গাজীপুরের কালিয়াকৈরে ৫০০ বিঘা ভুমি জালিয়াতির পর এবার জাল দলিলের মাধ্যমে নিরিহ এক চা-দোকানীর জমি হাতিয়ে নেওয়া চেষ্টা করছেন ভুমিদস্যুরা। এ ঘটনায় আদালতে মামলার পর সিআইডি তদন্ত প্রতিবেদনে জালিয়াতি প্রমাণিত হলে ভুমিদস্যুর মুলহোতা ও দলিল লেখকসহ ১৪ জনের নামে ওয়ারেন্ট জারি করা হয়েছে। এরপরও বাদী চা-দোকানীকে হুমকি দিচ্ছেন ওই ভুমিদস্যুরা। এতে আতঙ্কে রয়েছেন ওই চা-দোকানীর নিরিহ পরিবার।
ভোক্তভোগী পরিবার, সিআইডি তদন্ত প্রতিবেদন ও মামলা সূত্রে জানা গেছে, কালিয়াকৈর উপজেলার আটাবহ ইউনিয়নের জালশুকা গ্রামের বাসিন্দা খোয়াজ উদ্দিন শেখের দুই পুত্র যথাক্রমে মৈজদ্দিন শেখ ও জৈনউদ্দিন শেখ সিএস রেকর্ড মুলে জালশুকা ও পশ্চিম খোলাপাড়া মৌজায় ৩৫৫ শতাংশ জমির মালিক। এর মধ্যে জৈনউদ্দিন শেখ মৃত্যুবরণ করলে তার ওয়ারিশগনরা ১৯৪২ সালে তাদের সম্পত্তি মৈজদ্দিন শেখের নিকট বিক্রি করেন। যার দলিল নং- ২৪৩২। এরপর মৈজদ্দিনের মৃত্যুর পর এস এ রেকর্ড আগত হলে ওই সম্পত্তি তার স্ত্রী ও চার পুত্রের নামে এসএ রেকর্ডভুক্ত হয়। কিন্তু ভুল বসত পশ্চিম খোলাপাড়া মৌজায় একটি দাগ এসএ রেকর্ডে মৈজদ্দিনের ছেলে আমির উদ্দিনের স্থলে জৈনদ্দিনের ছেলে হাফিজ উদ্দিনের নাম উঠে। পরবর্তীতে আরএস রেকর্ড আগত হলে মৈজদ্দিনের স্ত্রী বাছিরন নেছা ও চার পুত্র আমির উদ্দিন, জামত আলী, আব্দুল গফুর ও কফিল উদ্দিনের নামে শুদ্ধভাবে আরএস রেকর্ড লিপিবদ্ধ হয়। মৈজদ্দিনের স্ত্রী ও চার পুত্র মৃত্যুবরণ করেন। এরপর তাদের ওয়ারিশগণ পৈত্রিক সূত্রে জমির মালিক হয়ে ভোগ-দখল করে আসছিলেন। কিন্তু গত ২০০৮ সালে ভুমি জালিয়াত চক্রের মূলহোতা রবিউল করিম জালিয়াতির মাধ্যমে কাল্পনিক দাতা সাজিয়ে তার স্ত্রী শারমিন করিম মুন্নির নামে একশত সাড়ে ৭৭ শতাংশ জমির একটি আম-মোক্তারনামা দলিল (নং-৪৩০২) করেন। ওই দলিল মূলে গত ২০২৩ সালের ৯ জুলাই শারমিন করিম মুন্নি একটি রেজিষ্ট্রি বয়নাপত্র দলিল (নং-৮৫৩৫) মুলে জালিয়াতি চক্রের সদস্য আনিছ আলী, আব্দুল বাছেদ, জামাল উদ্দিন, আজাহারুলসহ সাতজনের নামে হস্তান্তর করেন। এরপর গত ২০২৩ সালের ৪ আগস্ট ভূমি জালিয়াত চক্রের মূলহোতা রবিউল করিমের পরামর্শে চক্রের সদস্য আনিছ আলী, আব্দুল বাছেদ, জামাল উদ্দিন, আজাহারুলসহ ১৫/১৬ জন ওই জমি জবর-দখলের চেষ্টা করে। বিষয়টি টের পেয়ে মৃত আব্দুল গফুরের কন্যা পৈত্রিক সূত্রে ওই জমির মালিক চা-দোকানী ছফুরা বেগমসহ অন্য ওয়ারিশগণ বাধা দেয়। পরে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের পরামর্শে ওই চা-দোকানী ছফুরা বেগম বাদী হয়ে গাজীপুর জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও থানায় অভিযোগ দায়ের করেন। কিন্তু ভূমি জালিয়াত চক্রের সদস্য আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা হওয়ার কারণে কোন প্রতিকার পাননি ওই চা-দোকানী। এরপর তিনি গাজীপুর আদালতে একটি সিআর মামলা দায়ের করেন। বিজ্ঞ আদালত মামলাটি গাজীপুর সিআইডিকে তদন্ত করার নির্দেশ দেন। পরে সিআইডি দলিলে উল্লেখিত মৃত জৈনর্দ্দিনের পুত্র মৃত হাফিজ উদ্দিন ও তার পুত্র কোমর উদ্দিনের ঠিকানা অনুযায়ী তার খোঁজে কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী থানার গোচিডাঙ্গা গ্রামে যায়। কিন্তু ওই ঠিকানায় কোমর উদ্দিন নামে কোন লোক নাই এবং কখনও ছিল না। এই মর্মে সেখানকার স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান একটি প্রত্যয়নপত্র দিয়েছেন সিআইডিকে। এছাড়াও বিভিন্ন দিক তদন্ত করে শারমিন করিম মুন্নির আম-মোক্তরনামা দলিলটি প্রাথমিক ভাবে জাল প্রমানিত হয়েছে সিআইডি তদন্ত প্রতিবেদনে। ওই প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, গত ২০১২ সালে ৫০০ বিঘা ভুমি জালিয়াতি করে একটি কোম্পানির নিকট বিক্রি করেছিল। তারা কখনো কখনো পেশা পরিবর্তন করে এই ভুমি জালিয়াতি করে। তৎকালীন সময়ে তাদের নামে প্রায় ১৭টি মামলা হয়েছিল। দৈনিক প্রথম আলো, দৈনিক যুগান্তর পত্রিকাসহ একাধিক জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে ভূমি জালিয়াতির খবর প্রকাশিত হয়। এরপর আইন ও বিচার এবং সংসদ বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের করা একটি কমিটির তদন্তেও তাদের বিরুদ্ধে জাল জালিয়াতী অপরাধ প্রমানিত হয়। ওই চক্ররা এখনো সক্রিয় অবস্থায় ওই চা-দোকানী ছফুরা বেগমদের জমিও জালিয়াতির মাধ্যমে জবর-দখলের চেষ্টা করছেন। সিআইডির তদন্ত প্রতিবেদনের পর গত ২২ সেপ্টেম্বর ওই জালিয়াতি চক্রের মুলহোতা রবিউল করিম, দলিল লেখক তুহিন খান, তমছের আলীসহ ১৪জনের নামে ওয়ারেন্ট জারি করে আদালত। এরপর থেকে ওই আসামীরা গা-ঢাকা দিলেও বিভিন্ন মাধ্যমে বাদী ছফুরা বেগমকে মামলা তুলে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন। এ ঘটনায় গত ৩ অক্টোবর কালিয়াকৈর থানায় একটি সাধারন ডায়েরী (জিডি) করেন ছফুরা বেগম।
ভোক্তভোগী ছফুরা বলেন, আমার পিতার রেকর্ডীয় ও ক্রয় সূত্রে আমরা জমির মালিক হয়েছি। আলোচিত ভুমি জালিয়াতি চক্রের মূলহোতা পাবনা থেকে আগত রবিউল করিম জালিয়াতির মাধ্যমে আমাদের একশত সাড়ে ৭৭ শতাংশ জমি জাল আম-মোক্তারনামা দলিল করে। এরপর ওই জালিয়াতি চক্র আমাদের জমি জবর দখলে চেষ্টা করছেন। এছাড়াও ওয়ারেন্টভুক্ত আসামী হয়েও মামলা তুলে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন আসামীরা।
কালিয়াকৈর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রিয়াদ মাহমুদ জানান, ওয়ারেন্টের কপি এখনো থানায় পৌছায়নি। ওই কপি থানায় পৌছলে আসামীদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা করা হবে। তবে বাদীকে হুমকির ঘটনায় থানায় একটি জিডি করা হয়েছে।