আন্তর্জাতিক ক্লিন এনার্জি দিবস-২০২৫ উপলক্ষে সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক)-খুলনা, টিআইবি এর আয়োজনে এবং পরিবেশবাদী সংগঠন বেলা, রুপান্তর, ক্লিন, পরিবর্তন, আইআরভি এবং পরিবেশ সুরক্ষা মঞ্চের সহযোগিতায় মানববন্ধন, র্যালি এবং আলোচনা সভার আয়োজন করে।
জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার হ্রাস এবং জ্বালানি খাতে দুর্নীতি বন্ধ এবং সুশাসন নিশ্চিত করার দাবিতে রোববার (২৬ জানুয়ারি) বিকাল ৩.০০ টায় খুলনা প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধনের আয়োজন করে।
মানববন্ধন শেষে টেকসই ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে বিভিন্ন পদক্ষেপের দাবিতে র্যালির আয়োজন করা হয়, র্যালিটি খুলনা প্রেস ক্লাবের সামনে থেকে শুরু হয়ে উমেশচন্দ্র পাবলিক লাইব্রেরিতে গিয়ে শেষ হয়। এরপর বিকাল ৪.০০ টায় উমেশচন্দ্র পাবলিক লাইব্রেরি অডিটোরিয়াম, খুলনাতে শুরু হয় দিবসের আলোচনা। সনাক খুলনার এর সভাপতি রমা রহমানের সভাপতিত্বে আলোচনা অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য ও দিবসের আলোচনা করেন সনাক-খুলনা এর পরিবেশ বিষয়ক উপ কমিটির আহবায়ক আধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির।
মানবন্ধনে বক্তারা বলেন- জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে রূপান্তরের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ হলেও বাংলাদেশ জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল। সরকারের বিভিন্ন পরিকল্পনায় নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনের যে সকল পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে তাতে বিভিন্ন ধরনের অসঙ্গতি ও অস্পষ্টতা এবং সমন্বয়হীনতা রয়েছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ও কৌশলগত অগ্রাধিকার খাতে বিবিধ অসঙ্গতি, সুশাসনের ঘাটতি, অনিয়ম এবং বিদ্যমান দুর্নীতি রোধ করার সাথে সাথে জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরতা কমিয়ে আনতে হবে।
অন্যদিকে আলোচনা সভায় দিবসের উপর আলোচনা করেন সনাক খুলনা এর পরিবেশ উপ কমিটির সদস্য জনাব গৌরাঙ্গ নন্দী, বেলা এর বিভাগীয় সমন্বয়ক মাহফুজুর রহমান মুকুল, আইআরভি এর নির্বাহী পরিচালক মেরিনা পারভিন যূথী, ক্লিন এর গবেষণা সমন্বয়ক রাহুল বিশ্বাস এবং পরিবেশ সুরক্ষা মঞ্চের সভাপতি এ্যাড. কুদরত-ই-খুদা। এছাড়া উপস্থিত ছিলেন এছাড়া উপস্থিত ছিলেন রূপান্তরের প্রতিনিধি, সনাক খুলনা এর সহ সভাপতি রীনা পারভীন, সনাক সদস্য, ইয়েস, এসিজি সদস্য এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিগণ। আলোচনা সভায় বক্তারা জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবাহার কমাতে হলে অবশ্যই সরকারের জালানি বিষয়ে যে সব নীতিমালা রয়েছে তা অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে, জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প যে সকল জ্বালানি রয়েছে, বিশেষকরে সোলার এর সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে হবে, তৃণমূল পর্যায়ে এটার সহজগম্যতা নিশ্চিত করতে হবে। এবং আমদানি শুল্ক কমাতে হবে এবং জ্বালানি খাতে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। সভায় আন্তর্জাতিক ক্লিন এনার্জি দিবসে টিআইবির ধারণাপত্রের ১২ দফা দাবি তুলে ধরা হয়।
১) জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভর বিদ্যমান জ্বালানি মহাপরিকল্পনা ‘ইন্টিগ্রেটেড এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ার মাস্টার প্ল্যান (আইইপিএমপি-২০২৩) ’ অনতিবিলম্বে বাতিল করতে হবে এবং জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস এবং জ্বালানি মিশ্রণে নবানয়নযোগ্য জ্বালানির পরিমাণ বৃদ্ধি- এমন মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে নতুন একটি মহাপরিকল্পনা তৈরি ও কার্যকর করতে হবে। এক্ষেত্রে-
- স্বার্থের দ্বন্দ্বমুক্ত বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞদের নেতৃত্বে এবং নাগরিক সমাজের মতামতের ভিত্তিতে জাতীয় নীতি ও আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে।
- জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভর প্রকল্পে অর্থায়ন ও এর ব্যবহার ক্রমান্বয়ে কমানোর জন্য সময়াবদ্ধ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে হবে।
- মহাপরিকল্পনায় জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা এবং জীবন-জীবিকা, প্রাকৃতিক সম্পদ ও পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়কে প্রাধান্য দিতে হবে।
- নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসারে একটি স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি সময়াবদ্ধ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে হবে।
- সম্ভাবনা যাচাই সাপেক্ষে উৎস ভেদে (সৌর, বায়ু ও জলবিদ্যুৎ, ওয়েস্ট টু এনার্জি) নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে হবে।
- ২০৪০ সালের মধ্যে মোট জ্বালানির ৪০ শতাংশ এবং ২০৫০ সালের মধ্যে শতভাগ জ্বালানি নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদনের একটি বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে।
২) জ্বালানি খাতে নীতি করায়ত্ত বন্ধ এবং স্বার্থের দ্বন্দ্ব প্রতিরোধসহ এ খাত সংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণ-প্রক্রিয়ায় জাবাবদিহি নিশ্চিতে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ গঠন করতে হবে।
৩) পরিবেশ আইনের আওতায় বিধিবদ্ধ করে সকল প্রকার জ্বালানি এবং বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য ত্রুটিমুক্ত পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিবীক্ষণ ও যাচাই নিশ্চিত করতে হবে এবং পরিবেশ ছাড়পত্র প্রদান এবং দূষণ ও পরিবেশ-বিষয়ক তদারকিতে স্বচ্ছ ও যথাযথ- প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে।
৪) নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে রূপান্তর-সংক্রান্ত কার্যক্রমে নেতৃত্ব প্রদানের জন্য টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (স্রেডা) কে একটি স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা প্রদানসহ এর কারিগরি, জনবল এবং অবকাঠামোগত সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে।
৫) জ্বালানি খাতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রতিযোগিতামূলক বাজার সৃষ্টিসহ বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) এর আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে। জ্বালানির দাম নির্ধারণসহ প্রতিষ্ঠানটির ম্যান্ডেট অনুসারে স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা প্রদান করতে হবে।
৬) আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক এবং দেশীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পাদিত জ্বালানি খাতের সকল প্রকল্প প্রস্তাব এবং চুক্তির নথি প্রকাশ করতে হবে।
৭) জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের প্রকল্প বাস্তবায়ন ও ক্রয় সম্পাদনে উন্মুক্ত-পদ্ধতি ব্যবহারসহ জাতীয় ক্রয় আইন ও নীতি পরিপূর্ণভাবে প্রতিপালন করতে হবে। এ খাতের সকল জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্রয় সম্পাদনে ই-জিপি পদ্ধতির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
৮) পরিবেশ সংবেদনশীল এলাকায় নির্মীয়মাণ কয়লা ও এলএনজি ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো স্থগিত করে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ কৌশলগত, সামাজিক ও পরিবেশগত সমীক্ষা সম্পাদন সাপেক্ষে অগ্রসর হতে হবে।
৯) এনডিসি’র অঙ্গীকার বাস্তবায়নে ইতোমধ্যে বাতিল হওয়া কয়লা ও এলএনজি বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণকৃত জমিতে সোলারসহ নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে।
১০) স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও জনঅংশগ্রহণ নিশ্চিত করে প্রকল্পের পরিকল্পনা, চুক্তির শর্ত নির্ধারণ, অনুমোদন এবং বাস্তবায়ন করতে হবে।
১১) নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রযুক্তির গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য তহবিল বরাদ্দ এবং গবেষণা ও শিল্পখাতের মধ্যে সহযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে।
১২) নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে রূপান্তর প্রক্রিয়ায় তরুণ সমাজের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করতে হবে।
বায়ান্ন/প্রতিনিধি/পিএইচ