ঢাকা, রবিবার ৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪শে অগ্রহায়ণ ১৪৩১

ইসকন নিষিদ্ধের দাবিতে উত্তাল চট্টগ্রাম, ধর্মীয় সংঘাতের আশঙ্কায় জনমনে উদ্বেগ

মো. এনামুল হক লিটন, চট্টগ্রাম | প্রকাশের সময় : বুধবার ২৭ নভেম্বর ২০২৪ ০৭:১৪:০০ অপরাহ্ন | দেশের খবর

চট্টগ্রামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আইনজীবীদের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর অনুসারীদের সংঘর্ষে আইনজীবী নিহত হওয়ায় ঘটনাকে কেন্দ্র করে উত্তাল হয়ে উঠেছে বানিজ্যিক রাজধানিখ্যাত বন্দরনগনী চট্টগ্রাম। 

বুধবার সকাল থেকে ইসকন নিষিদ্ধের দাবীতে নগরীর বিভিন্নস্থানে পৃথক সভা-সমাবেশ ও বিক্ষোভ করেছে আন্দোলনকারিরা। এতে করে ধর্মীয় সংঘাতের আশঙ্কায় জনমনে উদ্বেড়-উৎকন্ঠা দেখা দিয়েছে। সূত্র বলছে, সনাতনীরাও রয়েছে অনেকটা আতঙ্কে। 

এদিকে সকাল থেকেই আইনজীবি সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যার প্রতিবাদে বৈষম্যবিরোধি ছাত্র আন্দোলন, হেফাজতে ইসলামসহ আরো কয়েকটি সংগঠন প্রতিবাদ সভা-সমাবেশ করেছে। 

এসব সভা-সমাবেশে বক্তারা বলেছেন, আওয়ামী লীগের এজেন্ট হিসেবে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাচ্ছে ইসকন।

এসময় নগরের টাইগারপাস এলাকায় বৈষম্যবিরোধি ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচীতে অংশ নেন হাসনাত আবদুল্লাহ ও সারজিস আলমসহ হাজারো ছাত্র-জনতা। 

সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, আওয়ামী লীগের এজেন্ট হিসেবে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাচ্ছে ইসকন। আমরা দেখেছি, ৫ আগস্ট দাড়িওয়ালা-টুপিওয়ালারা হিন্দুদের মন্দির পাহারা দিয়েছে। তবুও উগ্র হিন্দুত্ববাদী জঙ্গী সংগঠন সাইফুল ইসলাম আলিফ ভাইকে হত্যা করেছে। ভারতে বসেই স্বৈরাচার হাসিনা যত ষড়যন্ত্র করুন না কেন, আমরা রুখে দিব। বাংলাদেশে সকল ধর্মের সহাবস্থান থাকবে। ধর্মের নামে উগ্রবাদীতার এখানে ঠাঁই নেই। ইসকনের বর্বরতা আইয়ামে জাহিলিয়াতকে হার মানিয়েছে। তাই অবিলম্বে ইসকন নিষিদ্ধ করতে হবে। 

ইসকনকে সন্ত্রাসী সংগঠন আখ্যা দিয়ে সারজিস আলম বলেন, তাদের কর্মকান্ড আমাদের হতবাক করেছে। এই দেশের সাধারণ সনাতনী ভাইয়েরা শান্তিপ্রিয় মানুষ। কিন্তু স্বৈরাচার হাসিনার দালালরা ইসকনকে উস্কে দিয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাচ্ছে। আমরা বেঁচে থাকতে তা হতে দিব না। ঐক্যবদ্ধভাবে ফ্যাসিবাদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। 

চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির থেকেও এর তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। মঙ্গলবার রাতে গনমাধ্যমে প্রেরিত এক বিবৃতিতে আদালত ভবনসহ নগরের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত সন্ত্রাস-নৈরাজ্য ও চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যাকান্ডে তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ জানিয়েছে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপি। 

মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহ ও সদস্যসচিব নাজিমুর রহমান যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, পলাতক খুনি আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা ভারতে বসে দেশবিরোধী একের পর এক ষড়যন্ত্র করছে। পতিত স্বৈরাচারের দোসরদের দ্বারা এদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। আবহমান কাল যাবত এদেশের সব ধর্ম বর্ণের মানুষের মাঝে যে উজ্জ্বল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিরাজমান রয়েছে তা বিনষ্ট করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চাইছে। 

দেশের প্রচলিত আইনের দৃষ্টিতে দলমতনির্বিশেষে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তারা বলেন, নগরীতে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখার ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে যেকোনো সহযোগিতা করতে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সবস্তরের নেতাকর্মীরা বদ্ধপরিকর। জনগণের জানমাল রক্ষা ও দেশবিরোধী যেকোনো তৎপরতা রুখে দিতে বিএনপি চেয়ারপারসন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া  ও দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে বিএনপির নেতাকর্মীরা সর্বদা সজাগ ও সচেষ্ট রয়েছে। 

তরুণ আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যাকান্ডে ক্ষোভ ও প্রতিবাদ জানিয়ে তারা বলেন, বর্বরতম উপায়ে আইনজীবী আলিফকে হত্যায় জড়িতদের অবিলম্বে খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এ হত্যাকান্ডকে সাম্প্রদায়িক হানাহানির পর্যায়ে না নিয়ে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সবাই মিলে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের বিরুদ্ধে এলাকাভিত্তিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে দলীয় নেতাকর্মীসহ নগরবাসীর প্রতি আহ্বান জানান বিএনপি নেতারা। 

এছাড়া ইসকনকে নিষিদ্ধের দাবী জানিয়ে হেফাজতে ইসলামের পক্ষথেকেও এর তীব্র নিন্দা জানানো হয়েছে। প্রেরিত বিবৃতিতে চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে হত্যার সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। একইসাথে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের দায়ে হিন্দুত্ববাদী ইসকনকে নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি। 

মঙ্গলবার রাতে সংবাদমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এ দাবি জানান হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী ও মহাসচিব সাজেদুর রহমান। 

সংগঠনের যুগ্ম মহাসচিব আজিজুল হক ইসলামাবাদী স্বাক্ষর করা বিবৃতিতে বলা হয়, চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তারকে কেন্দ্র করে উগ্র হিন্দুত্ববাদী ইসকনের কর্মী-সমর্থকেরা চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণে সন্ত্রাসী আক্রমণ চালিয়ে আইনজীবী সাইফুল ইসলামকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। ভারতের উস্কানি ও মদদে এ ষড়যন্ত্রমূলক অরাজকতা তৈরি করা হয়েছে। এ ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ইসকনের কর্মী-সমর্থকদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে সাইফুল হত্যার ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে। সন্ত্রাসী কার্যক্রমের দায়ে হিন্দুত্ববাদী ইসকনকে নিষিদ্ধ করতে হবে। 

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ভারতের কোনো ফাঁদে পা না দিতে সাধারণ সনাতনী হিন্দু ভাই-বোনদের প্রতি আমরা আহ্বান করছি। আর যারা ভারতের চক্রান্তের সঙ্গে একীভূত হয়ে দেশবিরোধী অরাজকতা তৈরি করতে সক্রিয়, তাদের বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়ে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার নজির দেখাতে হবে সরকারকে। এদিকে আইনজীবিরা গতকাল কর্মবিরতি পালন করেছে। 

এদিকে, চট্টগ্রামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আইনজীবীদের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর অনুসারীদের সংঘর্ষে আইনজীবী হত্যার প্রতিবাদে কর্মবিরতি পালন করছেন আইনজীবীরা। 

উল্লেখ্য, মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে চট্টগ্রাম আদালতে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর জামিন নামঞ্জুর করার পর তাকে কারাগারে পাঠানোর জন্য প্রিজন ভ্যানে তোলা হয়। এসময় তার অনুসারীরা বিক্ষোভ করলে পুলিশ ও বিজিবি লাঠিপেটা এবং সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আইনজীবীদের সঙ্গে সংঘর্ষ চলাকালে এদিন বিকেলে রঙ্গম সিনেমা হল সংলগ্ন এলাকায় নিহত হন সাইফুল ইসলাম। 

তিনি লোহাগাড়ার চুনতি ইউনিয়নের ফারাঙ্গা এলাকার জামাল উদ্দিনের ছেলে। ছাত্রজীবনে মেধাবী সাইফুল ইসলাম আলিফ লোহাগাড়ার আধুনগর ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসা থেকে জিপিএ ফাইভ পেয়ে দাখিল পাস করেছিলেন। পরে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম (আইআইইউসি) থেকে এলএলবি পাস করে আইন পেশায় নিযুক্ত হন। তিনি সহকারী সরকারি কৌঁসুলি (এপিপি) ছিলেন। 

সবমিলিয়ে চট্টগ্রামে থমথমে পরিস্থিতির পাশাপাশি ধর্মীয় সংঘাতের আশঙ্কায় জনমনে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা বিরাজ দেখা দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন সচেতন মহল।

এ ঘটনায় ৩৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এরমধ্যে সাত জনকে সনাক্ত করা গেছে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) কমিশনার হাসিব আজিজ। 

বায়ান্ন/প্রতিনিধি/একে