ঢাকা, শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ই আশ্বিন ১৪৩১
কৃষকদের মুক্তিতে গণজাগরণ গড়ে তোলার আহবান

বগুড়ায় কৃষক সমিতির চর্তুদশ জাতীয় সন্মেলন

বগুড়া প্রতিনিধিঃ | প্রকাশের সময় : বৃহস্পতিবার ১৬ ফেব্রুয়ারী ২০২৩ ০৭:২৭:০০ অপরাহ্ন | দেশের খবর

বাংলাদেশ কৃষক সমিতির জাতীয় সন্মেলনে কৃষকদের মুক্তিতে মুক্তিযুদ্ধের মতো নতুন গনজাগরণের আহবান জানিয়ে বক্তারা বলেছেন, কৃষকদের গ্রামে গ্রামে ঐক্যের দুর্গ গড়ে তুলতে হবে। মধ্যসত্বভোগীদের হাত থেকে কৃষকদের ফসল রক্ষা করার বিকল্প নেই। কৃষকদের জমি রক্ষায় দৃঢ় আন্দোলন গড়তে হবে। সকলকে শোষক লুটেরা গোষ্ঠির বিররুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান জানিয়ে বক্তারা বলেন, অর্থনীতি থেকে সমাজ ব্যবস্থা সবক্ষেত্রেই দেশ আজ দু’ভাগে বিভক্ত। সরকার ও বিএনপি’র দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, দেশ আজ আপদ ও বিপদের মধ্যে। এজন্য কৃষকদের জাগতে হবে সকল প্রগতিশীল শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে গনজাগরণ তুলতে হবে।

বৃস্পতিবার বগুড়া আলতাফুন্নেছা খেলার মাঠে বাংলাদেশ কৃষক সমিতির চর্তুদশ জাতীয় সন্মেলনে বক্তরা তীব্র কৃষি আন্দোলন গড়ে তোলার ডাক দেন। বিকালে কৃষি কৃষক ও দেশ বাঁচাও শ্লোগানে অনুষ্ঠিত সন্মেলনের উদ্বোধনী ঘোষণা দেন গাইবান্ধার বাগদাফার্ম ভুমি আন্দোলন নেতা বিমল কিসকু। বাংলাদেশ কৃষক সমিতির কেন্দ্রীয় সভাপতি এসএমএ সবুরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সন্মেলন উপলক্ষে সমাবেশ পরিচালনা করেন সাধারণ সম্পাদক কাজী সাজ্জাদ জহির চন্দন। বক্তব্য রাখেন, বাংলদেশের কমিউনিস্ট পার্টির(সিপিবি) সভাপতি মোঃ শাহ আলম, সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, ক্ষেত মজুর সমিতির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন রেজা, সন্মেলন প্রস্তুত কমিটির চেয়ারম্যান নিমাই  গাঙ্গুলি, আবিদ হোসেন, বগুড়া জেলা সিপিবি’র সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ফরিদ কৃষক সমিতির জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক হাসান আলী প্রমুখ। বিদেশী অতিথিদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ কৃষক শাখার সম্পাদক তরিত কুমার চক্রবর্তী, জার্মান কৃষক নেতা গার্ড জিটনার ও নেপালের ভৈরব রাজ রিগমী।

সিপিবি সভাপতি মোঃ শাহ আলম বলেন, মধ্যসত্বভোগীদের হাত থেকে কৃষকদের ফসলকে রক্ষা করতে হবে। কৃষকদের সংকট আজ জাতীয় সংকটে পরিণত হয়েছে। যে অর্থনীতিতে দেশ পরিচালিত হচ্ছে তা কৃষকদের শোষন করছে। কৃষকদের রক্ষায় তীব্র গণ সংগ্রাম গড়তে হবে। সাবেক সভাপতি মুজাহেদুল ইসলাম সেলিম বলেন,দেশ দু’ ভাগে বিভক্ত। একদিকে মুষ্টিমিয় কৃষক অন্যদিকে আপামর জনগন দেশে পুর্জিবাদী শাসন চলছে। শাসন ব্যবস্থা থেকে লুটেরা গোষ্টিকে সরাতে হবে। ভোটারদের ভোটাধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। দলীয় সরকারের অধীনে আর নির্বাচন নয়। পরে এক বর্ণাঢ্য র‌্যালী শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিন করে। 

সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) সভাপতি কমরেড মোঃ শাহ আলম, সিপিবির সাবেক সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম নেতা কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, ক্ষেতমজুর সমিতির সাধারণ সম্পাদক এড আনোয়ার হোসেন রেজা, সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির চেয়ারম্যান কমরেড নিমাই গাংগুলি, সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহবায়ক আবিদ হোসেন, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি সিপিবি বগুড়া জেলার সাধারণ সম্পাদক কমরেড আমিনুল ফরিদ, বাংলাদেশ কৃষক সমিতি বগুড়া জেলার সাধারণ সম্পাদক হাসান আলী শেখ। 

সম্মেলনে বিদেশি অতিথিদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, ভারতের সিপিআই এর সদস্য সারা ভারত কৃষক সভার জাতীয় পরিষদ সদস্য ও পশ্চিমবঙ্গ কৃষক শাখার সম্পাদক তরিত কুমার চক্রবর্তী, এম.এল.পি.ডি প্রতিনিধি ফার্মাস অর্গানাইজেশন জার্মানির গার্ড জিটনার, নেপালের অল নেপাল পিপলস ফেডারেশন (এপিএফএ) এর সভাপতি ভৈরব রাজ রীগমি, ইনচার্জ পিজেন্টস উইমেন সংগঠন (এপিএফএ) এর সাবিত্রা ডাখাল রিগমী। 

এছাড়াও সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ মনজুরুল আহসান খান, শাহাদাৎ হোসেন, সিপিবির সহ সাধারণ সম্পাদক কমরেড মিহির ঘোষ, মাহবুব আলম, লক্ষী চক্রবর্তী, রথিন চক্রবর্তী, সহিদুল্লাহ সবুজ সহ ছাত্র, যুব সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।

 

কৃষক সমিতির সভাপতি এড. এস এম এ সবুর বলেন, 'কৃষকের সংকটকে তুলে ধরতে এবং কৃষকদের বাঁচাতেই আমাদের এই লড়াই। কৃষি, কৃষককে বাঁচাতেই আমাদের এই সম্মেলন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে কৃষকের দাবিসম‚হকে সামনে নিয়ে আসাই আমাদের অন্যতম লক্ষ্য।'

সম্মেলনে সিপিবি'র সংগ্রামী সভাপতি এবং কৃষক আন্দোলনের অন্যতম নেতা কমরেড মোঃ শাহ আলম বলেন, কৃষকের সংকট আজ জাতীয় সংকটে পরিণত হয়েছে। দেশে আজ লুটেরা শ্রেণীর রাজত্ব চলছে। যে অর্থনীতিতে দেশ পরিচালিত হচ্ছে সেই অর্থনীতি শোসন করছে কৃষকদের। প্রতিটি গ্রামে গ্রামে কৃষকেরা স্বর্বস্বান্ত হয়ে যাচ্ছে। কৃষক তার ফসলের লাভজনক দাম পায়না। নানামুখী সংকটে জর্জরিত কৃষক। বৈষম্যের শিকার এই কৃষকদের মুক্ত করতে তীব্র গণসংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে '।

সিপিবির সাবেক সভাপতি এবং ক্ষেতমজুর আন্দোলনের অন্যতম নেতা জননেতা কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, 'দেশ আজ দুভাগে বিভক্ত। একদিকে মুষ্টিমেয় শোসক, অন্যদিকে আপামর জনগন। প্রতিদিন রাষ্ট্রের টাকা পাচার হয়ে গেছে। গত ১১ বছরে ১১ লক্ষ কোটি টাকা পাচার পাচার হয়ে গেছে। এই টাকা সাধারণ জনগণের টাকা। বর্তমান বাজার ব্যবস্থা হলো পুজিবাদী। এই বাজার জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করছে। যারা লক্ষ্যকোটি টাকা ঋন নিয়ে ফেরত দিতে না পারলেও তাদেরকে আবারও ঋন দেয়া হয়। আর কৃষক পরিশোধ করতে না পারলে তাদের কোমড়ে দড়ি বাধতে হয়। সরকার নানাভাবে জনিগনকে ভাওতাবাজি করে। তাই এ থেকে মুক্ত হতে উতপাদনের এবং ক্রেতার সমবায় গড়ে তুলতে হবে। এজন্য শাসন ক্ষমতা থেকে লুটেরা শ্রেনীকে ক্ষমতা থেকে সরাতে হবে। আজ শত শত হাওয়া ভবন তৈরি হয়ে গেছে। বামপন্থীদের সরকার প্রতিষ্ঠা করার মধ্য দিয়েই এ লড়াইকে অগ্রসর করতে হবে'।

প্রবীন রাজনীতিবিদ শাহাদাৎ হোসেন বলেন, কৃষকের রুটি রুজির সংগ্রামকে অগ্রসর করতে হবে। অতীতের ত্যাগ তিতিক্ষাকে স্মরণ করার দিন। কৃষকের দুর্দশা থেকে মুক্ত করতে লড়াইকে অগ্রসর কর্েয হবে।

 

ক্ষেতমজুর সমিতির সাধারণ সম্পাদক এড আনোয়ার হোসেন রেজা বলেন, ১৪ বছরে ১২ বার বিদ্যুৎ এর দাম বেড়েছে কিন্তু কৃষক ফসলের দাম পাচ্ছে না। এখন জনগনের বেচে থাকাই কষ্টকর হয়ে গেছে। কৃষক তার ধান, আলু রাস্তায় ফেলে দিয়েছে। যারা অন্ন যোগায় তাদের কোন ম‚ল্য নেই। উন্নয়ন তাহলে কার জন্য? তেভাগার আন্দোলনের মতন দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।

কৃষক সমিতির সহ সভাপতি নিমাই গাংগুলি বলেন, উত্তর জনপদে সেচের পানির অভাবে কৃষক মারা যাচ্ছেন। এই সম্মেলন অধিক গুরুত্বপ‚র্ণ। 

কৃষক সমিতির সহ সাধারণ সম্পাদক আবিদ হোসেন বলেন, চারপশে কৃষি ও কৃষককে চরম দুর্দশার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। লুটপাটের সমাজব্যবস্থা গ্রামীন ব্যবস্থাকে ভেংগে দিচ্ছে। এ ব্যবস্থা পাল্টাতে হলে তীব্রতর লড়াই অগ্রসর করতে হবে।

কমিউনিস্ট পার্টি বগুড়া জেলার সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ফরিদ বলেন, কমিউনিস্ট পার্টি কৃষক সমিতির সম্মেলনে যারা সহযোগিতা করেছেন তাদেরকে শুভেচ্ছা জানাই।

হাসান আলী শেখ বলেন, কৃষকের দুর্দশার শেষ নেই। লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের লড়াইকে অগ্রসর করবো। 

নিম্নলিখিত দাবিসম‚হ সামনে রেখে কৃষক সমিতির চতুর্দশ জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। (১) ভ‚মিহীন কৃষকসহ প্রকৃত উৎপাদক কৃষককে কৃষি কার্ড দাও। (২) ফসলের লাভজনক দাম চাই। ইউনিয়ন পর্যায়ে সরকারি ক্রয়কেন্দ্র চালু করে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান ক্রয় কর। পর্যাপ্ত সংখ্যক খাদ্য গুদাম ও হিমাগার নির্মাণ কর। (৩) জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা ও ফসলের সর্বোচ্চ উৎপাদন নিশ্চিত করতে হবে। সরকার নির্ধারিত দামে কৃষকদের চাহিদামতো সার দিতে হবে। কৃষি উপকরণের বাজার সিন্ডিকেট ভাঙো। বিএডিসি সক্রিয় কর। কৃষক সমবায় বাজার ব্যবস্থা চালু কর। পল­ী রেশন ও শস্য বীমা চালু কর। ষাটোর্ধ্ব কৃষকদের পেনশন চালু কর। (৪) সাশ্রয়ী ম‚ল্যে ভেজালমুক্ত পোল্ট্রি, মৎস্য, পশুখাদ্য ও ঔষধ দিতে হবে। (৫) অবিলম্বে আম‚ল ভ‚মি সংস্কার কর ও ভ‚মি ব্যবহার নীতিমালা কার্যকর কর। (৬) অপরিকল্পিত নদী খনন, অবৈধভাবে বালু উত্তোলন ও নদী-খাল-বিল দখল বন্ধ কর। নদী খননের মাটি দিয়ে কৃষি জমি ভরাট করা বন্ধ কর। নদী সিকস্তি অঞ্চলসহ সারাদেশে ভ‚মিহীন কৃষকের মাঝে খাস জমি বিতরণ কর, জেগে ওঠা জমির দিয়ারা জরিপ করে সিলিং অনুযায়ী প্রকৃত কৃষকদের জমি ফেরত দাও। (৭) বরেন্দ্র অঞ্চলে সেচ ব্যবস্থায় অনিয়ম-হয়রানি-দুর্নীতি বন্ধ কর। (৮) উপক‚লীয় অঞ্চলের কৃষি ও কৃষক বাঁচাতে পরিকল্পিত ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ কর। লবণাক্ততা থেকে কৃষি জমি ও মানুষকে রক্ষা কর। (৯) হাওর অঞ্চলের পরিবেশ, প্রকৃতি, জীববৈচিত্র ও কৃষি রক্ষা কর। কৃষকদের জীবন- জীবিকা নিশ্চিত কর। প্রকৃত মৎস্যজীবীদের মাছ ধরার অধিকার দাও। (১০) ভ‚মি অফিস ও পল­ী বিদ্যুতের অনিয়ম-হয়রানি-দুর্নীতি বন্ধ কর।

আজ শুক্রবার শহীদ টিটো পৌর মিলনায়তনে কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে। 

 

বক্তৃতা পর্ব শেষে লাল কাপড়ে কৃষকের প্রতীক কাস্তে এবং লাঙ্গল খচিত হাজার হাজার পতাকা, কৃষকের দাবীসম্বলিত শত ফেস্টুন-প্ল্যাকার্ড, ব্যানার, কৃষকের মাথাল, কোদাল, কাস্তে, লাঙ্গল, আদিবাসী কৃষকদের লোকজ সাজসজ্জা সম্বলিত বিভিন্ন উপকরণে সজ্জিত হয়ে প্রায় পনের হাজার কৃষকের একটি র্যা লি বগুড়া শহরের প্রধান সড়কগুলো প্রদক্ষিণ করে। সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প‚র্বে এবং র‌্যালী শেষে খুলনা, যশোর ও অন্যান্য জেলার উদীচী শিল্পী গোষ্ঠির শিল্পীবৃন্দ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।