শেরপুর জেলার পাহাড়ী জনপদে বসবাসরত আদিবাসী খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বী গারো নৃ-গোষ্টিদের রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি ও কৃষ্টি। তাদের এই সংস্কৃতির মধ্যে অন্যতম উৎসব হলো নবান্ন বা ওয়ানগালা। শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতী উপজেলার মরিয়মনগর সাধু জর্জের ধর্মপল্লীর গির্জা চত্তরে ২১ নভেম্বর রোববার দিনব্যাপী এই উৎসবের আয়োজন করা হয়। এতে প্রধান অতিথি উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রশাসক মোমিনুর রীশদ। এছাড়াও এসময় জেলা প্রশাসক পত্নী জান্নাতুল ফেরদৌসী, ঝিনাইগাতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারুক আল মাসুদ, সহকারী কমিশনার (ভূমি) জয়নাল আবেদীন প্রমূখ উপস্থিত ছিলেন।শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার সীমান্তবর্তী মরিয়মনগর খ্রিষ্টান ধর্মপল্লির নিয়ন্ত্রনে জেলার সদর উপজেলাসহ শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতী এবং জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ উপজেলার গারো সমাজের ৪৭ টি গ্রাম রয়েছে। ওইসব গ্রামের প্রায় ২২ হাজার খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বি গারো সম্প্রদায়ের লোকজনের বসবাস।
সকাল নয়টায় থক্কা অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে ওয়ানগালা অনুষ্ঠানের সূচনা করেন মরিয়মনগর ধর্মপল্লীর পালপুরোহিত ফাদার বিপুল ডেভিট দাস সিএসসি। উৎসবে ক্রুশচত্বরে বাণী পাঠ, খামালকে কুথুব পড়ানো ও থক্কা প্রদান, জনগণকে থক্কা দেয়া, পবিত্র খ্রীষ্টযাগ, দান সংগ্রহ, আলোচনা সভা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষে দেশ ও জাতির মঙ্গল কামনা করে বিশেষ প্রার্থনা করা হয়।
তাদের রীতি হলো, খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর গারোরা তাদের ঐতিহ্যবাহী সামাজিক প্রথাটি এখন ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে একত্রে পালন করা করে। অর্থাৎ একসময় তারা তাদের শস্য দেবতা মিসি সালজংকে উৎসর্গ করে ওয়ানগালা পালন করলেও এখন তারা নতুন ফসল কেটে যিশু খ্রিষ্ট বা ঈশ্বরকে উৎসর্গ করে ওয়ানগালা পালন করেন। এ সময় সামাজিক নানা আয়োজনসহ ধর্মীয় নানা আচার-অনুষ্ঠানাদিও পালন করা হয়।
ওয়ানগালা উৎসব কমিটির আহ্বায়ক মরিয়মনগর ধর্মপল্লীর পাল পুরোহিত ফাদার বিপুল ডেভিট দাস সিএসসি জানায়, একসময় গারো পাহাড়ি এলাকায় জুম চাষ হতো এবং বছরে মাত্র একটি ফসল হতো। তখন ওই জুম বা ধান ঘরে উঠানোর সময় গারোদের শস্য দেবতা ‘মিসি সালজং’ কে উৎসর্গ করে এ উৎসবের আয়োজন করা হতো। কারণ হিসেবে জানা গেছে, গারোদের ওই শস্য দেবতা একসময় পাহাড়ি এলাকার গারোদের হাতে কিছু শস্য দিয়ে বলেছিল, ‘তোমরা এটা রোপন কর তাতে তোমাদের আহারের সংস্থান হবে এবং তোমরা যে শস্য পাবে তা থেকে সামান্য কিছু শস্য আমার নামে উৎসর্গ করবে।’ এরপর থেকেই গারোরা তাদের শস্য দেবতাকে এই ফসল উৎসর্গ করে আসছে।
উল্ল্যেখ্য, শেরপুরের মরিয়ম নগরের ওয়ানগালা উৎসবটি এবার ৩৬ বছরে পা দিয়েছে। ১৯৮৫ সাল থেকে এখানে ওয়ানগালা উৎসব পালন করা হচ্ছে। গত দুই বছর কারোনার জন্য একেবারেই ঘরোয়া আয়োজনে পালিত হলেও এবার সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে একটু জাকজমক ভাবে উৎসবের আয়োজন করা হয়। জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে অসংখ্য খ্রিষ্টভক্ত এবং গারাগানজিং, কতচু, রুগা, মমিন, বাবিল, দোয়াল, মাতচি, মিগাম, চিবক, আচদং, মাতাবেং ও আরেং নামে ১২ টি গোত্রের গারো সম্প্রদায়ের লোকজন এবার ওয়ানগালা উৎসবে উপস্থিত হয়।
এদিকে ওয়ানগালা উৎসব উপলক্ষে ধর্মপল্লীর পাশে বসেছিল জমজমাট মেলা। মেলায় গারোদের ঐতিহ্যবাহী পোষাকসহ শিশুদের নানা রকমের খেলনা বিক্রি করা হয়। ফলে এখানে গারো শিশু ও যুবক-যুবতিরা বিভিন্ন পসড়ার দোকানে তাদের পছন্দের জিনিস কিনতে ভিড় জমান। ওয়ানগালা উৎসবে জেলা ও জেলার বাইরে থেকে আসা গারো সম্প্রদায়ের লোকজন এবং তাদের আত্মীয়রা একে অপরের সঙ্গে দীর্ঘদিন পর দেখা সাক্ষাত হওয়ায় তারা অনেকটা বড় দিনের উৎসবের মতো আনন্দ উপভোগ করেন।