সংবিধান অনুযায়ী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা ২০২৩ সালের শেষ দিকে। সে হিসাবে সরকারের পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ হতে বাকি রয়েছে দুই বছরের মতো। টানা তৃতীয় মেয়াদের শেষ দুই বছর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। কেননা টানা প্রায় ১৩ বছর ধরে দেশ শাসন করে আসা আওয়ামী লীগ চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় এসে নতুন কোনো ইতিহাস সৃষ্টি করতে চায়। এদিকে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে গত দুই বছর কেটেছে নানা রকম চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে। এর মধ্যে সবচেয়ে কঠিন সময় পার করেছে ২০২০-এর মার্চ থেকে ২০২১ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত। এ সময় করোনা মহামারির প্রভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে বিশ্বের উন্নত দেশগুলো। বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়ে ব্যাপকভাবে। মানুষের জীবন ও জীবিকা নিয়ে কঠিনতম সময়ে এক বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হয়েছে সরকারকে। এর পরও সরকারের নেওয়া মেগা প্রকল্প মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু, পদ্মা সেতুতে রেলসংযোগ, কর্ণফুলী টানেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ ফার্স্টট্র্যাকভুক্ত প্রকল্পগুলো সমাপ্ত করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার।
এদিকে করোনার প্রভাবে আয় ব্যাপকভাবে কমে গেলেও এসব প্রকল্পের ব্যয় সংস্থানের ক্ষেত্রে সরকার কোনো কমতি রাখেনি। বাজেট বরাদ্দের পাশাপাশি বৈদেশিক অর্থায়নও প্রায় স্বাভাবিক রেখেছে। এরই ধারাবাহিকতায় কর্ণফুলী টানেল, পদ্মা সেতু, পদ্মা সেতুতে রেলসংযোগ প্রকল্প ও মেট্রোরেল লাইন-৬ প্রকল্প এ বছরের মধ্যেই খুলে দেওয়া হবে যান চলাচলের জন্য। এসব প্রকল্প সঠিক সময়ে শেষ করতে পারলে রীতিমতো সরকারের জন্য বিরাট এক মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে। পাশাপাশি এ সময় দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখা, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের চাকা গতিশীল রাখাও সরকারের জন্য বিরাট এক চ্যালেঞ্জ। শুধু তা-ই নয়, পণ্যমূল্য স্বাভাবিক ও বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশ যে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে প্রবেশ করছে এটাকে চূড়ান্ত অবস্থানে নিয়ে যাওয়াও এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। এদিকে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বলছে, গত এক বছরে বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে ৩১ শতাংশ। এ বছর খাদ্যপণ্যের দাম যতটা বেড়েছে, গত এক দশকে আন্তর্জাতিক বাজারে দর বৃদ্ধির হিসাবে তা সর্বোচ্চ। এর কারণ হিসেবে করোনা মহামারির পাশাপাশি সর্ববৃহৎ কৃষির দেশ কানাডাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারেও অব্যাহতভাবে বাড়ছে পণ্যমূল্য। এ ছাড়া বিশ্ববাজারের সঙ্গে তাল মেলাতে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। ইতোমধ্যে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। শেষ মেয়াদে এসে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে নতুন করে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে। এমনিতেই নিম্ন ও মধ্যআয়ের মানুষ চরম ভোগান্তির মধ্যে দিন পার করছেন। ফলে সামনের দিনগুলোতে জীবন-জীবিকা স্বাভাবিক রাখাও একটা বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সামনে।
অর্থনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকরা আশঙ্কা করছেন, আগামী মাসগুলোতে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিফলন পাওয়া যেতে পারে। এমনিতে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়ছে টানা কয়েক মাস ধরে। ফলে সংকটে পড়েছেন মধ্য ও নিম্নআয়ের মানুষ। এদিকে স্পেন, আয়ারল্যান্ড ও সুইডেনে ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি থাকায় দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংক সতর্ক অবস্থানে আছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতেও মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়ছে। এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক হয়নি। অর্থনীতি কিছুটা পুনরুদ্ধার হয়েছে। এখনো বিপুলসংখ্যক মানুষ কর্মহীন। এরই মধ্যে নতুন ভ্যারিয়েন্ট দেখা দিয়েছে, যার প্রভাব পড়ছে বিশ্ব অর্থনীতিতে। ফলে এই ভ্যারিয়েন্টের ভয়াবহতা কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা হয়তো এখনই বলা মুশকিল। সরকারের হাতে আর দুই বছরের সময় রয়েছে। এ সময়ের মধ্যে সরকারকে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে বলে তিনি মনে করেন। এর মধ্যে একদিকে অর্থনীতির গতি স্বাভাবিক রাখা, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের গতি ধরে রাখা এবং সর্বোপরি সুষ্ঠু পরিবেশের মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করাই সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
এ ছাড়া ২০১৯ সালের মতোই গেল বছরটাও কেটেছে করোনা মহামারির বছর হিসেবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা মহামারি আরও অন্তত দুই বছর স্থায়ী হবে। এরপর বিশ্বের অন্তত ৭০ ভাগ জনগোষ্ঠী ভ্যাকসিনের আওতায় এলে করোনার প্রকোপ প্রাকৃতিকভাবেই কমে আসবে। জানা গেছে, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি-বাকরি, সরকারি ও বেসরকারি খাত, শিল্প কারখানা, ছোটখাটো ব্যবসা- সব ক্ষেত্রেই বছরজুড়ে ছিল অচলাবস্থা। কৃষিক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়েছে ব্যাপকভাবে। ফলে ব্যাহত হয়েছে উৎপাদন। আমদানি-রপ্তানিতে পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। কমে গেছে আমদানি ও রপ্তানি। শিল্প খাতের বহু মানুষ ছাঁটাইয়ের শিকার হয়েছেন। শিল্পোদ্যোক্তারা নিজেদের প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখতে বছরজুড়েই যুদ্ধ করেছেন প্রকৃতির সঙ্গে। ফলে দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ালেও অনেক শিল্পোদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি। আবার ছোট উদ্যোক্তাদের অনেকেই পথে বসে গেছেন। পুঁজি হারিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন অনেকেই। ফলে সারা বছরই আর্থিক খাতে ছিল অস্থিরতা। চলতি ও আগামী বছরটা (২০২৩) হবে অর্থনীতির জন্য ঘুরে দাঁড়ানোর বছর। আর অর্থনৈতিক লোকসান পুষিয়ে নেওয়ার বছর। একই সঙ্গে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন কোনো সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। যদিও সরকার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টানা ১৩ বছরের বেশি সময় বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার ব্যাপকভাবে উন্নয়ন কর্মকান্ড চালিয়েছে। যার ফলে টানা চতুর্থবারের মতো ভোটে জয়লাভ করে আবারও ক্ষমতায় আসবে আওয়ামী লীগ।