ঢাকা, বৃহস্পতিবার ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮শে অগ্রহায়ণ ১৪৩১

ইউটিউব দেখে পাহাড়ে কমলা চাষ, সফল হেডম্যান সুদত্ত চাকমা

রকিব উদ্দিন রকি, রাঙামাটি | প্রকাশের সময় : বৃহস্পতিবার ১২ ডিসেম্বর ২০২৪ ০২:০৮:০০ অপরাহ্ন | দেশের খবর

পাহাড়ি জমিতে কমলার চাষ করে সফলতার মুখ দেখেছেন রাঙামাটি নানিয়ারচর উপজেলার হেডম্যান সুদত্ত চাকমা। ইতিমধ্যে ব্যাপক সাড়া পেয়েছে তার সুস্বাদু কমলার। ফরমালিন মুক্ত পাহাড়ি কমলা স্বাদেগুণে অনন্য হওয়ায় স্থানীয় বাজারে চাহিদা মিটিয়ে পৌছে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।

২০২০ সালের শেষের দিকে ইউটিউব দেখে সখের বশে ১৫টি কমলার চারা রোপণ করে রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলার ৭৭নং তৈচাকমা মৌজার হেডম্যান সুদত্ত চাকমা। এরপর ধীরে ধীরে বীজ ও চারা সংগ্রহ করে নানিয়ারচর উপজেলা ১৭ মাইল দোসর পাড়া এলাকায় ৪ একর পাহাড়ি জমিতে প্রায় এক হাজার গাছ নিয়ে তৈরি করেন কমলার বাগান। গত বছর তার বাগানের কিছু কমলা গাছে ফলন আসলেও এবছর বেশীরভাগ গাছেই এসেছে ফলন। বাগানে এখন থোকায় থোকায় ঝুলছে রসালো ও সুস্বাদু কমলা। 

বর্তমানে তার বাগানে রয়েছে- দার্জেলিং ও চায়না এই ২ জাতের কমলা। পাহাড়ি মাটিতে উৎপাদিত এই কমলা সুস্বাদু ও রসালো হওয়ায় এর বেশ চাহিদা রয়েছে জেলা ও জেলার বাহিরে। হেডম্যান সুদত্ত চাকমার এই কমলা বাগান দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসছেন দর্শণার্থীরা। তার এই বাগান দেখে আগত দর্শণার্থীরা কমলা বাগান করতে আগ্রহ প্রকাশ করছেন। 

স্থানীয়রা মনে করেন, তার এই বাগান দেখে বেকারত্ব দূর করতে অনেক যুবক কমলা চাষে উদ্বুদ্ধ হবেন। 

সুদত্ত চাকমার বাগানের এই কমলা স্থানীয় বাজারগুলোতে বিক্রি করা হচ্ছে প্রতি কেজি ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা ধরে। এ ছাড়াও বাগান থেকে সরাসরি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিক্রির জন্য পাঠানো হয় এই কমলা।

এলাকাবাসী জানান, পাহাড়ে লক্ষ লক্ষ হেক্টর পতিত জমি পড়ে আছে। চাইলে পাহাড়ের বেকার যুবকেরা এইসব জমিতে কমলা, আপেল, আংগুর, কপি, আনারস, কলা, পেঁপেঁ, পেয়ারা, আদা ও আম লিচুর চাষ করে স্বাবলম্ভী হতে পারে। এখানে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড ও জেলা পরিষদসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও এনজিও রয়েছে তারা চাইলে পাহাড়ে এধরনের চাষাবাদ করে বেকারত্বের অভিশাভ দূর করতে পারে।

খাগড়াছড়ি জেলার মাহালছড়ি থেকে কমলা বাগান দেখতে আসা দর্শণার্থী খোকা চাকমা ও ইভা চাকমা বলেন, বাগান দেখে খুব ভাল লেগেছে তাই চায়না ও দার্জেলিং কমলা কিনে নিলাম। ভেজাল ও বিষমুক্ত কমলা, তাই বাসার সবার জন্য কিনলাম। 

স্থানীয় লোকজন ও বেকার যুবকেরা বলেন, হেডম্যান সুদত্ত চাকমার এই কমলা বাগান আমাদের কাছে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। তাই ভাবছি আমরা যারা বেকার আছি তারা হেডম্যান থেকে সহায়তা নিয়ে কমলা বাগান করবো। পাশাপাশি অন্যান্য ফলজ বাগান করবো। পাহাড়ে অসংখ্য এধরনের খালি জায়গা পড়ে আছে ওই সব জায়গায় আমরা চাইলে কমলা ও অন্যান্য ফলের চাষ করতে পারি।

বাগান মালিক হেডম্যান সুদত্ত চাকমা বলেন, ৪ বছর হলো আমি এই বাগানটি আবাদ করি। ৪ একর জমিতে আমি বিভিন্ন ধরনের ফল ফলাদির চাষ করেছি। এবছর তেমন ভাল হবে না। আগামী বছর থেকে লাভের মূখ দেখতে পাবো। আমি কমলা বাগানটি শান্তিময় চাকমাকে ৫ লাখ টাকা দিয়ে ইজারা দিয়েছি। তবে অন্যান্য ফল ফলাদি আমি নিজেই আবাদ করছি। তবে কমলার কলম বিক্রি করতে পারবো প্রায় ১০ লাখ থেকে ১২ লাখ টাকার মত। 

কৃষি বিভাগ হতে কমলা বাগান সম্পর্কে বিভিন্ন সময়ে পরামর্শ দিয়ে আসছে কৃষি বিভাগের লোকজন। আমি যাকে কমলা বাগান ইজারা দিয়েছি সে এবছর দার্জেলিং ও চায়না কমলা বিক্রি করে ৬-৭ লাখ বিক্রি করছে। আবহওয়া ও পরিবেশ পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে আগামী বছর দ্বিগুন কমলা উৎপাদন বলে আশা করছি। আমার এই কমলা বাগান প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ায় ব্যাপক ছড়িয়ে পড়েছে। আমি সরকারি বেসরকারি সহযোগিতা পেলে কমলার পাশাপাশি অন্যান্য ফলজ বাগান করে অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটাতে পারবো। সাথে সাথে বেকারত্ব দূর করতে সক্ষম হবো।

অন্যদিকে বাগান লিজকারী ও উদ্যোক্তা শান্তিপ্রিয় চাকমা কমলা বাগান কিনে লাখপাতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ইতোমধ্যে শান্তিপ্রিয় চাকমা ৪লক্ষ টাকা দিয়ে বাগান কিনে ৬-৭ লাখ টাকার কমলা বিক্রি করেছে আরো বিক্রি করতে পারবে বলে প্রত্যাশা করছেন।

কমলা বাগান ইজারাদারও উদ্যাক্তা শান্তিময় চাকমা বলেন,আমরা এই কমলা বাগান হেডম্যান সুদত্ত চাকমার কাছ থেকে লিজ নিয়েছি। লিজ নিয়ে শুধু কমলা বাগান করছি বাকি অন্যান্য ফলজ বাগান মালিক নিজেই করে। প্রায় ৬-৭ লাখ টাকার কমলা বিক্রি করেছি আরো ৩-৪ লাখ টাকার কমলা বিক্রি করতে পারবো। আশা করি আগামী বছর আরও বেশি কমলা ফলন ফলানো সম্ভব হবে বলে মনে করছি। কমলা আবাদে সরকারি বেসরকারি তেমন কোন সহায়তা আমরা পাচ্ছি না। কমলা আবাদে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ হতে পোকামাকড় দমনে একটু সহযোগিতা পেলে আরো ভাল হতো।

সুদত্ত চাকমার পাশাপাশি জেলার নানিয়ারচর, বাঘাইছড়ির সাজেক, বিলাইছড়িসহ বিভিন্ন উপজেলার কৃষকরাও কমলা চাষে আগ্রহী হচ্ছেন।

এবছর রাঙামাটি জেলায় ৬শ’ হেক্টও জমিতে ৮হাজার ৫শ’ মেট্রিক টন কমলা উৎপাদন করা হয়েছে। যার বাজার মূল‌্য ২১০ কোটি টাকার মত।

রাঙামাটি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান বলেন- রাঙামাটিতে দার্জেলিং ও চায়না জাতের কমলা আবাদ হচ্ছে। রাঙামাটির কমলা বাগান মালিকেরা বিভিন্ন সোর্স থেকে কমলার চারা সংগ্রহ করেছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পক্ষ হতে বাগান মালিকদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও সহায়তা দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়। পাহাড়ের লাল মাটিতে কমলা চাষ উপযোগী। গত বছরের চেয়ে এবছর কমলার আবাদ ভাল হয়েছে। যে মাটিতে আইরন বেশি থাকে সে মাটিতে কমলা আবাদ ভাল উৎপাদন হয়।

তবে পাহাড়ের চুড়ায় কমলা ভাল হয় না কারন পাহাড়ের চুড়ায় পানির স্বল্পতা থাকার কারনে একটু সমতলে কমলার চাষ ভাল হয়। পাহাড়ে অনেক জাতের কমলা চাষ হয় তবে ভাল ফলন হয় দার্জেলিং ও চায়না কমলা। পাহাড়ে অনেক কমলা উৎপাদন করা সম্ভব। যেখানে কমলা বাগান হবে সেখানে পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা ও স্যার ব্যবহার করলে কমলার ফলন ভাল হবে।

বায়ান্ন/প্রতিনিধি/একে