মেয়েরা পর্দা করবে, মেয়েরা সংসার করবে, মেয়েরা ঘর সামলাবে, মেয়েরা কেন ঘরের বাহিরে যাবে, মেয়েরা কেন ব্যবসা করবে। এমন ধারণাকে পাল্টে দিয়েছে টাঙ্গাইলের এক পাট তরুণী। বলছিলাম টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলার নাটিয়াপাড়া এলাকার মেয়ে তানজিন তালুকদার তনুর (২৪) কথা। সে টাঙ্গাইলের করটিয়া সরকারি সা’দত কলেজ থেকে এবার উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগ থেকে অনার্স ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা দিয়েছেন । তনু করোনার সময় থেকে পাট দিয়ে বিভিন্ন পণ্য তৈরি করে নিজেকে স¦াবলম্বী করেছেন। টিউশনের টাকা জমিয়ে মাত্র ৬ হাজার টাকা নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। তার উদ্যোক্তার নাম পিউনী।
তানজিন তালুকদার তনুর সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদককে বলেন, শাড়ি প্রতিটা মেয়েরই প্রথম ভালোবাসা। ছোট বেলায় প্রথম মায়ের ওড়না পেঁচিয়ে শুরু হয় মেয়েদের শাড়ি পড়ার গল্প। আর এই গল্পে রং মেশায় নানা ঢংয়ের নানান বর্ণের শাড়িগুলো। যার মধ্যে তাঁতে বোনা শাড়ি গুলোতেই একটা মেয়েকে সবচেয়ে বেশি মায়াবী দেখতে লাগে। আর সেই তাঁতের শাড়িতে বিখ্যা জেলা টাঙ্গাইলেরই মেয়ে আমি। যার ভালোবাসায় তাঁতের শাড়ির জায়গাটা একটু বেশিই স্পেশাল। স্বপ্নটা আরও ৫-৬ বছর আগের হলেও সময় সুযোগ হয়নি।
যখন করোনা সারাবিশ^কে থমকে দিল। তখন ঘর বন্দী হয়ে পড়ি। মনে মনে ভাবতে থাকি, সময়টাকে কিভাবে কাজে লাগানো যায়। ২০২০ সালের জুলাই মাসের দিকে শুরু হয় উদ্যোক্তা জীবন। লকডাউনের সময় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দেশি পণ্যের ও নারী উদ্যোক্তাদের প্লাটফর্ম উইয়ের কল্যাণে।
উই আর ডিএসবি থেকেই উদ্যোক্তা হবার বেসিক গুলো কিছু কিছু শিখে শুরু করি আমার উদ্যোক্তা জীবন। আমি মূলত টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি নিয়ে কাজ শুরু করলেও আমার উদ্যোগ শুরুর তিন মাসের মাথায় আমি আমাদের টঙ্গাইলের তাঁতের পাটের শাড়ির সন্ধান পাই। ছোট বেলায় পড়া কবি আহসান হাবীবের “ইচ্ছে” কবিতার সেই পাটের শাড়ি যে কখনো দেখতে পাবো তা কল্পনাতেই ছিলোনা। আর একেই যখন নিজের জেলার তাঁতে পেয়ে গেলাম আর জানলাম যে এই পাটের শাড়ি আমাদের টাঙ্গাইলেই বোনা হয়। তখন পাটের শাড়িকে উদ্যোগের সিগনেচার পণ্য করে নিলাম। আর ব্যাপক হারে এর প্রচার করতে শুরু করলাম কারণ এক সময় টাঙ্গাইলের তাঁতের বিখ্যাত শাড়ি হিসেবে পাটের শাড়ির ব্যাপক কদর থাকলেও কালের বিবর্তনে তা হারিয়ে যেতে বসেছে। যা নতুন প্রজন্মের কাছে একদমই অপরিচিত হয়ে যাবে। তাই এটা নিয়ে নিজে জানার চেষ্টা করলাম আর পাটের শাড়ি নিয়ে কনটেন্ট লেখার মাধ্যমে মানুষকে জানানোর চেষ্টা করতে শুরু করলাম। তিনি আরও বলেন, টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির প্রতি ভালোবাসা শাড়ি পড়া বুঝতে শুরু করেছি পর থেকেই। তবে খুব খারাপ লাগতো যখন দেখতাম মানুষ এতো সুন্দর সুন্দর দেশি শাড়ি বা পোশাক রেখে বিদেশি পণ্যের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়। দেশি পণ্যকে ছোট করে দেখে বিদেশি পণ্য নিয়ে মাতামাতি মনটাকে ভীষণ ভাবে ব্যথিত করতো। তখন থেকেই চিন্তা নিজের এলাকার তাঁত শিল্প নিয়ে কিছু করার। ৬ হাজার টাকা দিয়ে শুরু করি আমার উদ্যোক্তা জীবন। একটু একটু করে লাখ টাকার সেল হয়। ৯ মাসের মাথায় হয়ে যায় লাখপতি।
সব খচর বাদে আমার প্রতি মাসে ৭-৮ হাজার টাকা লাভ থাকে। আমার ব্যবসা পদ্ধতি অনলাইন। আমার বিনিয়োগটি চ্যালেঞ্জ ছিলো যা টিউশনির টাকা জমিয়ে শুরু করি। সহযোগিতা পরিবার থেকে তেমন না পেলেও শিক্ষকদের সাপোর্টটা এগিয়ে যেতে সাহস পেয়েছি। যদিও এখন পরিবারকেও সব সময় পাশে পাচ্ছি। আপনার সফলতার পিছনে কোনটার প্রভাব ছিলো? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দৃঢ় মনোবল। এটা আমাকে পারতেই হবে এবং আমি পারবো এই মনোবলটা থাকলেই সকল বাঁধা পেরিয়ে এগিয়ে যাওয়া যায় সফলতার দিকে। আমি জাতীয় মহিলা সংস্থা থেকে ৪০ দিনের একটি বিজনেস স্টাডিজ কোর্স করেছিলাম যা ফ্রী ছিলো। তারপর উই থেকে মাস্টারক্লাসসহ বিভিন্ন সেমিনারে অংশগ্রহণের মাধ্যমে শিখেছি। আজ আমার সবচেয়ে বড় কারণ উই। উইয়ের হাত ধরেই আমার উদ্যোক্তার জীবন শুরু। উদ্যোক্তা হওয়ার পথ খুব একটা সহজ নয়। এখানে অনেক হোঁচট খাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বিশেষ করে নারীদের এই পথ পাড়ি দিতে হয় অনেক প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে। তাই নারীদের জন্য আরও কঠিন। তবে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলে, আর ধৈর্য ধরে নিজের উদ্যোগে নিয়মিত এক্টিভ থাকলে সফলতা শুধু সময়ের ব্যাপার। উদ্যোক্তাদের মধ্যে সবার আগে যেটা দরকার তা হলো ধৈর্য। তাছাড়াও কথা বলতে পারা, আর দ্রুত সিদ্ধান্তÍ নেওয়ার দক্ষতাটা খুবই জরুরি বলে আমি মনে করি। পাট পণ্যের সম্ভবনা ব্যাপক। আমরা পাটপণ্যের আন্তর্জাতিক চাহিদা মাথায় রেখে সে অনুযায়ী কাজ করে যেতে পারলে পাটপণ্য নিয়ে আরও একবার বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে নিজের জানান দিতে পারবে। আপনার কাজ নিয়ে ভবিষ্যতে পরিকল্পনা কি? এমন প্রশ্নে তনু বলেন, বিভিন্ন পাটপণ্যের প্রচলন থাকলেও পাটের শাড়ি মানে পাটবস্ত্র হারিয়ে যেতে বসেছে। এই হারিয়ে যেতে বসা শিল্পটির ব্যাপক প্রচার ও প্রচলন চালু করার উদ্দেশ্যেই এটাকে আমার উদ্যোগের সিগনেচার পণ্য করে কাজ শুরু করি। ভবিষ্যত পরিকল্পনাও এটাই যে আমার উদ্যোগের মাধ্যমে আরো দশজন উদ্যোক্তা আগ্রহী হবে । পাটবস্ত্র নিয়ে কাজ করতে এবং আমরা সবাই মিলে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দিবো বাংলার পাটবস্ত্র। তনু আরও বলেন, আমার পরিবারে আমার বাবা একজন উদ্যোক্তা এবং দুই বোনের মধ্যে আমিই বড় সন্তান। তাই কিছু করতে হবে এই দায়িত্ববোধটা ছোটবেলা থেকেই। বাবাকে দেখেই উদ্যোক্তা শব্দটার প্রতি একটু একটু করে ভালো লাগা হয়েছিলো। আমি এই বছরই উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ থেকে অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা দিলাম।ফলাফল হাতে নিয়ে খুব তাড়াতাড়ি গ্র্যাজুয়েট হতে চলেছি। যে সাফল্যের কথা আপনি সবাইকে বলতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করেন... এমন প্রশ্নের জবাবে তনু বলেন, পাটবস্ত্র নিয়ে কাজ করতে গিয়ে পাটরাণী উপাধি পাওয়া আমার জন্য খুবই আনন্দের। এই উপাধিটায় আমি খুবই সাচ্ছন্দ্যবোধ করি । নিজর প্রতি কনফিডেন্স থাকতে হবে তবে ওভার কনফিডেন্স হওয়া যাবেনা। অন্যের সাফল্যের দিকে তাকাতে হবে। তবে তার সাফল্য দেখে ঘাবড়ে যাওয়া যাবেনা। সবসময় নতুন কিছু করার চিন্তা মাথায় ঘুরাতে হবে। প্রচুর ভাবতে হবে নিজের উদ্যোগের নতুনত্ব নিয়ে। সর্বোপরি ধৈর্যশীল হবার বিকল্প নেই। আমার উদ্যোগের নাম পিউনি। যার সিগনেচার পণ্য পাটবস্ত্র। সাথে এখানে আছে টঙ্গাইলের তাঁতে বোনা শাড়ি, ত্রিপিস, ওড়না, পাঞ্জাবিসহ যাবতীয় তাঁতপণ্য। তার ফেসবুক পেইজের নাম পিউনী।