ঢাকা, শুক্রবার ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১

‘চালানই যদি না বাঁচে তাইলে তো চাষের কাম কইরা লাভ নাই’

নিজস্ব প্রতিবেদক : | প্রকাশের সময় : বৃহস্পতিবার ১১ অগাস্ট ২০২২ ০৯:১৫:০০ পূর্বাহ্ন | দেশের খবর

 

‘ত্যালের দাম বাড়ছে, সারের দাম বাড়ছে। কামলার দামও বেড়ে গেছে। আমরা কৃষকরা এখন বিপদে পড়ছি। কী করে এই খরচো ওঠাবো? এখন কোনো উপায় নেই। আমরা মধ্যবিত্ত ফ্যামিলি বিপদে পড়ে গেছি। আমরা কামলা দিতে পারি না, ভ্যানও চালাতেও পারি না। আবাদ করেও কোনো লাভ হয় না। আমরা দুঃখের মধ্যে আছি।’

ইউরিয়ার পর ডিজেলের দাম বাড়ায় নিজ জমিতে দাঁড়িয়ে এভাবেই হতাশার সুরে কথাগুলো বলছিলেন পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার বামনডাঙ্গা গ্রামের চাষি হোসেন আলী।

সার ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় কৃষিকাজ ধরে রাখা নিয়ে হোসেন আলীর মতো বহু চাষি চিন্তায় পড়েছেন। তারা বলছেন, বর্তমান অবস্থায় কৃষিকাজ করে লাভ তো দূরের কথা, তাদের লোকসান গুনতে হবে।

পাবনার বিভিন্ন এলাকার চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ডিজেলের দাম বাড়ায় এবার উৎপাদন খরচ বাড়বে মণপ্রতি কমপক্ষে ২০০-২৫০ টাকা। ফলে ধানের দাম বৃদ্ধি না পেলে তারা নিশ্চিত ক্ষতির মুখে পড়বেন।

এক একর জমিতে এবার আমন আবাদ করেছেন আতাইকুলা থানার চাষি জনাব আলী। তিনি বলেন, ‘যে ত্যালের দাম ছিল ৮০ টাকা লিটার সেই ত্যালের দাম হইছে ১১৪ টাকা লিটার। চাষের কাম কইরা চালানই (উৎপাদন খরচ) যদি না বাঁচে তাইলে তো আমার চাষের কাম কইরা লাভ নাই।’

জনাব আলী বলেন, ‘যে পাঁচ বিঘা জমিতে কৃষিকাজ করছি সেখানে আমার লাভডা কী? একজন শ্রমিক আনতে হয়েছে দিন ৭০০ টাকা দরে। আমার বাঁচমু কীভাবে? তার একটা পথ দিবে তো সরকার? না হলে কৃষিকাজ বাদ দিয়া দিমু। আমার ২০ মণ ধান অইলে চলে, তাহলে ১০০ মণ জন্মামু ক্যান?’

ধানের জমিতে চাষ দেওয়া পাওয়ার টিলার মালিক আ. জলিল বলেন, ‘আগে এক বিঘা জমিতে চাষ করতে ৬০০ টাকা নিতাম। এখন বিঘাপ্রতি ১০০০-১১০০ টাকা নিয়েও পোষাচ্ছে না।’

সাঁথিয়ার পদ্মবিলা গ্রামের চাষি আকুব্বর সেখ বলেন, ‘খরচই উঠপি লয় (উঠবে না)। এ্যাহন কীভাবে চলবো বুঝে ঠাওর (ঠিক) পাচ্ছি না। যেভাবে সার- ত্যালের দাম বাড়ানো হইছে তাতে আমাদের সব কিছু কেনাই কঠিন।’

বনগ্রামের কৃষক সাগর আলী। তিনি জানান, আগে তার এক একরে জমি চাষ ও সেচে খরচ পড়তো প্রায় সাড়ে চার হাজার টাকার মতো। জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় তার খরচ বাড়বে প্রায় দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা।’

সাগর আলী বলেন, ‘জমিভেদে বিঘায় ইউরিয়া সার দরকার ৪০ কেজি। এতে বেড়েছে ২৪০ টাকা। ডিজেলচালিত ধান মাড়াই মেশিনের ৬০০ টাকার জায়গায় দিতে হবে ৮০০ টাকা। এছাড়া কীটনাশক, শ্রমিক, যানবাহনেও খরচ বাড়বে। সবমিলিয়ে মণপ্রতি ধান উৎপাদনে খরচই হবে এক হাজার টাকা। তাহলে চাষি ধান বেচবে কত টাকা দরে। দাম বাড়লেই তো বলা হবে চাল আমদানি করো।’

সাঁথিয়ার বনগ্রামের চাষি জসীম উদ্দিন জানান, সার ও তেলের দাম বাড়ায় মানুষ এখন চাষাবাদ ছেড়ে দিচ্ছে। কারণ উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে কিন্তু কৃষক তার ফসলের ন্যায্য দাম পাচ্ছে না। কৃষক যদি ধান চাষ না করে তাহলে বাইরে থেকে চাল এনে দেশ চালানো লাগবে।

যমুনা পাড়ের চর শাফুল্লার চাষি আমিনুল হক বলেন, বাড়তি খরচের চিন্তায় তারা হতাশায় ভুগছেন। সারের মূল্যবৃদ্ধির পরপরই সেচ খরচ বেড়ে যাওয়ায় তারা চিন্তিত। তিনি জানান, নদীর এপারেই দাম ১১৪ টাকা হলে তাদের চরে পরিবহন খরচসহ দাম পড়বে ১৩০ টাকা লিটার। এভাবে বাড়তি দামেই তেল কিনে চাষাবাদ করতে হবে চরাঞ্চলের কৃষককে। বাড়তি খরচে চাষাবাদ করলেও বাড়তি দাম পাবেন কি না তা নিয়ে তারা সন্দিহান।

কৃষিতে জাতীয় পদকপ্রাপ্ত কৃষক বাংলাদেশ কৃষক উন্নয়ন সোসাইটির সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান কুল ময়েজ বলেন, কৃষক না বাঁচলে উৎপাদন ব্যাহত হবে। এতে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে। এজন্য সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কৃষকের স্বার্থে ভর্তুকি বাড়াতেই হবে।