ঢাকা, রবিবার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১

সিইও সংকটে নতুন বিমা কোম্পানিগুলো

নিজস্ব প্রতিবেদক : | প্রকাশের সময় : সোমবার ৭ মার্চ ২০২২ ১১:০৬:০০ পূর্বাহ্ন | জাতীয়

# ৬ মাসের মধ্যে নিয়োগ বাধ্যতামূলক হলেও দুই বছরের অধিক সময় ধরে সিইও নেই অনেক বিমা কোম্পানিতে

# সিইও পদ ছয় মাস শূন্য থাকলে প্রশাসক নিয়োগের বিধান রাখা হয়েছে বিমা আইনে

# বিমা খাতে যেমন দক্ষ জনবলের সংকট রয়েছে, তেমনি মালিক পক্ষও এমন সিইও খোঁজেন যাকে নিয়োগ দিলে তাদের সুবিধা হবে

দেশের বিমা খাতে এখনো রয়েছে ইমেজ সংকট। নানান কারণে খাতটির বিকাশ হয়নি আশানুরূপ। এরপরও একের পর এক নতুন বিমা কোম্পানির অনুমোদন দিয়েছে সরকার। রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া এসব বিমা কোম্পানির বেশিরভাগই ভালো ব্যবসা করতে পারছে না। এমনকি নিয়মিত মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাও (সিইও) খুঁজে পাচ্ছে না অনেক প্রতিষ্ঠান। ফলে বছরের পর বছর ধরে শীর্ষ পদ খালি রেখেই চলছে এসব বিমা কোম্পানি।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তিন মেয়াদে দেশে অনুমোদন পেয়েছে ১৯টি বিমা কোম্পানি। এ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) থেকে নিবন্ধন নিয়ে ব্যবসাও শুরু করেছে কোম্পানিগুলো। এর মধ্যে জীবন বিমা কোম্পানি ১৭টি। এই ১৭টি জীবন বিমা কোম্পানির মধ্যে ১০টিতেই নিয়মিত সিইও নেই। দুই বছর বা তারও বেশি সময় ধরে সিইও পদ খালি।

আইন অনুযায়ী, বিমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার পদ তিন মাসের বেশি খালি রাখা যাবে না। তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ অনুমোদ দিলে সিইও নিয়োগের জন্য আরও তিন মাস সময় পাওয়া যাবে। সব মিলিয়ে ছয় মাসের বেশি সময় সিইও পদ খালি রাখার সুযোগ নেই। কোনো কোম্পানিতে সিইও পদ ছয় মাস শূন্য থাকলে প্রশাসক নিয়োগের বিধান রাখা হয়েছে বিমা আইনে।

এমন বাধ্যবাধকতা থাকার পরও বছরের পর বছর কোম্পানিগুলোতে সিইও পদ খালি থাকার বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের বিমা খাত ইমেজ সংটকে রয়েছে। যে কারণে একটা সময় শিক্ষিতরা এ পেশায় আসতে খুব একটা আগ্রহী হতেন না। ফলে এ খাতে দক্ষ জনবলের অভাব দেখা দিয়েছে। অনেকে এসএসসি পাস না করেই ডিএমডি হয়ে গেছেন। কর্ম অভিজ্ঞতা থাকলেও প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকার কারণে তারা হতে পারছেন না সিইও।

মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ ও অপসারণ প্রবিধানমালা-২০১২ অনুযায়ী, বিমা কোম্পানির সিইওর শিক্ষাগত যোগ্যতা হবে তিন বছরের স্নাতক ও এক বছরের স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অথবা চার বছর মেয়াদি স্নাতক বা সমমানের ডিগ্রি। এছাড়া একই শ্রেণির বিমা কোম্পানিতে ১৫ বছরের চাকরির অভিজ্ঞতাসহ এমডির অব্যবহিত নিম্নপদে তিন বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। তবে বিমা বিষয়ক উচ্চতর ডিগ্রিধারীদের জন্য অভিজ্ঞতা শর্তসাপেক্ষে তিন থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত শিথিল করা যাবে। বয়সের সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে ৪০ থেকে ৬৭ বছরের মধ্যে।

বিমা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিমা খাতে যেমন দক্ষ জনবলের সংকট রয়েছে, তেমনি মালিকপক্ষও এমন সিইও খোঁজেন যাকে নিয়োগ দিলে তাদের সুবিধা হবে। এ কারণে অনেক সময় সিইও পাওয়া যায় না। আবার এমন ঘটনাও ঘটে, মালিকপক্ষকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবধা দেওয়ার পরও কোনো কোনো সিইও কোম্পানিতে টিকতে পারেন না। এসব কারণেই এখন বিমা খাতে এক ধরনের কৃত্রিম সিইও সংকট দেখা দিয়েছে।

সিইও পদ খালি থাকা জীবন বিমা কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে- মার্কেন্টাইল ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, বেস্ট লাইফ, সোনালী লাইফ, গার্ডিয়ান লাইফ, চাটার্ড লাইফ, প্রটেকটিভ ইসলামী লাইফ, যমুনা লাইফ, আলফা লাইফ, ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ এবং আকিজ তাকাফুল লাইফ ইন্স্যুরেন্স।

২০২০ সাল থেকে আলফা লাইফে সিইওর চলতি দায়িত্ব পালন করছেন নূরে আলম সিদ্দিকী অভি। বছরের পর বছর ধরে কোম্পানিটিতে নিয়মিত সিইও পদ খালি থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, আমাকে স্থায়ী সিইও করার লক্ষ্যে বোর্ড (কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ) কাজ করছে। শুধু আমাদের কোম্পানি নয়, অনেক কোম্পানিতেই এখন নিয়মিত সিইও নেই।

নিয়মিত সিইও না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি বিমা খাতে যোগ্যতাসম্পন্ন সিইওর অভাব আছে। এখন প্রতিটি কোম্পানির বোর্ড বা চেয়ারম্যান চাচ্ছেন তাদের প্রতিষ্ঠান আপডেট হোক। এক্ষেত্রে যে ধরনের সিইও দরকার তার অভাব আছে বলে আমি মনে করি।’

বেস্ট লাইফে সিইওর চলতি দায়িত্ব পালন করছেন শহিদুল ইসলাম। কোম্পানিটিতে নিয়মিত সিইও না থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, শুধু আমি একা না, অনেক কোম্পানিতে দীর্ঘদিন ধরে নিয়মিত সিইও নেই। আমরা চাইলেই তো আর সিইও হয়ে যেতে পারবো না। এটা বোর্ডের বিষয়। আমি ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে সিইওর চলতি দায়িত্ব পালন করছি। বোর্ড থেকে আমাকে এখনো সিইও করার জন্য আইডিআরএ’র কাছে আবেদন করা হয়নি।

দীর্ঘদিন ধরে চলতি দায়িত্ব পালন করা তো আইনের লঙ্ঘন? এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমাদের কোম্পানিতে কম সময় ধরেই চলতি দায়িত্বে আছে। অনেক কোম্পানিতে অনেক বেশি সময় ধরে চলতি দায়িত্বে সিইও আছে। বোর্ড পদক্ষেপ না নিলে আমাদের কী করার আছে? আমরা অসহায়, আমাদের চাকরির দরকার আছে। আমাদের পরিবার আছে।

ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সে সিইওর চলতি দায়িত্ব পালন করছেন মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন। তিনি বলেন, ২০১৮ সাল পর্যন্ত আমাদের নিয়মিত সিইও ছিল। এরপর সিইও খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু পাওয়া যায়নি। তখন আমার বয়স ৪০ বছর না হওয়ায় আবেদন করা হয়নি। এখন ৪০ বছর হওয়ার কারণে চলতি বছরের জানুয়ারিতে আমাকে সিইও করার জন্য আইডিআরএ’র কাছে আবেদন করেছে বোর্ড। আমি যতটুকু জানি আমার বিষয়টি আইডিআরএ যাচাই-বাছাই করে দেখছে।

দুই বছর ধরে যমুনা লাইফে সিইওর চলতি দায়িত্ব পালন করছেন কামরুল হাসান খন্দকার। তিনি বলেন, ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে আমি সিইওর চলতি দায়িত্ব পালন করছি। তবে আমি এখন চলতি দায়িত্বে নেই। কারণ আমাকে নিয়মিত সিইও করতে এরই মধ্যে আইডিআরএ’র কাছে আবেদন করেছে বোর্ড। এটা অনুমোদনের প্রক্রিয়ায় আছে।

নতুন বিমা কোম্পানিগুলোতে নিয়মিত সিইও না থাকার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, বিমায় পেশাদার লোকের অভাব আছে। ইমেজ সংকটের কারণে বিমা পেশায় কেউ আসতে চায় না। আমরা যারা আছি, বিভিন্ন কারণে এ পেশায় চলে এসেছি। এখন সিনিয়র হয়ে গেছি। তবে আমরা যে অপেশাদার তা কিন্তু নয়। আমি বিমা পেশায় আছি ২৫ বছর ধরে। জুনিয়র অফিসার হিসেবে এই পেশায় যোগদান করেছিলাম।

দুই বছর ধরে মার্কেন্টাইল ইন্স্যুরেন্সে সিইও’র চলতি দায়িত্ব পালন করছেন শহিদুল আমিন। তিনি বলেন, বিমার সিইও হতে হলে প্রায় ১৭টি ক্রাইটেরিয়া পূর্ণ করতে হয়। এখানে সবগুলো সবার আছে তা নয়। কারও কারও ক্ষেত্রে কিছু কম আছে। আমি আইডিআরএ’র চেয়ারম্যানের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেছি। চেয়ারম্যানকে বলেছি, আইনে কিছু শিথিলতা এনে যারা ভালো করছেন, তাদের অনুমোদন দেওয়ার জন্য। হয়তো আইনে কিছু পরিবর্তন আসবে।

শেখ রাকিবুল করিম গার্ডিয়ান লাইফে সিইও’র চলতি দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বলেন, বিমা খাতে দক্ষ জনবল আসা দরকার। এটা আমরা বারবার বলছি। এখন আপনারা অনেক সিইও দেখতে পাবেন, যাদের শুরুই হয়েছে এজেন্ট হিসেবে। এজেন্ট থেকে ধীরে ধীরে বড় (পদোন্নতি) হয়েছেন। তাদের শিক্ষাও হয়তো ঠিকমতো ছিল না।

গার্ডিয়ান লাইফে এক বছরের বেশি সময় ধরে নিয়মিত সিইও পদ খালি রয়েছে। অনেক কোম্পানিতে আরও বেশি সময় ধরে সিইও পদ খালি। এটা বিমা খাতের জন্য শুভ লক্ষণ কি না? এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘আমি ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে সিইও’র দায়িত্ব পালন করছি। আমি ভালো করছি না খারাপ করছি- তা দেখতেও তো এক-দুই বছর লাগতে পারে।’

যোগাযোগ করা হলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বাস্তবিক অর্থে আমাদের দেশে এত বিমা কোম্পানির দরকার ছিল না। হুজুগে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনেক বিমা কোম্পানি অনুমোদেন দেওয়া হয়েছে। এখন এসব কোম্পানিতে সিইও’র মতো গুরুত্বপূর্ণ পদ খালি থাকা বিমা খাতের জন্য শুভ লক্ষণ নয়। এ বিষয়ে আইডিআরএ’র পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

আইডিআরএ’র মুখপাত্র এস এম শাকিল আখতার বলেন, এ খাতে দক্ষ লোকের অভাব। তাছাড়া পরিচালনা পর্ষদ তাদের কথামতো চলা লোক ছাড়া নিয়োগ দিতে চায় না। দক্ষ লোক পেলেও তারা তাকে নিতে চায় না। কারণ তিনি তাদের কথামতো চলবেন না। নতজানু যে লোক তাকে নিয়ে তারা চালাবেন। এটা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য আইডিআরএ থেকে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।