তহিদুল ইসলাম। বয়স ৫৫। জীবিকার তাগিতে প্রতিদিন অন্যের রিকশা ভাড়া নিয়ে চালান। সারাদিনের আয় দিয়ে কোনো রকমে চলে সংসার। সংসারে ৪ মেয়ে। ২ মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ঘরে বিয়ের উপযুক্ত রয়েছে এখনো ২ মেয়ে। দিন যায় চিন্তার ভাঁজ আরও গাঢ় হয় তহিদুলের।
ঝিনাইদহের রিকশাচালক তহিদুল ইসলামের গল্পটি সেকেলের সাদা-কালো সিনেমার মতো করুণ শোনালেও তার জীবনটা এক সময় ছিলো বর্ণীল। তরুণ বয়সে নেতৃত্ব দিয়েছেন যুবলীগের। ছিলেন ঝিনাইদহ পৌর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক। কিন্তু নিয়তির নিষ্ঠুর পরিণতিতে তিনি এখন জীবিকা নির্বাহ করেন রিকশা চালিয়ে।
ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি তৈয়ব আলী জোয়ার্দ্দার তহিদুল ইসলাম তার রাজনৈতিক পরিচয় সম্পর্কে জানান, তহিদুল ২০০১ সালে ঝিনাইদহ পৌর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন। রাজনীতি ও ডানপিঠে স্বভাবের কারণে পরিবারের অন্য সদস্যরা তাকে বরাবর এড়িয়ে চলেন।
এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, তহিদুলের বাবা মৃত আফছার উদ্দিন এক সময় ঝিনাইদহ শহরে অবস্থাপন্ন ছিলেন। শহরের কাঞ্চনগর কলাবাগান এলাকায় তাদের পুরাতন বাড়ির কথা শহরের প্রবীণদের সবারই জানা। তহিদুলের বৈমাত্রেয় ও নিজের ভাইয়েরা সবাই প্রতিষ্ঠিত। তহিদুল ইসলামেরও ঝিনাইদহ শহরের হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সড়কের সমবায় মার্কেটে ঝিনাইদহ স্টুডিও অ্যান্ড ফটোস্ট্যাট নামের একটি দোকান ছিল। ২০০১ সালে বিএনপির হরতাল পালনকারীরা তার দোকানপাট ও জিনিসপত্র ভাঙচুর করে। এরপরে তিনি আর রাজনীতিতে ফিরতে পারেননি তিনি। রাজনীতির কারণে বহু হামলা-মামলা হয়েছে তার। জেলও খেটেছেন। বহু ত্যাগ স্বীকার করেছেন রাজনীতির জন্য। জীবিকার তাগিতে ৫৫ পেরনো তহিদুল এখন রিকশা চালান।
এলাকাবাসী জানান, দীর্ঘদিন পলাতক জীবন রাজনৈতিক হতাশার কারণে তহিদুল নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। নেশা করে পাড়ায় অনেকবার মাতলামোও করেছেন তিনি। এখন নেশা ছেড়েছেন। চান বাকি দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়ে একটু শান্তির জীবন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় পর পর ১৪ বছর। দুর্দিনের তহিদুলের খোঁজ ১৪ বছরেও কেউ নেননি। অনেক ত্যাগী নেতা-কর্মী রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।
তহিদুল জানান, ২০০১ সালের ১৮ জুন দেশব্যাপী হরতাল ডাকে বিএনপি। ওই সময় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দেন যে, বিরোধী দলের অধিকার আছে হরতাল ডাকার এবং সেই হরতাল কে মানবে এবং মানবে না এটা তাদের বিষয় না। সেই সময় তিনি হরতালে সমর্থন না দিয়ে তার দোকান খোলা রেখেছিলেন। যুবলীগের রাজনীতি করার কারণে টার্গেট করে তার দোকানে হামলা চালিয়ে সকল জিনিসপত্র ভাঙচুর করে বিএনপি। নিঃস্ব হন তহিদুল। তারপর পলাতক জীবন। রাজনীতি করতে গিয়ে ঝিনাইদহের আলোচিত মসলেম মার্ডার, ভিপি মিঠু মার্ডার, বিএনপির পার্টি অফিস ভাঙচুরসহ অসংখ্য রাজনৈতিক মামলায় আসামি হয়েছে। করেছেন কারাবরণ। দল ক্ষমতায় আসলে আশা ছিল দল হয়তো তার পাশে দাঁড়াবে। কিন্তু তা হয়নি।
তহিদুল আরও জানান, একবার এক নেতার পরামর্শে প্রধানমন্ত্রী বরাবর একটি আবেদন করেছিলেন। তাতে সিলসহ স্বাক্ষর করে সুপারিশ করেছিলেন তৎকালীন প্রেসিডিয়াম মেম্বার সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত। কিন্তু সেই আবেদন প্রধান মন্ত্রীর কাছে আর পৌঁছানো হয়নি। রাগে ক্ষোভে এখন আর রাজনীতির সঙ্গে নেই তহিদুল। অবিবাহিত ২ মেয়েকে নিয়ে সংসার চালাতে রিকশা চালানোয় এখন তার সম্বল।
জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি তৈয়ব আলী জোয়ার্দ্দার বলেন, ‘ঈদের পরের দিন রাতে আমি সন্ধ্যার পরে শহর থেকে বাসায় ফিরতে একটা রিকশা ডাকলাম। বাসায় পৌঁছে ভাড়া দিতে গিয়ে আমি চমকে উঠেছি। তহিদুল! তহিদুলের এই অবস্থা! দলের উচিৎ তহিদুলসহ এমন ত্যাগী ও দুর্দিনের কর্মী যারা আছেন, তাদের খোঁজ করে পাশে দাঁড়ানো।’
জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে এই বার্তা দলীয় দায়িত্বশীলদের পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে বলেও জানান জেলা আওয়ামী লীগের এই নেতা।