২০১৭ সাল! হঠাৎ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরির হিড়িক তোলেন বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার কিছু রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধি। বেসরকারি প্রাথমিকে চাকরি দেয়া হবে এমন টোপ ফেলে নিজেদের মধ্যেই অর্থাৎ রাজনৈতিক নেতাদের মাঝে। এসময় অনেকেই এই সুযোগ লুফে নিতে নিজেদের মধ্যে অর্থাৎ চাকরি প্রত্যাশিদের মধ্যে মন ধরাধরিও হয়। তবে টাকার অংকে যারা এগিয়ে ছিল তারাই পেয়েছিলেন এই সুবর্ণ সুযোগ। বর্তমানে ২০২৩ সালের অদ্যবদি এসব প্রতিষ্ঠানে কারোই নিয়োগ হয়নি। অর্থাৎ অর্থ হাতিয়ে নিতে মৌখিকভাবে নেতারা নিয়োগ দিলেও সরকারীভাবে কোনও স্বীকৃতি পায়নি এই শিক্ষকেরা। এসব শিক্ষকদের মধ্যে বেশ কয়েকজন বিত্তশালী হলেও কিছু অসহায় ব্যক্তিও রয়েছে। তারা লাখ লাখ টাকা দিয়ে এই ৬ বছরে পথে বসে গেছেন। তাতেও টনক নড়েনি অভিযুক্তদের তারা এখনো আশা দিয়ে মূল্যবান সময় পার করছেন এসব অসহায় শিক্ষকদের। ইতিমধ্যে এই শিক্ষকদের সরকারী চাকুরির বয়সের সময় সীমা পার হয়ে গেছে। সামনের দিনগুলো অন্ধকারই দেখছেন তারা।
এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর নামও রয়েছে। রয়েছে ছাত্র, শিক্ষকসহ নানা ধরনের কার্যক্রম। তবে এসব কাগজে কলমে থাকলেও বাস্তবে কিছুই নেই। বিরল এই ঘটনার স্বাক্ষী হয়ে আছে দুই একটি কুড়ে ঘর ও ঝুপরি ঘর। ২০২১ সাল পর্যন্ত এসব ঘরগুলোর সামনে মস্তবড়-বড় সাইনবোর্ড দেয়া ছিল তবে বর্তমানে এসবের কিছুই নেই।
বিদ্যালয়গুলো হল চর খাটিয়ামারি সাহাদারা মান্নান বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দক্ষিণ আগুনিয়াতাইর সাহাদারা মান্নান বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, জয়িন্তের পারা বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শিচারপাড়া বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ আরো কয়েকটি। এগুলোর মধ্যে সোনাতলা পৌর এলাকার দক্ষিণ আগুনিয়াতাইর গ্রামের দক্ষিন পাশে রাস্তার ধারে একটি টিনসেড ঘর ছিল। এই ঘরটিকে উন্নিত করে বর্তমানে দুই রুম বিশিষ্ট একটি ইটের ঘড় তৈরি করা হয়েছে। ২০২১ সাল পর্যন্ত এখানে একটি মস্তবড় সাইনবোর্ডে লেখা ছিল দক্ষিন আগুনিয়াতাইর সাহাদারা মান্নান বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। তবে গত দুই বছর ধরে সাইনবোর্ডটি আর নেই। চর খাটিয়ামারিতে রয়েছে একটি ঝুপড়ি ঘর। শিচারপাড়া ও জয়িন্তেরপাড়াতেও একই অবস্থা। প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিটিতে অন্তত ৩/৪ জন শিক্ষক নিয়োগের নামে কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে কিছু জন প্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতার নামে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে নাম এসেছেন মধুপুর ইউনিয়েনের সাবেক চেয়ারম্যান ও সোনাতলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অসিম কুমার জৈন নতুনের নাম।
ভুক্তভোগিদের মধ্যে রতন কুমার সাহা নামের এক ব্যক্তি বলেন। ২০১৭ সালে ২৯ শতক জমি বিক্রয় করে ১০ লক্ষ টাকা দেই অসিম কুমার জৈন নতুনকে সে সময় দ্রুত টাকা সংগ্রহের তাগিদে ঐ জমি মাত্র ২লক্ষ ৯০ হাজার টাকায় বিক্রয় করি বর্তমানে তার দাম প্রায় কোটি টাকা। সেসময় থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত আমার স্ত্রী প্রতিনিয়ত দুর্গম যমুনার চরে প্রথমে মোটর সাইকেল যোগে নদীর ঘাট পর্যন্ত পৌছে, পরে নৌকা ও কোন কোন সময় পায়ে হেটে যমুনা চরের বালির মধ্যে দিয়ে কয়েক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে নিয়মিত স্কুলে যেতো কিন্তু পরে এই বিদ্যালয়গুলো নিয়ে নানা ধরনের সমালোচনা ও গুঞ্জন শুরু হলে আমি বিভিন্ন দপ্তর ও ব্যক্তির সাথে কথা বলে জানতে পারি যে, এসব বিদ্যালয় কখনেই সরকারেও আওতায় আসবেনা। এর পর থেকে আমার স্ত্রী বিদ্যালয়ে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। তখন থেকেই আমি সমুদয় টাকা ফেরত চাওয়ার জন্য নানাভাবে ধরনা দিলেও এখন পর্যন্তও আশায় আশায় রেখেছেন অসিম কুমার জৈন নতুন দাদা। এই টাকাগুলো দেয়ার পর থেকে আমি ঋনগ্রস্ত হয়ে গেছি। বিভিন্ন এনজিও থেকে টাকা নিয়ে দেনা টানতে টানতে আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আওয়ামী লীগ নেতা বলেন আমি একেবারেই গরিব ও অসহায় পরিবারের সন্তান। আমি সারা জীবন দলের পেছনে সময় দিয়ে গেলাম। সেই আলোকেই বলছিলাম একটা চাকুরি দেয়ার জন্য কিন্তু অর্থ ছাড়া আমারটাও হয়না। এক পর্যায়ে উপজেলার শীর্ষস্থানীয় নেতা ও বর্তমান সাংসদ সাহাদারা মান্নান আপার সরনাপন্ন হলে তিনি বলেন অসিম কুমার জৈন নতুনের সাথে কথা বল। তাই কোন পথ না পেয়ে আমার পরিবারের সদস্যদের সাথে নিয়ে দাদার সাথে কথা বলার এক পর্যায়ে টাকার কথা উঠে আসে এসময় দাদা বলেন অন্যদের কাছে থেকে বেশি করে নিলেও তুমি মাত্র ১০ লক্ষ টাকা দাও। পরে আমি আমার বাবা, মা, কাকাসহ আরো কয়েকজন দাদার বাসায় যাই এসময় দাদা অনুপস্থিত থাকার কারণে তার বড় ভাই ইশ^র দাদার কাছে টাকা দিয়ে যেতে বলে। সে অনুয়ী ১০ লক্ষ টাকা তার কাছে দিয়ে আসি। ধার দেনা করে এতগুলো টাকা দেয়ার পর থেকে আমার পরিবারটি নিঃশ হয়ে গেছে। আমি দল করি, দলকে ভালোবাসি তাই এই ঘটনার জন্যে আমার করার কিছুই নেই। তবে নেতাদের কাছে আমার অনুরোধ থাকবে টাকাগুলো আমাকে দ্রুত ফিরে দেয়ার জন্য।
কথা হয় সোনাতলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক ও বর্তমান সহ-সভাপতি নবীন আনোয়ার কমরেডের সাথে। তিনি বলেন, বিষয়গুলো এতদিন গোপনই ছিল তবে দীর্ঘদিন হবার কারনে এসব কথা এখন মাথা চাড়া দিচ্ছে। এই বিদ্যালয়গুলো কন্টিনিউ করতে অনেক টাকা খরচ হয়েছে আমাদের। এখনো আমরা আশা ধরেই আছি কি হবে জানিনা। তবে আমাদের কিছু নেতাদের ব্যক্তিগত স্বার্থের রোষানলে পড়ে অনেকেরই ক্ষতি হয়ে গেছে। তাই আমিও তাদের কাছে অনুরোধ করবো এসব বিষয়গুলো দ্রুত সমাধান করতে। কারণ আমাদের নিজেদের নিজেদের মধ্যে যেনো আর কোন গন্ডগোল তৈরি না হয়।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত অসিম কুমার জৈন নতুনের সাথে কথা বললে তিনি বলেন। যেসব টাকা নেয়া হয়েছে, তা আমাদের কিছু বড় নেতাদের নির্দেশেই নেয়া হয়েছে। তবে এসব টাকা কারো পকেটে ওঠেনি বরং প্রতিষ্ঠান তৈরিতেই খরচ হয়েছে। তিনি আরো বলেন আমরা আশাবাদি এসব প্রতিষ্ঠান অতি দ্রুই সরকারিকরণ হয়ে যাবে।
এ বিষয়ে বিভিন্ন সময় সোনাতলা উপজেলার সদ্য বিদায়ী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা রবীন্দ্রনাথ সাহার সাথে কথা বললে তিনি বলেন। এসব বিদ্যালয়ের কোন তথ্যই আমার কাছে নেই এমনকি তালিকাতেও নাম নেই। তিনি আরো বলেন এসব বিদ্যালয়ে যদি কেউ চাকরির জন্য টাকা দিয়ে থাকে তাহলে সেটি তাদের একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। কারণ নতুন করে কোন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হওয়ার আর কোন সুযোগ নেই। তাই অদৌ এসব স্কুল নিয়ে দৌড়া দৌড়ি করে কোন লাভ হবেনা। প্রতিবছর বই বিরতণ করা হয় বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন এটি আমার জানার বাহিরে। তবে কিছু অসাধু কর্মকর্তার জন্য এমন ঘটনা ঘটে থাকলে তা অত্যন্ত দুঃখজনক।
বর্তমান সোনাতলা উপজেলার ভারপ্রাপ্ত শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ এনায়েতুর রহমানের সাথে কথা বললে তিনি বলেন। এ রকম কিছু স্কুল আছে যারা অনলাইনে রেজিষ্ট্রেশন করে। সেই কারনেই তাদের বই বিতরণ করা হয় কিন্তু কিছুদিন পূর্বে এই বিদ্যালয়গুলো পরিদর্শন করতে গিয়ে যা দেখলাম তাতে এগুলোতে বই বিতরণের মত কোন অবস্থা নেই। অর্থাৎ এগুলো এখন নিস্ক্রিয়। আগামিতে এসব প্রতিষ্ঠানে কোন বই দেয়া হবেনা। তিনি আরো বলেন বিগত দিনে কিছু রাজনৈতিক নেতাদের চাপে পড়ে বই দিতে হয়েছে, তবে আর না। এই শিক্ষা কর্মকর্তা বলেন নতুন করে আর কোন প্রতিষ্ঠান সরকারি হওয়ার কোন সুযোগ নেই। বিগত দিনে এসব প্রতিষ্ঠানে বই বিতরণ নিয়ে যা ঘটেছে তা আসলেই খুব দুঃখজনক।
বগুড়া জেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ জাভেদ আকতারের সাথে কথা বললে তিনি বলেন। নতুন করে কোন প্রাথমিক বিদ্যালয় করার চিন্তা সরকারের মাথায় নেই। অর্থাৎ আমার জানা মতে নতুন করে কোন প্রাথমিক বিদ্যালয় হবেনা। তাই এসব নিয়ে যদি কেউ নিয়োগ বানিজ্য এবং অসাদুপায়ে অর্থ হাতিয়ে নিয়ে থাকেন তাহলে এটি তাদের একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। এসবের দায়ভার আমরা কখনেই নিবনা। বই বিতরণের ব্যাপারে জানতে চাই তিনি বলেন। বিষয়টি তদন্ত করা হবে সত্যতা পেলে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।