ঢাকা, শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ই আশ্বিন ১৪৩১

ভালবেসে দুই যুগ একসাথে নীল-গীতা দম্পতি

ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি: | প্রকাশের সময় : মঙ্গলবার ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৩ ০১:২৯:০০ অপরাহ্ন | দেশের খবর
 
ছোটবেলা থেকে নানা কটু কথা শোনতে হয়েছে নীলকান্তকে।  উচ্চতায় ছোট হওয়ায় সবাই দেখত আলাদা চোখে। যেন মানুষের সাথে বসবাস করেও মনে হত আলাদা এক প্রাণী৷ অল্পতেই কথার আঘাতে ব্যাথা দিতেন প্রতিবেশীরা। এতে বাদ দেননি নিজের পরিবার ও আত্নীয় স্বজনেরা৷ 
 
মানুষের সব কথাকে উপেক্ষা করে জীবন তরী চালাতে পিছপা হয়নি নীল৷ সমবয়সীদের সাথে তাল মিলিয়ে করেছেন পড়াশোনাও৷ স্বপ্ন ছিল ভালো  চাকুরী করার। বাবার সমস্যায় এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে না পারায় সে স্বপ্ন আর আলোর মুখ দেখেননি। চাকুরির স্বপ্নে ব্যর্থ হলেও ভালবাসার স্বপ্নে সফল তিনি। সবাই যখন তার ভবিষ্যতে বিয়ে নিয়ে দুশ্চিন্তায় বিভোর। তখনি জীবনকে রঙিন করে সাজিয়ে নিতে আসেন গীতা রাণী। একই উচ্চতা আর মনের মিল হওয়ায় ভালবাসার শুরুটা হয় তাদের। 
 
কয়েকমাস একজন আরেকজনকে চেনা-জানার পর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হোন তারা৷ দুজনে উচ্চতায় ছোট হয়ে, সমাজের মানুষের কটু কথাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে একসাথে তারা৷ যেন ভালবাসার শ্রেষ্ঠ জুটির এক অনন্য নিদর্শন। সময়ে-অসময়ে এক সাথে থেকে ভালবাসার বয়স পেরিয়েছে ২৫ বছর৷ 
 
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার নারগুন ইউনিয়নের জোতপাড়া গ্রামের বাসিন্দা নীলকান্ত ও গীতা দম্পতি। সাংসারিক জীবনে এক মেয়ে সন্তানের পিতা-মাতা তারা৷ 
একসাথে দীর্ঘ দুই যুগ ধরে সংসার করছেন তারা। একজন যেন আরেকজনের পরিপূরক। হাজারো অভাবে ছেড়ে যাননি একে-অন্যকে। তাদের ভালবাসার এমন দৃষ্টান্ত নজর কেঁড়েছে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের৷ 
 
স্থানীয় প্রতিবেশী স্কুল শিক্ষিকা সাবিত্রী রাণী বলেন, তারা শুধুমাত্র দেখতে খাটো৷ এটিই তাদের একটা অপূর্ণতা। সবার জীবনেই একটা না একটা সমস্যা থাকে৷ তাদের জীবনে এরকমটাই ছিল৷ তবে তাদের যে মিল মহব্বত এটা অনেক বেশী৷ আমরা তাদের মাঝে কখনো বড় কোন সমস্যা দেখিনি। তারা সবসময় হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করে৷ তাদের মত স্বামী-স্ত্রী প্রতিটা সংসারে হওয়া উচিত। 
 
নীল ও গীতা দম্পতির মেয়ে লিপা বলেন, আমার বাবা-মা আমার জন্য অনেক কষ্ট করেছেন৷ আমাকে পড়াশোনা করিয়েছেন।  এখনো আমি যাতে করে আমার পরিবারকে নিয়ে সুখী হয় সেজন্য পরিশ্রম করেন৷ অনেকজনে আমার বাবা-মা কে নিয়ে কটাক্ষ করে। আমি কষ্ট পেলেও মনে করি আমার বাবা- মা সেরা। আর তাদের মধ্যে সম্পর্কে কোন ধরনের ফাটল নেই৷ 
 
নীলকান্তের বউ গীতা রাণী বলেন, আমরা একসাথে থাকতে পেরে অনেক খুশি। অভাব তো সবার সংসারে থাকে। আমাদেরও অভাব আছে৷ বাইরে কাজ করলে আমাদের পারিশ্রমিক কম দেওয়া হয়। তারপরেও থেমে তো আর থাকা যায়না৷ আমরা একসাথে ২৫ বছর ধরে আছি। বাকী সময়টা একসাথে কাটাতে চায়৷ 
 
নিজের সমস্যার কথাগুলোকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে নীলকান্ত বলেন, চার ভাই বোনের মধ্যে সবার ছোট আমি। হয়তো সৃষ্টিকর্তা আমাকে এভাবেই পৃথিবীতে বাঁচাতে চেয়েছেন৷ তিনি আমাকে ভাল রেখেছেন। মানুষের কটু কথা শোনেও আমি পড়াশোনা চালিয়ে গেছি। তবে সমস্যার কারনে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা হয়নি৷ তারপরে কাজ করে সংসার চালায়৷ এক মেয়ে আমার। তাকে পড়াশোনা করিয়ে বিয়ে দিয়েছি৷ বাবার দেওয়া ভিটেমাটি ছাড়া আর কিছু নেই৷ শুধু যে ঘরটিতে আমি থাকি সেটি আমার। বাবা-মায়ের ঘরটা মায়ের নামে৷ কিছুদিন আগে বাবা মারা গেছেন। মা আমার নামে জমিটা দিতে চান৷ তবে সেটি আমার নামে করে নেওয়ার মত কোন খরচ আমার নেই৷ কয়েক মাস আগে এক দোকানে থাকতাম। সেটা বাদ দিয়ে এখন দিনমজুরি করি৷ ঘরটাও আমার প্রায় ভাঙ্গা। টাকার অভাবে সংস্কার করতে পারছিনা৷ তারপরেও আমার স্ত্রী সঙ্গ দিয়ে আসছেন৷ কখনো তিনি আমাকে হতাশ করেননি। সবসময় আমাকে সার্পোট দিয়ে থাকেন৷ এটি আমার জীবনের বড় প্রাপ্তি। আর ঘর সংস্কারের জন্য আমাকে আপনারা সহযোগিতা করতে পারেন৷ 
 
নারগুন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সেরেকুল ইসলাম বলেন, তারা আমার ইউনিয়নে স্বামী-স্ত্রীর একটি সেরা জুটি। যদিও তারা পারিবারিক ভাবে অস্বচ্ছল। তবে তাদের যে সম্পর্ক এটি আলাদা দম্পতিদের জন্য শিখনীয়৷ তাদের প্রতিবন্ধী ভাতা করে দেওয়া হয়েছে৷ এ ছাড়াও আমরা চেষ্টা করি তাদের পরিবারের পাশে দাড়ানোর৷ তার এখন ঘর সংস্কারের দরকার। সকলে তার পাশে এগিয়ে আসা দরকার৷ 
 
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু তাহের মোঃ শামসুজ্জামান বলেন, তাদের ভালবাসার কথাগুলো শোনে বেশ ভালো লাগলো। তাদের দেখতে অনেক সুন্দর লাগছে। উপজেলা প্রশাসন তাদের পাশে সবসময় থাকবে৷