ঢাকা, মঙ্গলবার ৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯শে অগ্রহায়ণ ১৪৩১

বাজারি গরমের পোস্টমর্টেম: সরওয়ার আহমদ

Author Dainik Bayanno | প্রকাশের সময় : শনিবার ১৩ এপ্রিল ২০২৪ ০৯:৪২:০০ অপরাহ্ন | সিলেট প্রতিদিন

"এই গরমে গেলোরে ভাই দেশটা / আমি ভেবে ভেবে হলেম সারা,পেলামনা তার শেষটা"! ষাটের দশকে বড়লেখার পন্ডিত কবি নাট্যকার ও শিক্ষক প্রয়াত বদরুল হক চৌধুরী শাস্ত্রী রচিত নাটক "পল্লী দর্পণ" এর উক্ত গানের কলির উপযোগীতা এখনও বোধহয় নিঃশেষ হয়ে যায় নি। ভূ প্রাকৃতিক গরম নয় ,বাজারি গরমে পুড়ছে দেশের নিম্ন বিত্ত এবং খেটে খাওয়া ৫০%ভোক্তা মহল। এই জ্বালাতো অনির্বচনীয় এবং অসহনীয়। ফ্রীস্টাইল এ বাজারি দৌরাত্ম্যের নিকট সরকারি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা দৃশ্যতঃ ব্যর্থ হবার পথে। সরকারি কলকব্জার একটি অংশ বাজার নিয়ন্ত্রণের পক্ষে যে নয়,এ সত্যটি ক্রমেই প্রচ্ছন্ন হয়ে উঠছে।এ ব্যাপারে বারান্তরে আলোচনার ইচ্ছা রইলো।


বাজারি আগুনে ঘৃতাহুতি দিলে এ আগুনতো বাড়বে বৈ কমার নয়।কি ভাবে এ আগুনের ব্যাপ্তি প্রসারিত হয় তা অনুমান বা ধারণার বাইরে নয়।তার প্রকৃস্ট উূাহরণ হচ্ছে সাম্প্রতিক রমজান এবং ঈদের হাটবাজার।সচেতনেকিংবা অবচেতনে বাজারি আগুনে কেরোসিন ঢালছে আমাদের সমাজেরই ভোক্তা মহলের একাংশ।শানে নজুল হাতড়ালে তাদের অবস্থান স্পস্ট হয়ে উঠবে। এরা কারা? উত্তর তালাশ করলে যাদের অবয়ব দর্পণে ভেসে উঠবে ,তারা হচ্ছে ঘুষখোর রাস্ট্রীয় কর্মচারী দুর্ণীতিবাজ রাজনীতিক ,ফঠকাবাজ ,কমিশনভোগী চোরাচালানী,মাদক ব্যবসায়ী ,মুনাফালোভী ও দাদন ব্যবসায়ী যারা রাতারাতি দারকিনা থেকে রাঘব বোয়লে পরিণত হয়েছে।এক শ্রেণীর প্রবাসীরাও তাদের দলভুক্ত ।টাকা তাদের নিকট মুড়িখই সমতুল্য। বাতাসে উড়নো যায় ,পানিতেও ছিটানো চলে।যেমনি ইচ্ছা তেমনি উড়ানোই হচ্ছে হাল আমলের টাকাওয়ালাদের কালিক বাহাদুরি।যে দামে কেনা সে দামে বিক্রি।


অতীত ঘাটলে দেখা যাবে - তাদের পূর্বসুরীদের অবস্থা ছিলো নূন অানতে পান্তা ফুরানোর দলভুক্ত। সাধ থাকলেও সাধ্যের অভাবে অনেক চাওয়া পাওয়ার ঘাটতি ছিলো তাদের জীবন খতিয়ানে।এখন দৈবচক্রে অবস্থার ধারণাতীত রুপান্তর অতীতের প্রতিশোধ নিচ্ছে বর্তমানের প্রেক্ষাপটে দাড়িয়ে।কমপানির মাছ বেশ পানিতে পড়ে শুধু ঘাঁইই দিচ্ছেনা ঢেউও তুলছে।দামের তোয়াক্কা না করে পণ্যক্রয়ের মধ্যেই তারা বাহাদুরি খুঁজে বেড়ায়।এ প্রবণতার পেছনে অতীতের কিছুটা যোগসূত্রও আছে। অতীতের "আছন্তরি" তথা স্বচ্ছলরা ভারভর্তি খর্চ সদাই করতেন নিজেদের অবস্থান জাহিরের নিমিত্তে।নীচ বর্গের লোকজন তাদেরকে যাতে সমীহকরে এটাও ছিলো তাদের মনোরথ।এ ধারাটিকে নবায়ন করতে চাচ্ছে নব্য ধনীরা।রিক্সা কিংবা সি এন জি বোঝাই করে বাজার সদাই করতে না পারলে কিসের বড়লোক কিংবা কিসের বাহাদুরি। দাম কোন ধর্তব্য বিষয় নয় । তাদের নিকটতো-money is no problem. এমতাবস্থায়  খুঁচরা ও পাইকারি বণিকরা প্ণ্য মূল্য হ্রাস করবে কোন দুঃখে? নির্দিস্ট পরিমাণ গ্রাহকতো তাদের হাতেই আছে।ভারসাম্য মূল্যে পাঁচ কেজি পরিমাণ পণ্য বিক্রি করে যে মুনাফা হয় সেই মুনাফা যদি এক কেজিতে আসে তাহলে বেশী পরিমান পণ্য বিক্রির তো দরকার নেই। বাজারে এই ফর্মুলাই এখন কার্য্যকর। যে কারণে স্বল্প বিত্তরা বাজারে খেই হারিয়ে ফেলায় নব্য টাকাওয়ালাদের জয়জয়কার সূচিত হয়েছে।


রমজান উপলক্ষে মুসলিম বিশ্বের সবদেশে পণ্যমূল্য হ্রাস পেলেও বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম।এখানে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির নেপথ্যে রয়েছে ব্যবসায়ীদের লোপাট মনোবৃত্তি। তার সাথে যুক্ত হয়েছে বিভিন্নশ্রেনীর ভোক্তাদের কান্ডঞ্জান হীনতা।রমজানের এক সপ্তাহ আগ থেকেই একশ্রেনীর ভোক্তা একমাসের খর্চপাতির জন্য বাজার মুখী হয়।তাদের ভীড়ে ও বাহাদুরিতে দোকানীরা বেসামাল হয়ে উঠে।সাথে সাথে পণ্যের মুল্যও বাড়িয়ে দেয়।এ দিকটায় গ্রাহকরা দরকষাকষির দরকার মনে করেনা। কারণ টাকাতো আসে গৌরি সেনের ভান্ডার থেকে।এ টাকারতো কোন মাপজোঁক নেই।এই গ্রাহক শ্রেনীর সাথে যুক্ত হয়েছে প্রবাসী পরিবারও।প্রবাসী পরিবার কর্তা কিংবা মেম সাহেব যখন বাজারে আসেন তখনতো ব্যবসায়ীদের পোয়াবারো।মাথার ঘাম পায়ে ফেলে প্রবাসীরা কিভাবে দেশে টাকার যোগান দেন সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নাকরে তারা হয়ে উঠেন চৌকষ বাজারি। জাহির করেন নিজেদের বড়ত্ব।এমতাবস্থায় বাজারি আগুণের তেজ আরও বাড়ে।


বাজার পর্য্যবেক্ষণ করতে গিয়ে দেখা গেছে প্রবাসীদের খয়রাতের দিকটাও।বিত্তহীন রোজাদারকে চাল ডাল ছোলা সোয়াবিন ময়দা খেজুর সেমাই ও চিনি দেওয়া হয় প্যাকেটবন্দী করে।গ্রামের একজন প্রবাসীর এ বদান্যতা দেখে অন্য প্রবাসীও দানশীলের খাতায় নাম লিখাতে আগ্রহী হয়ে উঠেন। অবস্থাদৃস্টে মনে হয় ,এ যেনো এক প্রতিদ্বন্দিতা। ব্যক্তি ছাড়াও এ ধরণের যৌথ উদ্দ্যোগও আছে সমান্তরাল ভাবে। তাই রমজানের ২/৩ দিন আগেই বড় বড় দোকান সমূহে পণ্যক্রয় এবং প্যাকেটিং এর ধুম পড়ে যায়।তাতে পণ্যের দাম বাড়ে না কমে? ট্রাক কিংবা পিকআপ ভর্তি এ সমস্থ খয়রাতি পণ্য আনুস্টানিকভাবে বন্টনের চৌকষ আয়োজনতো আছেই। তাতে খয়রাত ও আনুস্টানিকতা একাকার হয়ে যায়।বাংগাল মুল্লুক বলে কথা! এখানে ক্রিয়ার পেছনে প্রতিক্রিয়াও ঘুরে বেড়ায়। জনান্তিকে প্রস্ন উঠেছে -বারো মাসের মধ্যে মাত্র একমাস রমজান। বাকী এগারো মাস কথিত মিসকিনরা কিভাবে দিনাতিপাত করে সেটি রমজানি দাতারা কি খবর রাখেন?ঘটা করে যে পণ্য সামগ্রী দেওয়া হয় তাদিয়েই কয়দিন চলে? মাঝখানে ঘুরে বেড়ায় -দিল্লীকা লাড্ডু যোভি খায়া সোভি পস্তায়া,যোভি নোখায়া তোভি পস্তায়া।যে খয়রাত পেলো সে ভাবে কম পেয়েছি যে পায়না সে বলে -মুখ চিনে মুগের ডাল বণ্টন করা হয়েছে।দানশীলতা আবর্তিত হয় বিতর্কের ঘেরাটোপে।তাই এটির বিকল্প চিন্তার প্রয়োজন।


শুরু করেছিলাম বাজারি আগুন দিয়ে।এ কথাটি মেনে নেয়া সত্য যে উপমহাদেশের কয়েকটি রাস্ট্রের মধ্যে বাংলাদেশই একমাত্র রাস্ট্র যেখানে পণ্যদ্রব্যের মূল্য সব চাইতে বেশী এবং লাগামহীন।মূল্যস্ফীতির দাবানলে জর্জরিত আফগদনিস্তান ও শ্রীলঙ্কা বাজার পরিস্থিতিকে  দক্ষতার সাথে সামাল দিলেও আমরা পারিনি।বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারি উদ্দ্যোগ আসলেই কি যথাযত ,এ প্রশ্নের পাশাপাশিবলিরেখার মতো যে প্রস্ন মাথাচাড়া দিতে চাচ্ছে ,সেটি হচছে -বাজার নিয়ন্ত্রণে রাস্টযন্ত্র কি ব্যর্থ? সরকার আরোপিত কোন নির্দেশাবলিই ব্যবসার ক্ষেত্রে কার্যকর হচছে না।যদি ব্যর্থতাই ললাট লিখন হয়ে থাকে তাহলে পরিস্থিতি কোন দিকে আগাচ্ছে? সমাজের গরিস্ট সংখ্যক ভোক্তা মহলকে ভারবাহী গর্দভ গণ্যকরে লুটেরা ব্যবসায়ী মহল মূল্যের বোজা তাদের কাঁধে চাপিয়ে দিচ্ছে। এখন তাহা সহ্যসীমার বাইরে চলে যাওয়াতে প্রতিবাদের সুর উঠতে শুরু করেছে ।এ সুর যদি কুন্ডলী পাঁকায় তাহলে তা কোন দিকে মোড় নিবে ,তা বলা মুশকিল।অনির্বাপিত  আাগুণ খাটালে ঘুরপাক খাওয়ার পর চালে উঠে গেলে  সেটি গৃহদাহের রূপ নেয়।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।