ঢাকা, সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১১ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১

রাষ্ট্রপতির বিদায় ঘন্টা

আহমেদ শাহেদ | প্রকাশের সময় : বুধবার ২৩ অক্টোবর ২০২৪ ০১:১২:০০ পূর্বাহ্ন | রাজনীতি

দেশের রাজনীতিতে চরম উত্তেজনা। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন আরও বেগবান হচ্ছে। ছাত্র-জনতার বিশাল সমাবেশে উত্তপ্ত স্লোগান আর দাবির মুখে উঠে এসেছে নতুন এক আল্টিমেটাম ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রাষ্ট্রপতিকে পদত্যাগ করতে হবে। রাজধানীর বঙ্গভবনের সামনে মঙ্গলবার (২২ অক্টোবর) বিকেল সাড়ে ৪টায় অনুষ্ঠিত এক বিশাল কর্মসূচি থেকে এই আল্টিমেটাম দেওয়া হয়। আন্দোলনকারীরা স্পষ্ট করে জানান, যদি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ না করেন, তাহলে তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ হবে দুর্বার আন্দোলন, যা তাকে পদ থেকে সরানোর দিকে নিয়ে যাবে।

সমাবেশে উপস্থিত ছাত্র-জনতা সরকারের ওপর চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তাদের অভিযোগ, বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন সরাসরি আওয়ামী লীগ সরকারের সমর্থনে কাজ করছেন এবং দেশের জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। একজন আন্দোলনকারী দৃপ্ত কণ্ঠে বলেন, "আমরা তাকে চাই না। তার কোনো অধিকার নেই রাষ্ট্রপতির পদে থাকার। তিনি শেখ হাসিনার দোসর, তাই আমরা তাকে এই পদ থেকে সরাতে চাই। আমরা ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছি। যদি তিনি পদত্যাগ না করেন, আমরা জানি তাকে কীভাবে সরাতে হয়।"

এই সমাবেশে কয়েক হাজার ছাত্র, যুবক, এবং সাধারণ মানুষ অংশগ্রহণ করে। বক্তারা আরও বলেন, "রাষ্ট্রপতি জনগণের পক্ষে দাঁড়াতে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি ক্ষমতাসীনদের অনুগত হয়ে গেছেন, যার ফলে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারছেন না। তার এই অবস্থান দেশের গণতন্ত্রের জন্য হুমকি।"

এই আল্টিমেটামের পেছনে রয়েছে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির দীর্ঘদিনের উত্তেজনা। চলমান ছাত্র-জনতার আন্দোলন, সরকারি নিয়োগের অনিয়ম, দুর্নীতি, এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে জোরালো আন্দোলন গত কয়েক মাস ধরে চলে আসছে। এরই মধ্যে রাষ্ট্রপতির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আন্দোলনকারীরা মনে করছেন, রাষ্ট্রপতি তার নিরপেক্ষতার ভূমিকা ভুলে গিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে একাত্ম হয়ে কাজ করছেন।

 বক্তারা আরও বলেন, "আমাদের দাবি একটাই—রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনকে পদত্যাগ করতে হবে। দেশের মানুষ তার ওপর আস্থা হারিয়েছে। আমরা রাষ্ট্রপতির পদে একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে চাই, যিনি জনগণের পক্ষে কাজ করবেন, সরকারের নয়।"

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই আন্দোলন শুধুমাত্র একটি ছাত্র-জনতার ক্ষোভ নয়, বরং এটি দেশজুড়ে জমে থাকা রাজনৈতিক অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ। এই আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন, পেশাজীবী, এবং সাধারণ জনগণও একাত্মতা প্রকাশ করছে। তাদের মতে, এই আন্দোলন আগামী দিনে আরও বিস্তৃত আকার ধারণ করতে পারে এবং সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপ নিতে পারে।

বঙ্গভবনের সামনে যখন উত্তাল জনতার ঢল, তখন ভেতরে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এ বিষয়ে কী ভাবছেন, তা এখনও পরিষ্কার নয়। বঙ্গভবন থেকে এখনও আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তবে রাজনৈতিক অঙ্গনে গুঞ্জন চলছে, সরকার ও রাষ্ট্রপতি উভয়ই এই পরিস্থিতিকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। কিছু সূত্র জানিয়েছে, রাষ্ট্রপতির কার্যালয় থেকে নীরবে আলোচনা চলছে, পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেওয়া যায় তা নিয়ে।

এই আল্টিমেটাম কার্যকর হবে কিনা, তা নির্ভর করছে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার ওপর। তবে আন্দোলনকারীদের হুঁশিয়ারি, যদি রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ না করেন, তাহলে তারা আরও কঠোর কর্মসূচির পথে যাবে। জনতার দাবি স্পষ্ট—রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ। তাদের কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে, "আমরা প্রস্তুত। যদি আমাদের দাবি মানা না হয়, তবে এই আন্দোলন দেশের প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে পড়বে।"

কিছু বিশ্লেষক মনে করছেন, রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবি শুধু প্রতীকী নয়, বরং এটি সরকারের ওপর আরও চাপ সৃষ্টি করার একটি কৌশল। রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ হলে বর্তমান সরকার দুর্বল হয়ে পড়বে, যা বিরোধী শক্তির জন্য একটি বড় সুযোগ তৈরি করবে। অন্যদিকে, কিছু বিশ্লেষক মনে করছেন, রাষ্ট্রপতি যদি পদত্যাগ না করেন এবং আন্দোলন আরও তীব্র হয়, তাহলে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনিশ্চয়তার দিকে যেতে পারে।

 আন্দোলনকারীরা দাবি করেছে, রাষ্ট্রপতি যদি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পদত্যাগ না করেন, তবে তারা দেশব্যাপী দুর্বার আন্দোলনের ডাক দেবে। তারা আরও সতর্ক করে দিয়েছে, "এবারের আন্দোলন শুধু একটি দাবি আদায়ের জন্য নয়, এটি দেশের ভবিষ্যত নির্ধারণ করবে।"

বর্তমান প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবি নিয়ে রাজনৈতিক মহলে যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে, তা থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট- আগামী কিছুদিন দেশের রাজনীতি আরও তীব্র ও জটিল হতে চলেছে।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র ইস্যুতে রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিনের মন্তব্যের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারীদের অনেকেই তার বিদায় চাইলেও আইন ও সংবিধান অনুযায়ী তাকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার সুযোগ আছে কি না, সেই প্রশ্ন ওঠেছে। একই সঙ্গে তারা অবশ্য বলছেন, গণঅভ্যুত্থানের পর ‘আইন ও সংবিধানের’ বিষয়টিই গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। ফলে ‘জনআকাঙ্ক্ষার' আলোকে রাষ্ট্রপতিকে সরিয়ে অন্য কাউকে সে পদে বসাতে চাইলেও’ সেটি অসম্ভবও কিছু নয়। যদিও সরকার পরিবর্তনের পর দেশের সংবিধান স্থগিত করা হয়নি।

অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী রাষ্ট্রপতির তীব্র সমালোচনা করলেও ‘তার পদত্যাগ কিংবা অপসারণের’ দাবির প্রশ্নে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। বিএনপি দলীয়ভাবে সিনিয়র নেতাদের এ বিষয়ে বিচ্ছিন্নভাবে মন্তব্য না করার পরামর্শ দিয়েছে আর জামায়াতে ইসলামী শুধু বলেছে ‘রাষ্ট্রপতি অসত্য বক্তব্য দিয়ে ওই পদে থাকার অধিকার হারিয়েছেন’। যদিও উভয় দলের নেতাদের কাছে বিবিসির প্রশ্ন ছিল যে, ‘রাষ্ট্রপতি সরে যাক এটি তারা চান কি-না’।

প্রসঙ্গত, দৈনিক মানব জমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী তার লেখা এক রিপোর্টে উল্লেখ করেছেন যে, রাষ্ট্রপতি তাকে বলেছেন ‘শেখ হাসিনার পদত্যাগের কোনো দালিলিক প্রমাণ তার হাতে নেই’।

তার এ বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করে রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে মিথ্যাচারের অভিযোগ এনেছেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন জায়গায় মিছিল-সমাবেশ করে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ দাবি করেছেন তারা।

সামাজিক মাধ্যমে অন্তর্র্বতী সরকার সমর্থক ও আওয়ামী লীগ বিরোধীরা রাষ্ট্রপতির তীব্র সমালোচনা করে তার পদত্যাগ কিংবা তাকে সরিয়ে দেওয়ার দাবি জানাচ্ছে।

গত ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর প্রথমে সেনাপ্রধান ও পরে রাষ্ট্রপতি জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন এবং তিনি তা গ্রহণ করেছেন বলে জানিয়েছিলেন।

সোমবারের বিতর্কের পর বঙ্গভবন থেকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলা হয়েছে -'মীমাংসিত বিষয়ে নতুন করে কোনো বিতর্ক সৃষ্টি না করার জন্য,' রাষ্ট্রপতি সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

এখানে বলে রাখা দরকার, বাংলাদেশে অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপ্রধান হওয়া কিংবা বিদায় নেওয়ার ঘটনা নতুন কিছু নয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার ঘটনার পর নিজেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। ওই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত সেনা কর্মকর্তাদের সমর্থন নিয়ে ১৯৭৫ সালের ২০ আগস্ট খন্দকার মোশতাক সামরিক আইন জারি করে নিজেই প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব নিলেন। ‌এরপর তিনি নিজেই নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেছিলেন।

৩ নভেম্বরের সামরিক অভ্যুত্থানের মুখে খন্দকার মোশতাক আহমদ ৫ নভেম্বর রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। সেদিনই সামরিক অফিসারদের অনুরোধে নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি আবুসাদাত মোহাম্মদ সায়েম।

১৯৭৭ সালের ২১ প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জিয়াউর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে পদত্যাগ করেন বিচারপতি সায়েম।

অন্যদিকে প্রবল গণআন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন সাবেক সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ওইদিন প্রথমে পদত্যাগ করেছিলেন তখনকার ভাইস প্রেসিডেন্ট মওদুদ আহমদ। এরপর জেনারেল এরশাদ বিচারপতি শাহাবুদ্দিনকে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ করেন এবং নিজে পদত্যাগ করেন। এরপর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হন বিচারপতি শাহাবুদ্দিন।

রাষ্ট্রপতিকে কি সরিয়ে দেওয়া সম্ভব?

বিদ্যমান নিয়ম অনুযায়ী সংসদ রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসন করতে পারে। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের পর সংসদ বাতিল করে দেওয়ায় সেই সুযোগ আর নেই। আবার রাষ্ট্রপতি চাইলে স্পিকারের কাছে পদত্যাগ করতে পারেন। কিন্তু স্পিকার পদত্যাগ করেছেন এবং ডেপুটি স্পিকার কারাগারে থাকায় সেটিও সম্ভব হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ইস্যুতে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ বা অপসারণের দাবি উঠলেও সেটি সংবিধান অনুযায়ী হওয়া সম্ভব নয় বলেই মনে করেন সিনিয়র আইনজীবী শাহদীন মালিক।

‘রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করতে পারে সংসদ। কিন্তু সেটি বাতিল করা হয়েছে। আবার তার পদত্যাগেরও সুযোগ নেই । সে কারণে সংবিধান ও আইনগতভাবে তাকে সরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। তবে স্বৈরাচারী সরকারের বিদায়ের পর সবকিছু তো সংবিধান অনুযায়ী হচ্ছে না। তাই নিয়ম বা সংবিধানের প্রশ্ন অবান্তর। বরং জনআকাঙ্ক্ষার আলোকে তাকে সরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা সরকার চাইলে করতেই পারে,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

এখানে বলে রাখা ভালো, বর্তমান অন্তর্র্বতী সরকার ক্ষমতায় আসার পর সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ, নির্বাচন কমিশন ও পাবলিক সার্ভিস কমিশন থেকে অনেকেই পদত্যাগ করেছেন। ‘আন্দোলনের সাথে ছিলেন না কিংবা বিদায়ী সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে অনেককেই তো সরকার সরে যেতে বলেছে। সেসব ক্ষেত্রে তো সংবিধান দেখা হয়নি। সুতরাং রাষ্ট্রপতির ক্ষেত্রেও তা হতে পারে,’ বলছিলেন শাহদীন মালিক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলছেন, গণঅভ্যুত্থানের পর সবকিছুই বাতিল করা যেত, কিন্তু তা না করে কোনোটি বাদ দেওয়া হয়েছে- আবার কোনোটি রাখা হয়েছে বলেই এই জটিল পরিস্থিতি সামনে এসেছে।

‘সংবিধান স্থগিত করা হয়নি। কিন্তু আবার সেটি পুরোপুরি অনুসরণও করা হচ্ছে না। সব মিলিয়ে একটি লিগ্যাল অ্যানার্কি বা আইনি নৈরাজ্য তৈরি হয়েছে। এর ফলে হয়তো অনেক কিছুই করতে হচ্ছে, যা নিয়ম মেনে হবে না,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

তিনি বলছেন, প্রেসিডেন্ট নিজেই বর্তমান সরকারকে শপথ করিয়েছেন। সরকার তাকে সংসদ ছাড়া অভিশংসন করলে বা বাদ দিলে এখন হয়তো কেউ কিছু বলবে না, কিন্তু ভবিষ্যতে তো আইনি প্রক্রিয়া নিয়ে কথা উঠতে পারে। ‘অভ্যুত্থানের পরপরই আন্দোলনকারী সব দল, শ্রেণি ও পেশার প্রতিনিধি নিয়ে আলোচনার ভিত্তিতে আগের সব বাতিল করলে এখনকার সংকটের তৈরি হতো না। তখন রাষ্ট্রপতিকে পরিবর্তন করলেও বলা যেত যে, জরুরি পরিস্থিতিতে জনগণের ম্যান্ডেট অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে,’ বলছিলেন তিনি।

এই বিষয়ে 'রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন' নামে একটি সংগঠনের প্রধান সমন্বয়ক ও সিনিয়র আইনজীবী হাসনাত কাইয়ুম বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলেছিলেন, ‘এখন অস্বাভাবিক সরকার কাজ করছে, তাই সংবিধানের মাঝ দিয়ে বৈধতা অবৈধতা সাংবিধানিক পদ্ধতিতে খুঁজে পাওয়া কঠিন।’

‘তবে সেটাও তারা কাভার করার জন্য আপিল বিভাগ থেকে একটি রেফারেন্স (প্রাসঙ্গিক মতামত বা সুপারিশ) করে নিয়ে আসছে। এখন পর্যন্ত তারা সংবিধানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণভাবে চলার চেষ্টা করছেন। যা সঙ্গতিপূর্ণ না, সেগুলো রেফারেন্সের মাধ্যমে। তাই, অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের এই রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের পদ্ধতি কী হবে, সেটার জন্য তাদেরকে এখন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ থেকে রেফারেন্স নিতে হবে।’

‘সেই রেফারেন্স অনুয়ায়ী তারা একজনকে বাদ বা নতুন একজনকে নিয়োগ দিতে পারেন। বিদ্যমান আইনি কাঠামোয় এছাড়া আর কোনো ব্যবস্থা নাই,’ তিনি যোগ করেন।

শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে রাষ্ট্রপতির বক্তব্য প্রকাশের পরপরই তীব্র শোরগোল ও আইন উপদেষ্টার কঠোর সমালোচনার পরেও রাজনৈতিক দলগুলো- বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াত সতর্ক অবস্থান নিয়েছে।

গতকালই এক অনুষ্ঠানে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ‘শিক্ষাজীবনে ছাত্রলীগ করা রাষ্ট্রপতি পলাতক শেখ হাসিনাকে পুনর্বাসিত করার চেষ্টা করছেন।’ তবে এ বিষয়ে মঙ্গলবার বিবিসির পক্ষ থেকে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির দুই জন সদস্যের মতামত নেওয়া হলেও পরে তারা দুজনই ফোন করে জানান যে, তাদের এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য না করার জন্য দলীয় হাইকমান্ড থেকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

তবে দলটির বিভিন্ন পর্যায়ে আরও কয়েকজন নেতার সাথে আলোচনা করে যে ধারণা পাওয়া গেছে, তাতে বিএনপি আসলে বোঝার চেষ্টা করছে যে, রাষ্ট্রপতি এ মন্তব্যের ক্ষেত্রে ‘কতটা সিরিয়াস’ ছিলেন। অর্থাৎ তিনি কি তথ্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন নাকি সরকারকে কোনো ধরনের সংকটে ফেলার চিন্তা থেকে এমন মন্তব্য করেছেন।

আবার দলের একটি অংশ বোঝার চেষ্টা করছে রাষ্ট্রপতির ওই মন্তব্য ‘অন্য কারও প্ররোচনায় হয়েছে কি না’। তবে ‘অন্য কারও’ বলতে কাদের বোঝানো হচ্ছে এমন প্রশ্নের কোনো সরাসরি উত্তর মেলেনি।

যদিও দলটির কোনো কোনো নেতা মনে করেন, সরকারের মধ্যেই একটি অংশ আছে যারা ‘দ্রুত গণতন্ত্রে উত্তরণ বা রাজনৈতিক সরকার আসার পথ সুগম’ করতে অনুৎসাহী। রাষ্ট্রপতির মন্তব্যের ক্ষেত্রে তাদের কোনো ভূমিকা আছে কি-না তা নিয়েও আলোচনা আছে দলের মধ্যে।

‘চাইলে তো রাষ্ট্রপতিকে সরিয়ে যে কাউকে রাষ্ট্রপতি পদে বসিয়ে দিতে পারে। কিন্তু সেটি গণতন্ত্রে উত্তরণে কোনো ভূমিকা রাখবে কি-না সেদিকে আমাদের দৃষ্টি থাকবে। এমন কিছু করতে দেয়া যাবে না যেটি দেশকে বিরাজনীতিকরণের দিকে নিয়ে যেতে পারে,’ বলছিলেন দলটির একজন সহ-সভাপতি। তিনি তার নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করেছেন।

স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, অভ্যুত্থানের পর বিদায়ী সরকারের কারোরই বহাল থাকা উচিত নয় বলে তিনি মনে করেন। কিন্তু দলের দিক থেকে নিষেধাজ্ঞা থাকায় তিনি আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর মুখপাত্র মতিউর রহমান আকন্দ বলছেন, রাষ্ট্রপতি নিজেই বলেছিলেন যে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগপত্র তিনি পেয়েছেন আর পরে সাংবাদিকদের বলছেন পাননি। ‘এর অর্থ হলো এখন তিনি মিথ্যা বলছেন, যা শপথ ভঙ্গের নামান্তর। এর মাধ্যমে তিনি ওই পদে থাকার অধিকার হারিয়েছেন,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

তবে জামায়াতে ইসলামী বর্তমান রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ কিংবা অপসারণ চায় কি-না এমন প্রশ্নের সরাসরি জবাব দেননি তিনি।