ঢাকা, বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৭ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১

সিলেটে পাথর বালু লুটপাটের নেপথ্যে বিএনপি নেতারা

সিলেট ব্যুরো : | প্রকাশের সময় : শুক্রবার ১৮ অক্টোবর ২০২৪ ১১:৪৬:০০ অপরাহ্ন | সিলেট প্রতিদিন

প্রশাসনের ‘ঢিলেঢালা’ নজরদারির কারণে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ ও গোয়াইনঘাটের জাফলং পাথর কোয়ারি থেকে নির্বিচারে পাথর লুট চলছে। কোয়ারিসংলগ্ন নদ–নদী থেকে অবৈধভাবে তোলা হচ্ছে বালু। এতে বিএনপির স্থানীয় কয়েকজন নেতার পৃষ্ঠপোষকতা আছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
প্রশাসনের তথ্যমতে, সরকার পতনের পর দুই সপ্তাহে দুটি কোয়ারি থেকে অন্তত ১৪০ কোটি টাকার পাথর লুট হয়েছে। দুটি কোয়ারি থেকে এখনো রাতের বেলা পাথর নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দিনে প্রকাশ্যে বালু লুট চলছে। রিপোর্ট প্রথম আলো
এলাকাবাসীর অভিযোগ, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে কোয়ারি থেকে পাথর ও বালু উত্তোলন বন্ধের নির্দেশনা দেয় সরকার। এর পর থেকে রাতের আঁধারে স্থানীয় কিছু আওয়ামী লীগ নেতার পৃষ্ঠপোষকতায় অবৈধভাবে পাথর ও বালু উত্তোলন চলত। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর কোয়ারির নিয়ন্ত্রণ নেন বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা।
জাফলংয়ের দুজন বাসিন্দা জানান, পটপরিবর্তনের আগে মানুষ আড়ালে-আবডালে বালু তুলত। ৫ আগস্টের পর প্রকাশ্যে বালু উত্তোলন চলছে। মাঝেমধ্যে টাস্কফোর্সের অভিযান চললে লুটপাটকারীরা সটকে পড়ে। অভিযানকারীরা চলে গেলে আবার লুটপাট শুরু হয়। দিনের বেলা পাথর উত্তোলন কম হলেও রাতে অবাধে চলে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) সিলেট বিভাগের সমন্বয়ক শাহ সাহেদা আখতার  বলেন, পটপরিবর্তনের পর বেশ কিছুদিন নির্লিপ্ত ছিল স্থানীয় প্রশাসন। তখন জাফলং ও ভোলাগঞ্জ কোয়ারিতে রীতিমতো পাথর গণলুট হয়েছে। এখনো দিনের বেলা বালু ও পাথর উত্তোলন করে নিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু প্রশাসন এতটা তৎপর নয়। অথচ পরিবেশ ও জনজীবন রক্ষায় পাথর-বালু উত্তোলন থামানো উচিত। বিষয়টি জেলা প্রশাসনকে একাধিকবার জানানো হয়েছে।
বেলা জানায়, তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালে জাফলংকে পরিবেশ-প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করা হয়। এ ছাড়া পাথর কোয়ারির মূল কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো (বিএমডিসি) উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে জাফলংসহ সিলেটের আটটি পাথর কোয়ারিতে পাথর উত্তোলন বন্ধ রেখেছে। জেলা প্রশাসন বিএমডিসির সিদ্ধান্ত কার্যকর করেছে। এ অবস্থায় ভারতের নদ-নদীর পানির স্রোতে আসা পাথর জাফলং ও ভোলাগঞ্জে স্তূপাকারে মজুত হয়। গত চার বছরের মজুত থাকা এসব পাথরই এখন লুটপাট হচ্ছে।
এ ছাড়া নির্বিচারে পাথর উত্তোলনের কারণে ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত কোয়ারিতে ১০৬ শ্রমিক মারা গেছেন বলেও বেলার স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে।
অবাধে বালু-পাথর লুট
গত ৯ আগস্ট জাফলং জিরো পয়েন্ট থেকে বল্লাঘাট পর্যন্ত গোয়াইন নদের পাড় ধরে যাওয়ার পথে শতাধিক বারকি নৌকায় শ্রমিকদের বালু তুলতে দেখা যায়। শুধু বল্লাঘাট অংশেই ছিল ৭০ থেকে ৮০টি নৌকা। কিছু নৌকায় পাথরও দেখা গেল। বালুভর্তি নৌকাগুলো বল্লাঘাট বাজারের পাশে নোঙরের পর নদের পাড়ে বালু ফেলছেন শ্রমিকেরা। পরে সেই বালু ট্রাক ও পিকআপে ভরে নির্দিষ্ট গন্তব্যে চলে যাচ্ছে। একই পদ্ধতিতে নদসংলগ্ন জাফলং চা-বাগান ও মন্দির জুম এলাকায় বালু লুট করতে দেখা যায়।
বল্লাঘাট বাজারে নদের পাড়ে দাঁড়িয়ে পঞ্চাশোর্ধ্ব স্থানীয় এক ব্যক্তি দূরের সারি সারি বারকি নৌকা দেখিয়ে বলেন, গোয়াইনের পানিতে ডুবে ডুবে শ্রমিকেরা বালু তোলেন নৌকায়। একেকটা নৌকায় বালু বোঝাই করতে তিনজন শ্রমিকের ৪০ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা সময় লাগে। এভাবে দিন-রাত সমানতালে বালু বোঝাই করা হয়। সুযোগ বুঝে পাথর লুটও চলে। জিরো পয়েন্ট-সংলগ্ন পিয়াইন নদেও একইভাবে বালু-পাথর লুট চলছে বলে তিনি জানালেন।
এলাকাবাসী জানান, শ্রমিকেরা বালু তুলে পিয়াইন ও গোয়াইন নদের সাইট কালেকশনকারীর (নৌকা থেকে বালু ক্রেতা) কাছে বিক্রি করেন। বালুভর্তি একটি নৌকা গড়ে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায় কিনে নেন কালেকশনকারীরা। প্রতিটি নৌকায় গড়ে ৫০ ফুটের মতো বালু থাকে। পরে এসব বালু বেশি দামে ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করা হয়। একই আকারের নৌকায় থাকা পাথর দেড় হাজার থেকে চার হাজার টাকায় বিক্রি হয়। একেকটি নৌকায় ৪০ থেকে ৫০ ফুটের মতো পাথর থাকে।
জাফলং কোয়ারিতে দিনে পাথর লুটের ঘটনা কম দেখা গেলেও ভোলাগঞ্জ কোয়ারিতে বিপরীত চিত্র দেখা গেছে। গত ১৩ অক্টোবর কোয়ারি এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, দিনের বেলা কোয়ারির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ধলাই নদের বিভিন্ন অংশ এবং রেলওয়ের রজ্জুপথের (রোপওয়ে) সংরক্ষিত বাংকার এলাকা থেকে পাথর ও বালু তুলে শ্রমিকেরা বারকি নৌকায় করে নিয়ে যাচ্ছেন।
এসব বালু ও পাথর ধলাইয়ের পশ্চিম পাড়ে গুচ্ছগ্রাম পুলিশ ফাঁড়ি নদীঘাট, গুচ্ছগ্রাম বাজার নদীঘাট এবং ধলাইয়ের পূর্ব পাড়ে নতুনবাজার ও কলাবাড়ী এলাকায় স্তূপাকারে রাখা হচ্ছে। পরে ট্রাক ও পিকআপে বালু-পাথর নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। সন্ধ্যার পরও একইভাবে বালু-পাথর উত্তোলন করতে দেখা যায়।
দেড় শ কোটি টাকার পাথর-বালু লুট
স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, জাফলংয়ে পাথর মজুতের বিষয়টি স্থানীয়ভাবে পরিমাপ করে প্রতি মাসেই হিসাব সংরক্ষণ করত প্রশাসন। সর্বশেষ গত ২৬ জুলাই জাফলংয়ে আনুমানিক ৩ কোটি ৭৪ লাখ ঘনফুট পাথর মজুত ছিল। ৫ আগস্ট রাত ৮টা ২০ মিনিটের দিকে সেখানকার সিসিটিভি ক্যামেরা বিকল করে দুর্বৃত্তরা। পরে টানা দুই সপ্তাহ জাফলং জিরো পয়েন্ট-সংলগ্ন পিয়াইন ও গোয়াইন নদের আশপাশে জমে থাকা অন্তত এক কোটি ঘনফুট পাথর লুট করা হয়। এর আনুমানিক মূল্য প্রায় ১০০ কোটি টাকা। এ ঘটনায় স্থানীয় ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তা ১৮ আগস্ট গোয়াইনঘাট থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।
এদিকে কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারিতেও টানা দুই সপ্তাহ লুটপাট চালানো হয়। সেখান থেকে অন্তত ২০ কোটি টাকার পাথর লুট হয়েছে। প্রশাসনের সূত্র অনুযায়ী, সরকার পতনের পর থানা, পুলিশ ফাঁড়ি ও বিজিবি ক্যাম্পে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। তখন পুলিশ ও বিজিবি সদস্যরা দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। এ সুযোগে লুটেরা চক্র বিপুল পরিমাণ পাথর লুট করে নেয়।
পাথর ব্যবসায় যুক্ত স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানান, প্রশাসনের হিসাবে জাফলং ও ভোলাগঞ্জে ১২০ কোটি টাকার পাথর লুটের কথা বলা হলেও বাস্তবে পরিমাণ আরও বেশি হবে। এখনো সমানতালে বালু ও পাথর লুট চলছে। সরকারের পতনের পর ৭০ দিনে অন্তত ১৫০ কোটি টাকার পাথর ও বালু লুট হয়েছে বলে তাঁরা অনুমান করছেন।
গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. তৌহিদুল ইসলাম বলেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার পর আবার পাথর-বালু রক্ষায় সচেতনতা কার্যক্রমের পাশাপাশি অভিযান চালানো হচ্ছে। এখন পাথর লুটের ঘটনা পুরোপুরি বন্ধ হয়েছে। কোম্পানীগঞ্জের ইউএনও আবিদা সুলতানা বলেন, বালু-পাথর চুরি ঠেকাতে নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে। প্রয়োজনে আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

নেপথ্যে বিএনপি নেতারা
স্থানীয় বাসান্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকার পতনের পর প্রথম দুই দিন জাফলং ও ভোলাগঞ্জে পাথর লুটপাটে স্থানীয় অনেকে জড়িত ছিলেন। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের কিছু নেতা ও তাঁদের অনুসারীরা। এখন বিএনপির ওই নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতায় কোয়ারিতে পাথর ও বালু লুটপাট করছে একটি চক্র। তারা বিএনপি নেতাদের ‘ম্যানেজ’ করেই লুটপাট চালাচ্ছে বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ।
জাফলংয়ে বালু-পাথর লুটপাটে পৃষ্ঠপোষক হিসেবে জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম ওরফে শাহপরান, পূর্ব জাফলং ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আমজাদ বক্স, উপজেলা বিএনপির ক্ষুদ্রঋণ ও সমবায় সম্পাদক রিয়াজ উদ্দিন তালুকদারসহ বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের অন্তত ১০ জন নেতার নাম আলোচনায় আছে বলে স্থানীয় একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
ইতিমধ্যে পাথর লুটপাটের অভিযোগে ১৪ অক্টোবর রফিকুল ইসলামের দলীয় পদ স্থগিত করেছে কেন্দ্রীয় বিএনপি। অভিযোগের বিষয়ে তাঁর মুঠোফোনে একাধিকবার কল করলেও তিনি ধরেননি।
তবে অভিযুক্ত আমজাদ বক্স বলেন, ‘নিরপেক্ষ ও স্বতন্ত্র তদন্ত করুন। আমি হলফ করে বলতে পারি, সরিষা পরিমাণ সম্পৃক্ততাও আমার পাবেন না। তখন বিজিবি-পুলিশ ছিল না। এই সুযোগে এলোপাতাড়িভাবে মানুষ পাথর নিয়ে যায়। বল্লাঘাট পাথর ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির অনুরোধে ৫ ও ৬ আগস্ট অনেকের সঙ্গে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলাম। গিয়ে সবাইকে পাথর না নেওয়ার অনুরোধ করেছি।’
বিএনপি নেতা রিয়াজ উদ্দিন তালুকদার অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি নিজেও পাথর উত্তোলনের বিরুদ্ধে দাবি করে বলেন, জাফলংয়ে এখনো আওয়ামী লীগের চিহ্নিত কিছু মানুষ পাথর লুট করছে। তিনি কিংবা স্থানীয় বিএনপির কেউ এতে জড়িত নন।
জেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী বলেন, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশনা আছে, কেউ অপকর্মে জড়ালে ছাড় দেওয়া হবে না। অভিযোগের সত্যতা পেলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বহিষ্কারসহ যথাযথ সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে ভোলাগঞ্জে স্থানীয় যুবদলের কয়েকজন নেতা বালু-পাথর লুটপাটকারীদের পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে জেলা যুবদলের সভাপতি মোমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা তদন্ত করে দেখছি, যুবদলের কেউ পাথর-বালু লুটপাটে জড়িত কি না। এমন কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যুবদলের নাম ভাঙিয়ে কেউ এমন করছে কি না, সেটিও খতিয়ে দেখা হবে।’

যা বলছে প্রশাসন
স্থানীয় প্রশাসন জানায়, সরকার পতনের পর দুই সপ্তাহ পুলিশ ও প্রশাসনের তৎপরতা ছিল না। তবে এখন নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। সরকার পরিবর্তনের পর গত মঙ্গলবার পর্যন্ত জাফলংয়ে চারটি অভিযান চালানো হয়েছে। গত সোমবার পর্যন্ত জাফলংয়ে অভিযান চালিয়ে বালু-পাথর উত্তোলনে ব্যবহৃত ৭০০টি নৌকা জব্দ করেছে টাস্কফোর্স। এ সময় ৯ লাখ ৬৬ হাজার ঘনফুট বালু, ১০ হাজার ঘনফুট পাথর ও দুটি পাথর ভাঙার মেশিন জব্দ করা হয়। একইভাবে ভোলাগঞ্জেও ছয়বার অভিযান চালিয়ে জরিমানার পাশাপাশি বালু-পাথরের বাহন জব্দ করা হয়।

সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ প্রথম আলোকে বলেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতির শুরুতে কোয়ারিগুলোতে কিছুদিন পাথর লুট হয়েছে। এসব ঘটনায় নিয়মিত মামলাও দায়ের হয়েছে। এখন বালু-পাথর লুট বন্ধে নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে। প্রশাসন কড়াকড়ি নজরদারি রাখছে। এ ছাড়া যাঁরা লুটপাটে জড়িত, তাঁদের শনাক্ত করে তালিকা করা হয়েছে। জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে।