ঢাকা, শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ই আশ্বিন ১৪৩১

দৃষ্টি নন্দন উত্তরা গণভবন পর্যটকদের প্রধান আকর্ষন

ফরহাদুজ্জামান ,নাটোর : | প্রকাশের সময় : সোমবার ৬ ডিসেম্বর ২০২১ ০৪:১২:০০ অপরাহ্ন | দেশের খবর

নাটোরের উত্তরা গণভবন প্রাচীন স্থাপত্যকলার এক অপরুপ নিদর্শন। প্রায় ৩ শ বছরের প্রাচীন ইতিহাস-ঐতিহ্যের সৌন্দর্য মন্ডিত এ ভবন আজও কালের সাক্ষী হয়ে উত্তরা গণভবন নামে দেশব্যাপী একনামে পরিচিত। 

ভবনটির সামনে দাঁড়ালে থমকে যেতে হয়। দৃষ্টিনন্দন সুদৃশ্য বিশাল সিংহদুয়ার। এর উপরে বিশাল এক ঘড়ি-যা ঘন্টা ধ্বনী বাজিয়ে আজও সঠিক সময় জানান দিয়ে যাচ্ছে। চারিদিকে সুউচ্চ প্রাচীর ও পরিখা বেষ্টনী, দেশি-বিদেশি দুস্প্রাপ্য অনেক বৃক্ষরাজি, ইটালিয়ান গার্ডেনের শ্বেত পাথরের ভাস্কর্য শোভিত দৃষ্টিনন্দন বিশাল এ রাজপ্রাসাদ।

দিঘাপতিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন নাটোরের রাজা রামজীবন ও রাণীভবানী বিশ্বস্ত চৌকষ দেওয়ান দয়ারাম রায়। ১৭০৬ সালে রামজীবনের কাছ থেকে দয়ারাম রায় নাটোরের দিঘাপতিয়া এলাকায় জমিদারী লাভ করেন। এরপর দুইশ’ বছরের অধিক সময় ধরে বগুড়া, পাবনা, জামালপুর ও যশোর জেলার অংশবিশেষ কৃতিত্বের সাথে শাসন করেছেন এ রাজবংশ।

জেলা সদর থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার উত্তরে নাটোর-বগুড়া মহাসড়কের পাশে রাজা দয়ারাম রায় দিঘাপতিয়া রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করেন। প্রাচীরের বাইরের ফটকের সম্মুখে রয়েছে ২.৮৯ একর জমি। রাজা প্রমদানাথ রায়ের সময় ১৮৯৭ সালে ১০ থেকে ১২ জুন তিনদিনব্যাপী বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের অধিবেশন নাটোরের ডোমপাড়া মাঠে শুরু হয়।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ অনেক বরেণ্য ব্যক্তি এ অধিবেশনে যোগ দেন। কিন্তু অধিবেশনের শেষ দিন ১২ জুন ১৮ মিনিটব্যাপী প্রলয়ঙ্করী এক ভূমিকম্পে রাজপ্রাসাদ ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। পরে ১৮৯৭ থেকে ১৯০৮ সাল পর্যন্ত ১১ বছরের চেষ্টায় বিদেশি প্রকৌশলী চিত্রকর্ম শিল্পীদের সহায়তায় ৪১.৫০ একর জমির উপর এ রাজবংশের ষষ্ঠ রাজা প্রমদানাথ রায় মোঘল ও প্রাশ্চাত্য রীতি অনুসারে নান্দনিক কারুকার্যময় রাজপ্রাসাদটি পূনঃনির্মাণ করেন। 

দৃষ্টি নন্দন প্রবেশদ্বার ছাড়াও এখানে রয়েছে মোট ১২টি ভবন। এগুলোর মধ্যে প্রধান প্রাসাদ ভবন, কুমার প্যালেস, প্রধান কাচারীভবন, রাণীমহল, রান্নাঘর, মটর গ্যারেজ, ড্রাইভার কোয়ার্টার, ট্রেজারি বিল্ডিং ও সেন্ট্রি বক্স উল্লেখযোগ্য।

রাজপ্রাসাদের দক্ষিণে রয়েছে ফুলের বাগান। এ বাগানটি ইটালিয়ান গার্ডেন নামে পরিচিত। দেশি-বিদেশি নানা জাতের ফুলে পরিপূর্ণ এ বাগান। বাগানের ভিতর শ্বেত পাথরের আকর্ষণীয় ৪টি নারীর ভাস্কর্য সবাইকে মুগ্ধ করে। রয়েছে একটি ইটালিয়ান টাইপের ফোয়ারা এবং লৌহ ও কাঠ দ্বারা নির্মিত বেঞ্চ আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে, একটি ডিম্বাকার সাইজের মার্বেল পাথরের নির্মিত আসনসহ মঞ্চ। সমগ্র বাগানে অসংখ্য ফুলের সমাহার। আছে নাগালিঙ্গম, কর্পুর,এগপ্লান্ট, হৈমন্তীর মত দুস্প্রাপ্র সব বৃক্ষরাজি আর কৃত্রিম ঝর্ণা।

দিঘাপতিয়া রাজবাড়ির মূল প্রাসাদটি একতলা। এর মাঝে রয়েছে প্রশস্ত একটি হলরুম। বেশ উঁচু হলরুমের শীর্ষে রয়েছে বিশাল এক গম্বুজ। এ গম্বুজের নিচ দিয়ে হলরুমে আলো বাতাস প্রবেশ করে। হলরুমের মাঝে রাজার আমলে তৈরি বেশকিছু সোফা রয়েছে। 

এছাড়াও হলরুমে একটি ব্যতিক্রমী কারুকার্য খচিত সোফা রয়েছে যাতে একসঙ্গে চারজন চারমূখী হয়ে বসা যায়। হলরুমের আসবাবপত্র এখনো রয়েছে। উপরে রয়েছে সেই আমলের ঝাড়বাতি। হলরুমের পাশে রয়েছে আরেকটি বড় ঘর। পাশের রান্নঘর হতে এ ঘরে সরাসরি আসা যায়। নিরাপত্তার জন্য রান্নাঘরের করিডোরের দু’পাশে রাজ আমলের তার দিয়ে এখনো ঘেরা রয়েছে। এর পাশে একটি ঘরে রয়েছে সিংহাসন। এর পাশের ঘরটি ছিল রাজার শয়নঘর। এ ঘরে এখনো রাজার খাট শোভা পাচ্ছে।

কুমার ভবনের পেছনের ভবন রাজার কোষাগার আর অস্ত্রাগার। দক্ষিণে ছিল রাণীমহল। আজ আর সেটা নেই। ৬৭ সালে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। রাণীমহলের সামনে একটি ফোয়ারা এখনো সেই স্মৃতিবহন করে চলেছে। রাজার একটি চিড়িয়াখানাও ছিল।

পরবর্তীতে জেলা প্রশাসন আবার নতুন করে সেই চিড়িয়াখানা চালু করেছেন। রাজার ট্রেজারী ভবনে গড়ে তোলা হয়েছে সংগ্রহশালা। রাজা-রানীর ব্যবহৃত নানা সামগ্রী সংগ্রহ করে দর্শনার্থীদের দেখার জন্যে এ সংগ্রহশালায় রাখা হয়েছে। এগুলোর মদ্যে রয়েছে রাজা রানীদের ব্যভহৃত খাট,টেবিলচেয়ার, ড্রেসিংটেবিল, কেজসপত্র সহ ব্যভহৃত নানা ধরণের সামগ্রী । 

মূল ভবন রাজ প্রাসাদের সামনে রয়েছে রাজা প্রসন্ন নাথ রায়ের আবক্ষ মূর্তি। এর দু’পাশে রয়েছে দুটি কামান। রাজপ্রাসাদের সামনে পূর্বে রয়েছে রাজার দোলমঞ্চ। পাশেই রয়েছে কুমার প্যালেস। এর সামনে বসানো চারচাকা বিশিষ্ট একটি কালো কামান আজো শোভা পাচ্ছে। 

রাজপ্রাসাদের প্রবেশের পথে সিঁড়ির দু’পাশে ছিল দুটি কালো কৃষ্ণ মূর্তি-যা এখন শোভা বর্ধন করছে সংগ্রহশালার। সংগ্রহশালার প্রবেশ করিডরে রয়েছে ধাতব বর্ম। এটা পরেই নাকি রাজা যুদ্ধে যেতেন। এ কারণে পিতলের তৈরি এ বর্মটি দর্শনার্থীদের আরো বিশেষভাবে নজর কাড়ে। রাজপ্রাসাদের উত্তর পাশে ছিল বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। সেখান থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতে অস্টাদশ শতকের রাজবাড়ি আলোতে ঝলমল করতো। 

পুরো রাজপ্রাসাদে ছিল রাজার বিভিন্ন চিত্রকর্ম, ছবি আর বিদেশি ঘড়ি- আজ সে সব আর নেই। প্রাসাদের শ্বেতপাথরের মেঝে মোড়ানো থাকতো পার্সিয়ান গালিচায়। রাজা প্রমদানাথ রায়ের প্রচন্ড রকম ঘড়িপ্রীতি ছিল। আর এ জন্য তিনি দেশ বিদেশ থেকে অর্ডার দিয়ে ঘড়ি তৈরি করে আনতেন। এসব ঘড়ি রাজপ্রাসাদ ছাড়াও বিভিন্ন ভবনে স্থাপন করেছিলেন। এমন একটি ঘড়ি ছিল যাতে ১৫ মিনিট পরপর জলতরঙ্গ বাজতো। 

এছাড়া রাজবাড়ির মূল ফটকে রয়েছে একটি ঘড়ি। এর দু’পাশে দুটি ডায়াল। ঘড়িটি এখনো সঠিকভাবেই সময় দিয়ে যাচ্ছে। ঘড়িটি ইটালির ফ্লোরেন্স থেকে আনা হয়েছিল। আগে এর ঘন্টাধ্বনী ১০/১২ মাইল দূর থেকে শোনা যেত-এখন এ ঘন্টাধ্বনী শোনা যায় প্রায় এক মাইল দূর থেকে। শোনা যায় স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় দিঘাপতিয়া রাজবাড়িতে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প হওয়ায় কিছু ঘড়িসহ অন্যান্য মূলবান সম্পদ লুট হয়।

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর দিঘাপতিয়া রাজা দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যান।  এরপর ১৯৬২ সালে গভর্ণর মোনায়েম খান  দিঘাপতিয়া রাজবাড়িকে গভর্ণর হাউজ হিসেবে ঘোষণা করেন। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি এটাকে উত্তরা গণভবন হিসেবে এবং নাটোরকে দ্বিতীয় রাজধানী হিসেবে ঘোষণা দেন। কিন্তু সংরখ্ষিত এলাকা হিসেবে দর্শনার্থীরা এর সৌন্দর্য উপভোগ থেকে বঞ্চিত হতেন। অবশেষে জেলা প্রশাসনের প্রচেষ্টায় এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে ২০১২সালে ২৫ ডিসেম্বর দর্শনাথীদের জন্য ৮০ ভাগ অংশ  খুলে দেয়া হয়েছে । পূর্বে গণপূর্থ মণ্্রতণালয়ের হাতে পুরো নিয়ন্ত্রন থাকলেও বর্তমানে জেলা প্রশাসনের হাতে রয়েছে ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব। ফলে জেলা প্রশাসকদের উদ্যোগে সংস্কার কাজ শুরু করে জেলা প্রশাসন। বাইরের মানুষের কাছে রয়ে যাওয়া রাজপরিবারে ব্যবহৃত ঐতিহ্যবাহী ও দূর্লভ স্মৃতিচিহ্ন সংগ্রহ শুরু করা হয়- যা বর্তমানে সংগ্রহশালায় সংরক্ষণ করা হয়েছে। মূল ফটক দিয়ে প্রবেশের পর রাজপ্রাসাদে যেতে হাতের বাম দিকে রাণীঘাট ছাড়িয়ে চোখে পড়ে চিড়িয়াখানা। সেখানে রয়েছে হরিণ, বানর, ময়ুর, টিয়াপাখি। নতুন স্থাপিত সংগ্রহশালার ব্যাপারে দর্শনার্থীরা ইতিবাচক মনোভাব পোষন করেন বলে তাদের সাথে আলাপচারিতায় জানা যায়। রাজবাড়ীর প্রবেশপথের ডান পাশ দিয়ে এগিয়ে গেলে চোখে পড়ে শত বছরের শতাধিক প্রায় আম গাছ-যেখানে সম্প্রতি স্থাপন করা হয়েছে পাখি অভয়াশ্রম। উত্তরা গণভবনের দর্শনার্থীদের নিরাপত্তায় ট্যুরিস্ট পুলিশের একটি টিমও এখানে কাজ করছে।

নাটোরের জেলা প্রশাসক শামিম আহমেদ  বলেন, সংস্কারসহ সংগ্রহশালা, চিড়িয়াখানা ও পাখির অভয়াশ্রম গড়ে তোলায় গণভবনে দর্শনার্থীর সংখ্যা আগের তুলনায় বেড়েছে।

সংরক্ষিত রাজপ্রাসাদ ও ইটালিয়ান গার্ডেন ছাড়া উত্তরা গণভবন প্রতিদিন দর্শনার্থীদের জন্যে খোলা থাকে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত। মূল ফটকে প্রবেশমূল্য ১০ থেকে ২০ টাকা আর সংগ্রহশালায় প্রবেশমূল্য ৩০ টাকা। সারা বছর জুড়ে গণভবন দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখর থাকে। তবে শীতে পিকনিকের মৌসুমে এবং দুই ঈদে দর্শনার্থীর সংখ্যা বাড়ে অনেকগুণে।