ঢাকা, শুক্রবার ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১

রাজধানীতে দেদার চলছে ফিটনেসবিহীন বাস, দায় কার?

নিজস্ব প্রতিবেদক: | প্রকাশের সময় : বুধবার ৫ জুলাই ২০২৩ ০১:২৪:০০ অপরাহ্ন | জাতীয়

 

 

রাজধানীতে চলাচলকারী গণপরিবহনের একটি বড় অংশেরই ফিটনেস নেই। লক্কড়-ঝক্কড় এসব বাসের কোনোটার জানালার কাঁচ ভাঙা, কোনটার সিট ভাঙা, নেই সিট কভার, সব মিলিয়ে বাসের ভেতরে নোংরা পরিবেশ। কোনও বাসের হয়তো মূল বডিই ভাঙাচোরা, কিংবা ব্রেক লাইট বা ইন্ডিকেটর লাইট ভাঙা। রাজধানীতে ফিটনেসবিহীন এই রুগ্ন বাস দিয়েই চলছে যাত্রীসেবা।

 

সরেজমিনে ঘুরে রাজধানীর কয়েকটি রুটে চলাচলকারী বাসের এমন হাল দেখা যায়। যাত্রীরা বলছেন, বাধ্য হয়েই নোংরা ও লক্কর-ঝক্কর বাসে চড়তে হচ্ছে তাদের। এতে প্রতিনিয়ত তাদের বিভিন্ন ধরনের ভোগান্তিতেও পড়তে হচ্ছে। কিন্তু উপায়ন্তর না পেয়েই তাদেরকে এসব বাসে যাতায়াত করতে হচ্ছে। এসব বিষয় কারও অজানা নয়, কিন্তু কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় পরিত্রাণ মিলছে না কিছুতেই।

 

 

্ষংয়ঁড়;অগো চলার পারমিট নাই, তাও ঘুষ দিয়া চল্ৎেংয়ঁড়;

‘অগো চলার পারমিট নাই, তাও ঘুষ দিয়া চলে’

 

রাজধানীর গাবতলী থেকে রায়ের বাজার, হাজারীবাগ হয়ে বাবুবাজার পর্যন্ত চলাচল করে প্রত্যয় ট্রান্সপোর্ট লিমিটেডের বাস। প্রত্যয়ের রুট নম্বর এ-২৮৯। এই পরিবহনের প্রায় প্রতিটি বাসই ভাঙাচোরা। ভেতরের পরিবেশ যেমন নোংরা, তেমনই নেই জানালার গ্লাস ও  সিট কভার।

 

বাসের এমন দুরবস্থার বিষয়ে কথা হয় প্রত্যয় বাসের সুপারভাইজার নাসির শেখের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমাদের বাস সবই মোটামুটি ভালো। কয়েকটা একটু ভাঙা। মালিককে বলেছি, ঠিক করে দিতে, কিন্তু মালিক বলেছেন— এখন নাকি হাতে টাকা নাই। টাকা পেলে ঠিক করে দেবেন। আর এই রাস্তায় ধুলোবালি বেশি, তাই তাড়াতাড়ি বাসগুলো নোংরা হয়ে যায়।’

 

প্রত্যয় বাসের চালক মো. রাসেল বলেন, ‘আমাদের বাস ঠিক করলেও ঠিক থাকে না। এক বাস আরেক বাসরে মাইরা দেয়। এ রকমই চলতে থাকে। এর মধ্যে রাস্তায় অটো (ব্যাটারি চালিত রিকশা) চইলা আরও ঝামেলা লাগায়। অগো চলার পারমিট নাই, তাও ঘুষ দিয়া চলে। অগো লাইগা আমরা যাত্রী পাই না। তাই জায়গায় জায়গায় দাঁড়াই, ফলে আরেক বাসের লগে ধাক্কা লাগে। আমাগো গাড়ি চালাইতে অনেক সমস্যা হয়।’

 

অনেক বাসের জানালার কাঁচ ভাঙা। এতে রোদ, ধুলো আর বৃষ্টিতে ভোগান্তিতে পড়ে যাত্রীরা

অনেক বাসের জানালার কাঁচ ভাঙা। এতে রোদ, ধুলো আর বৃষ্টিতে ভোগান্তিতে পড়ে যাত্রীরা

বাস নোংরা ও সিট কভার নেই কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই রাস্তায় অনেক ধুলা তাই ময়লা হইয়া যায়। আর  কভার পুরান হইয়া গেছে, তাই ফালায় দিছি। মহাজনরে কইছি, নতুন কভার বানাইতে দিছেন। কয়েকদিন পরই নতুন কভার লাগায় দেবো।’

 

সাভার ইপিজেড থেকে গাবতলী, ফার্মগেট, শাহবাগ হয়ে লিংকরোড পর্যন্ত চলাচল করে ‘গাবতলী এক্সপ্রেস’ নামের বাস (রুট নম্বর এ- ১৮৮/১৯০)। এই বাসের হালচালও প্রায় একই। অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ, আয়তনেও ছোট। তার ওপরে ‘গাবতলী এক্সপ্রেস’ এর বাসে ঠিকভাবে বসতে পারেন না যাত্রীরা। নির্দিষ্ট সংখ্যার চেয়ে বসানো হয়েছে অতিরিক্ত সিট। এই কোম্পানির অনেক বাসেরই জানালার কাঁচ ভাঙা। এতে করে রোদ, ধুলো আর বৃষ্টিতে ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রীরা।

 

গাবতলী এক্সপ্রেসের এক সহকারী বলেন, ‘আমগো লোকাল বাস। লোকাল বাসের সিট এমন নোংরাই থাকে। নতুন কভার লাগাইলে যাত্রীরা টানতে টানতে ছিড়া ফালায়। মালিকরে নতুন কভার লাগাতে কইলে শুনে না।’

 

গাদাগাদি করে এত মানুষ তোলা হয় যে, দাঁড়ানোর মতো জায়গা থাকে না

গাদাগাদি করে এত মানুষ তোলা হয় যে, দাঁড়ানোর মতো জায়গা থাকে না

ভিক্টর ক্লাসিক বাসটি চলাচল করে রাজধানীর সদরঘাট থেকে আশুলিয়া থানান বাইপাইল পর্যন্ত। এর রুট নম্বর এ/৪৩৬। এই কোম্পানির কিছু বাস ভালো অবস্থায় থাকলেও বেশিরভাগই ভাঙাচোরা, অপরিচ্ছন্ন, ব্রেক লাইট নেই, নগরজুড়ে ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে কালো ধোঁয়া।

 

এছাড়া রাজধানীতে বিভিন্ন কোম্পানির বিভিন্ন রুটে ভাঙাচোরা বাস দিয়েই চলছে যাত্রীসেবা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য শিকড় পরিবহন সার্ভিস লিমিটেড (মিরপুর ১২ থেকে যাত্রাবাড়ী), আকাশ এন্টারপ্রাইজ (কদমতলী- দিয়াবাড়ী) আজমেরী গ্লোরী (সদরঘাট-চন্দ্রা), তানজিল পরিবহন (চিড়িয়াখানা-সদরঘাট)।

 

১৫ বছর ধরে বাস চালান মো. রকি। তানজিল বাসের ড্রাইভার হিসেবে আছেন ৬ বছর। তিনি বলেন, ‘বাসের বডিতে কোনও সমস্যা নাই। খালি সিট কভার ময়লা হইয়া যায়, আর ছিঁড়ে যায়। মালিকরে বলি, মালিক কয় আজকে দিমু কালকে দিমু। কিন্তু আর দেয় না।’

 

পুরানা পল্টন মোড়ে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের এএসআই  মনজুর কাদের  বলেন, ‘এই বাসগুলো ধাক্কাধাক্কি করে বডি নষ্ট করে ফেলে। কিন্তু অনেক বাসই রাস্তায় নতুন নামায়। আসলে বাসের ড্রাইভাররা কোনও নিয়ম মানে না। অনেক সময় তারা ট্রাফিক আইন মানে না। কত যে মামলা দেই, তার হিসাব নাই। তবুও এরা ঠিক হয় না। নিয়মে আসে না।’

 

ভাঙা জানালা জোড়া দিয়ে দিব্যি চলছে নগরজুড়ে

ভাঙা জানালা জোড়া দিয়ে দিব্যি চলছে নগরজুড়ে

গাবতলী এক্সপ্রেস বাসের যাত্রী মো. আরিফ বলেন, ‘আমার অফিস গ্রিন রোডে। বিভিন্ন বাসে যাতায়াত করি। কিন্তু এই বাসের অবস্থা খুবই খারাপ। সকালে অফিস টাইমে গাদাগাদি করে এত মানুষ তোলা হয় যে, দাঁড়ানোর মতো জায়গা থাকে না। এই বাসের হাইটও কম, দাঁড়ালে মাথায় লাগে। আবার সিটে বসলে ঠিক মতো পা রাখা যায় না।’

 

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন সুকান্ত। অফিসে যাতায়াতের জন্য তাকে নিত্য গণপরিবহন ব্যবহার করতে হয়। গণপরিবহনে চড়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাকে প্রতিনিয়তই যাতায়াতের জন্য বাসে চড়তে হয়। এ কারণে প্রতি দিনই ভোগান্তিতে পড়তে হয়। এমনিতেই অফিস টাইমে প্রচণ্ড ভিড় থাকে। তার ওপরে গাবতলী এক্সপ্রেস-এর  অবস্থাও ভালো না। ভেতরে সিটগুলো নোংরা, জানালার গ্লাস থাকে না। বৃষ্টি আসলে ভিজতে হয়।’

 

তিনি আরও বলেন, ‘আবার অন্য বাসের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে ধাক্কা লাগিয়ে দেয়। এতে দরজার পাশে যে হ্যান্ডেল থাকে, সেটা চ্যাপ্টা হয়ে যায়। তাই দ্রুত বাসে ওঠার সময় সমস্যা হয়। আমি একবার দ্রুত উঠতে গিয়ে এ রকম হ্যান্ডেল থাকায়, ধরতে না পারায় রাস্তায় পড়ে গিয়েছিলাম।’

 

রাজধানীতে চলাচলকারী বাসগুলোর এই বেহাল দশা দেখার যেন কেউ নেই। এ জন্য যাত্রীরা দুষছেন বাস চালক ও শ্রমিকদের। আর চালক-শ্রমিকরা বলছেন, মালিকদের লোভের কারণে তারা যাত্রীদের কাঙ্ক্ষিত সেবা দিতে পারছেন না। তবে মালিকরা তাদের দায় অস্বীকার না করলেও দুষছেন নগর পরিবহন পরিস্থিতিকে। সবাই বিআরটিএ’র ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন এবং সংস্থাটির উদাসীনতাকেই দায়ী করছেন।

 

ফিটনেসবিহীন যানবাহন কীভাবে চলছে, সেটি দেখার প্রধান দায়িত্ব পুলিশের

ফিটনেসবিহীন যানবাহন কীভাবে চলছে, সেটি দেখার প্রধান দায়িত্ব পুলিশের

তাহলে কর্তৃপক্ষ কী করে

অভিযোগ আছে, গণপরিবহনের নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে বিআরটিএ অভিযানে নামলেই বেকে বসেন গণপরিবহনের মালিক ও শ্রমিকরা। বিশেষ করে ভ্রাম্যমাণ আদালত মাঠে নামলেই হঠাৎ সড়কে বাস নামানো কমিয়ে দেন তারা। সেই সঙ্গে বিআরটিএ’র অভিযানের কার্যকারিতা নিয়েও নানা অভিযোগ করতে দেখা যায়।

 

এ বিষয়ে বিআরটিএ’র পরিচালক (রোড সেফটি) মাহবুব-ই-রব্বানী  বলেন, ‘নতুন আইন অনুযায়ী সড়কে নিয়মিত অভিযান, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হয়। আমরা ফিটনেসবিহীন গাড়ি বন্ধে কাজ করে যাচ্ছি, বসে নেই। ফিটনেসবিহীন যানবাহন কীভাবে চলছে, সেটি দেখার প্রধান দায়িত্ব পুলিশের।’

 

রমনা ট্রাফিক বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার জয়দেব চৌধুরী  বলেন, ‘যানবাহনের ফিটনেস সনদ দেয় বিআরটিএ। এটি তো আমরা দেই না। আমরা নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে অভিযান চালিয়ে থাকি। সনদ ছাড়া ফিটনেসবিহীন গাড়ি পেলে ডাম্পিং করা হয়, মামলা দেওয়া হয়।’