টাঙ্গাইলের চরাঞ্চলের ঘাস বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন তিন শতাধিক পরিবার। জেলার ভূঞাপুর উপজেলার গোবিন্দাসী, গোপালপুর উপজেলার নলীন ও কালিহাতী উপজেলার গড়িলাবাড়ী ঘাটে ঘাস বিকিকিনির হাট বসেছে। চলতি মৌসুমে যমুনায় পানি বেড়ে চরাঞ্চলের নিম্নাঞ্চল পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় গবাদী পশুর খাদ্যের যোগান দিতে ওইসব এলাকার মানুষ ঘাস বিক্রিকে সাময়িক পেশা হিসেবে নিয়েছেন।
জানা যায়, ভূঞাপুর উপজেলার গাবসারা ও অর্জুনার বৃহদাংশ, গোপালপুরের হেমনগর ও ঝাওয়াইল ইউপির কয়েকটি গ্রাম এবং কালিহাতী উপজেলার গোহালিয়াবাড়ী ইউনিয়নের একটি ওয়ার্ড যমুনা নদীর মাঝখানে জেগে ওঠা চরাঞ্চলে গড়ে ওঠেছে। ওইসব গ্রামগুলোর অধিকাংশ মানুষের মূল পেশা মাছ ধরা (জেলে) ও কৃষিকাজ করা। নদী পরিবেষ্ঠিত ওইসব এলাকাগুলোর মানুষ প্রতিদিন সকাল ও বিকেলে তীরবর্তী স্থানে আসে। এজন্য ইঞ্জিন চালিত নৌকার ব্যবস্থা রয়েছে। শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা করতেও ওই নৌকাযোগে তীরবর্তী স্থানে নেমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসা-যাওয়া করে থাকে। কেউ সকালের নৌকায় উঠতে না পারলে তাকে বাড়িতেই থাকতে হয়। একইভাবে বিকেলের নৌকায় উঠতে না পারলে তীরবর্তী আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয়। মাঝ যমুনার চরে গড়ে ওঠা বসতিদের গবাদী পশুগুলো পানি আসার আগেই তীরবর্তী আত্মীয়-স্বজন বা গরুর আবাসিক হোটেলে রাখেন। যমুনা ও যমুনা তীরবর্তী এলাকায় বরাবরই গো-খাদ্যের সংকট থাকে। যমুনা প্রমত্ত্ব হলে এ সংকট আরও তীব্রতর হয়। অসময়ে যমুনায় পানি বেড়ে নিচু এলাকার জমি ও বাড়ির আঙিনা তলিয়ে যাওয়ায় ওইসব এলাকায় গো-খাদ্যের ব্যাপক চাহিদা দেখা দেয়। গো-খাদ্য সংকটের কারণেই মূলত ঘাস বিকিকিনি পেশায় রূপান্তর হয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ওইসব এলাকায় বর্তমানে বিভিন্ন জাতের ঘাস উৎপাদন ও বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন প্রায় তিনশতাধিক পরিবার। তারা ভোর হতে না হতেই ঘাসের আটি নিয়ে নদী তীরবর্তী নলীন বাজার, গোবিন্দাসী ঘাটপাড় ও গড়িলাবাড়ী পাথরঘাটায়। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ওইসব ঘাটে ঘাস বিকিকিনি হয়। বিভিন্ন এলাকা থেকে গো-খাদ্যের ক্রেতারা ওইসব এলাকায় আসেন।
গরু-ছাগলের খাদ্য হিসেবে পরিচিত ঘাসের মধ্যে নেপিয়ার, দুর্বাঘাস, গর্বাঘাস, কাঠাঁলপাতাসহ আরও অনেক রকমের ঘাস বিক্রি হয়। যমুনার তীরঘেঁষা ওই বাজারগুলো এক সময় টাটকা মাছের বাজার হিসেবে পরিচিত হলেও বর্তমানে তা ‘ঘাসের বাজার’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
এসব বাজারে প্রতি আটি ঘাস বিভিন্ন দামে বিক্রি হচ্ছে। এক আটি কাঠাঁল পাতা ২০-৩০ টাকা, দুর্বাঘাস প্রতি আটি ৭০-৮০ টাকা, গর্বাঘাস ৭০-৮০ টাকা, নেপিয়ার ঘাস প্রকার ভেদে ৩০-৮০ টাকা আটি দরে বিক্রি হচ্ছে।
যমুনার তীরঘেষা নলীন বাজারে ঘাস বিক্রি করতে আসা চর বিহারী গ্রামের ছানোয়ার হোসেন বলেন, বর্ষা মৌসুমে ঘাস বিক্রি করেই আমাদের সংসার চলে। বর্ষা মৌসুমে চরাঞ্চলে সাধারণত কাজ থাকেনা। তাই এ মৌসুমে ঘাস বিক্রি করে দিনে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা রোজগার হয়।
গোবিন্দাসী বাজারের ঘাস বিক্রেতা মোতালেব বলেন, আমরা গরিব মানুষ। বর্ষা এলে কাজ না থাকায় ঘাস আর মাছ বিক্রির টাকায় আমাদের সংসার চলে। চলে ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখাও। সকাল সকাল বাজারে এলে বিক্রি হওয়া ঘাস পৌঁছে দিয়ে প্রতিদিন নৌকার খরচ বাদে গড়ে ৫০০-৬০০ টাকা উপার্জন করি।
ঘাস পরিবহনে নিয়োজিত ভ্যানচালক লোকমান হোসেন বলেন, যমুনার মধ্যভাগে জেগে ওঠা নতুন চরে এমনিতেই অনেক প্রকার ঘাস জন্মে থাকে। তাছাড়া চরাঞ্চলে ঘাস চাষও ভালো হয়। এছাড়া যমুনা তীরবর্তী এলাকায় সাধারণত গো-খাদ্যের সংকট থাকেই। এ কারণে ঘাটে ঘাটে ঘাস বিকিকিনির বাজার গড়ে ওঠেছে।
নলীন বাজারে ঘাস ক্রেতা নাজমুল, শাহজাহান, আরিফ আকন্দসহ অনেকেই বলেন, তাদের ৪-৭টি গবাদীপশু রয়েছে। সাধারণত বর্ষা মৌসুমে গো-খাদ্যের সংকট বেশি থাকে। অন্য সময়ও চরাঞ্চলের ঘাসই তাদের মূল ভরসা। তারা নলীন বাজার থেকে নিয়মিত ঘাস কেনেন।
নদী তীরঘেষা গোপালপুরের হেমনগর ইউপি চেয়ারম্যান রওশন খান আইয়ুব, ভূঞাপুরের ফলদা ইউপি চেয়ারম্যান সাইদুজ্জামান তালুকদার দুদু, গোবিন্দাসী ইউপি চেয়ারম্যান দুলাল হোসেন চকদার ও কালিহাতী উপজেলার গোহালিয়াবাড়ী ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল হাই আকন্দ জানান, চরাঞ্চলের মানুষের জীবনধারণ আসলে খুব কষ্টের। নদী তীরবর্তী এলাকার গো-খাদ্যের যোগান দিতেই মূলত ঘাসের বাজারগুলো গড়ে ওঠেছে। এসব বাজারকে কেন্দ্র করে চরাঞ্চলের তিন শতাধিক পরিবার জীবিকা নির্বাহ করছে। প্রতিদিন চর থেকে ঘাস কেটে আটি বেধে তারা ঘাসের বাজারে এনে বিক্রি করছেন।