্যবসায়ী মনির ও আজিজ বলেন, ‘সবাই মনে করে আমরা ড্রেজার চালাইয়া কত টাকা জানি কামাইতাছি। আসলে প্রতি মাসে থানায় দিতে হয় ৬ হাজার টাকা। অপরদিকে ভূমি অফিসের লোকজন আসলেই তাদেরকে দিতে হয় টাকা। সব মিলিয়ে নানান জায়গায় টাকা দিয়ে আমাদের বেশি একটা লাভ হয় না।’
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, উপজেলায় চাষাবাদযোগ্য জমির পরিমান ২৪ হাজার ২৯৩ হেক্টর। এর মধ্যে বেশির ভাগই দুই থেকে তিন ফসলি জমি। অথচ সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বিলের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত অনাবাদী রয়েছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাইন উদ্দিন আহম্মেদ সোহাগ বলেন, আমি উদ্ধিগ্ন ও আতংকিত। কেননা তিন ফসলি জমির উর্ভর মাটির উপরের অংশ ব্যাপক হারে কেটে নিচ্ছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ৬ মাসের মধ্যে চাষাবাদের জন্য একখন্ড জমি থাকবে না। অথচ প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে কড়া ভাবে নিষেধাজ্ঞা আছে জমির মাটি কেটে নিয়ে অন্য কোন কাজে ব্যবহার করা যাবে না।
ওসি আবুল হাসিম বলেন, ‘আমি এই থানায় এসেছি মাত্র কয়েকদিন হয়। ড্রেজার থেকে টাকা নেওয়ার বিষয়টি আমার জানা নেই। আমি আসার পূর্বে যদি কেউ নিয়ে থাকে আমি তারও খোঁজ খবর নিচ্ছি যদি প্রমাণ পাই তাহলে অবশ্যই সেই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আমি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে এসব অবৈধ ড্রেজার বন্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।’
উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সুমাইয়া মমিন বলেন, ভূমি অফিসের কোন কর্মকর্তা ড্রেজার ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে এ বিষয়টি আমার জানা নেই। যদি কারও বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ পাই, তাহলে অবশ্যই ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। অবৈধ ড্রেজার বন্ধে আমাদের অভিযান সবসময় অব্যাহত রয়েছে বলে জানান তিনি।