ঢাকা, মঙ্গলবার ৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯শে অগ্রহায়ণ ১৪৩১
সংরক্ষণের অভাবে পরিত্যক্ত

পাঁচলাইশে ৪শ বছরের পূরনো মোগল স্থাপত্য

মো. এনামুল হক লিটন/সাহেনা আক্তার, চট্টগ্রাম : | প্রকাশের সময় : রবিবার ৫ ডিসেম্বর ২০২১ ০১:১৯:০০ পূর্বাহ্ন | জাতীয়



সংরক্ষণের অভাবে পরিত্যক্ত হয়ে এখন ভূতুরে বাড়িতে পরিণত হয়েছে পাঁচলাইশের ৪শ বছরের পূরনো মোগল স্থাপত্য। চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী থানার এয়ার আলী হাটের (এয়ার আলী খাঁ হাট) অদূরে এই মোগল আমলের স্থাপত্যটি এয়ার আলী খান চৌধুরী বাড়ি নামে পরিচিত। রুপ কথার গল্পের মতোই এই স্থাপত্যের রয়েছে, স্মৃতি বিজড়িত অনেক ইতিহাস। অনুসন্ধানে জানা যায়, কালের বিবর্বতনে হারিয়ে যাওয়া কালের সাক্ষী এই স্থাপনার ব্যাপক পরিচিতি ছিল এককালে। এখানে কয়েদিদের রাখা, ফাঁসির মঞ্চ ও কারাগার থাকার কথা মানুষের মুখে-মুখে থাকলেও তাদের বংশধররা এসব কথা নাকচ করে দিয়েছেন। তাদের মতে, ফাঁসির মঞ্চ, কয়েদি রাখার বিষয়টি সঠিক নয়। এক শ্রেণীর মানুষ ইতিহাস বিকৃত করছেন দাবী বংশধর নজিবুল হোসেন খাঁ চৌধরীর পূত্র আরিফ খাঁ চৌধুরীর। তিনি বলেন, আমাদের পূর্ব পুরুষরা অত্যন্ত ধার্মিক ও আর্ধাত্নিক চিন্তা-চেতনার মানুষ ছিলেন এবং তাঁরা ধর্ম প্রচার করতেন। জানা গেছে, এক সময় এই বাড়িটি দেখতে দূর-দুরান্ত থেকে মানুষ এসে ভীড় করলেও এখন আর সেই জৌলুস নেই বলে জানিয়েছেন স্থানিয়রা। প্রচারণার অভাব ও এটি সংরক্ষণে সরকারি কোনো উদ্যোগ না থাকায় ধীরে-ধীরে বাড়িটি নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে। স্থানিয় বয়োবৃদ্ধরা জানান, ওই আমলে এখানে জমিদারের পুণ্যাহ (জমিদারি প্রথায় বৎসরের সূচনায় প্রজাদের নিকট থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতীকী খাজনা আদায়ের অনুষ্ঠান) হত। এই অনুষ্ঠানে প্রজারা খাজনা দিতো। প্রজাদের কেউ-কেউ ভালো ফলন হলে খুশী হয়ে জমিদারকে গরু-ছাগল, মুরগী এবং চাষাবাদের তড়িতরকারিও উপহার দিত। জানা যায়, স¤্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে এয়ার আলী খান চৌধুরী বাড়ির স্থাপনাটি নির্মিত হয়। তৎকালীন জমিদার হামজা খাঁ-এর পূত্র এটি নির্মাণ করেন। সম্রাটের পুরো নাম ছিল আল সুলতান আল আজম ওয়াল খাকান আল মুকাররম আবুল মুজাফ্ফর মুহিউদ্দীন মুহাম্মদ আওরঙ্গজেব বাহাদুর আলমগীর। তাঁর জন্ম ১৬১৮ সালে এবং ১৭০৭ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। সম্রাট আওরঙ্গজেবের কাছ থেকেই হামজা খাঁ জমিদারি লাভ করেন বলে জনশ্রুত রয়েছে। সরেজমিনে গতকাল এয়ার আলী খান চৌধুরী বাড়ির স্থাপনাটি ঘুরে দেখা গেছে, ৭০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৩০ ফুট প্রস্থের এই স্থাপনার প্রথমে একটি পুকুর। এরপর বাড়ি। মোগল স্থাপত্যে নির্মিত এই বাড়ির দেয়ালগুলো এখনো অনেক মজবুত। বাহিরের দেয়ালে এবং ছাঁদে জন্মেছে বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা। দেয়ালের বিভিন্নস্থানের পলেস্থরা খসে পড়ছে। ভেতরের অবস্থা ভয়ানক। স্থাপনায় ৬টি কুটুরি (দরজা) থাকলেও দুটি কুটুরি ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। বাকি কুটুরিগুলোও ভেঙ্গে ফেলা হতে পারে এমন মন্তব্য অনেকের। জানা গেছে, সতেরশ শতাব্দিতে ইরাক থেকে চট্টগ্রাম আসেন জমিদার হামজা খাঁ। তিনিই পাঁচলাইশে এই স্থাপনা নির্মান করেন। তাঁর পাঁচ পূত্রের নাসানুসারে পাঁচলাইশের নামকরণ করা হয়। তাঁরা সবাই ফার্সি ভাষায় কথা বলতেন। ফার্সি শব্দ অনুসারে পাঁচলাইশের অর্থ পাঁচ বাঘ। হামজা খাঁ (রা.)-এর পাঁচ পূত্র বাহুবলী দেহের অধিকারি থাকায় তাদের লাইশ (বাঘ) বলা হতো। পাঁচলাইশ ও মোহরায় ছিল এই পাঁচ পূত্রের বসবাস। পাঁচলাইশের এয়ার আলী চৌধুরী খান বাড়ি, মনাখান চৌধুরী বাড়ির বাসিন্দাগণ হামজা খাঁ’র বংশধর বলে জানা গেছে। চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী গরুর বাজার বিবিরহাটের নামকরণ করা হয়েছে হামজা খাঁ’র মেজ ছেলের বিবির (স্ত্রী) নামে। ছোট ছেলের বিবির (স্ত্রী) কবরও রয়েছে ওয়াজেদিয়া মসজিদের পাশে। এই মসজিদটি মাইজ্যা (মেজ) বিবির মসজিদ নামে পরিচিত ছিল। হামজার বাগে রয়েছে, হামজা খাঁর মসজিদ। জমিদারের বংশধর ও হামজা খাঁ’র ১৩ তম ওয়ারিশ নুরুল্লা খাঁ-এর পূত্র মুজিবুর রহমান খাঁ জানান, মোগল আমল থেকেই হামজা খাঁর জমিদারি ছিল। তিনি ছিলেন এই এলাকার প্রথম দিকের জমিদার। বর্তমানে তাঁর যে স্থাপনাটি অবস্থিত রয়েছে, এর চারপাশে আরো স্থাপনা ছিল। মূল ভবনটি ছিল দোতলা। এই ভবনের দক্ষিণ ও পশ্চিম পাশে আরো কয়েকটি ভবন ছিল। তিনি জানান, সরকারিভাবে জমিদারের বিশেষ ক্ষমতা থাকায় এ বাড়িতে প্রজাদের বিভিন্ন সমস্যা-সমাধানে বৈঠক বা শালিশ-বিচার কাজ চলতো। তবে শাস্তি, ফাঁসি বা হাজত খানা এখানে ছিলনা। তিনি জানান, জমিদারের পক্ষথেকে প্রজাদের ব্যবহারের জন্য ওই আমলে পাঁচলাইশে বড়-বড় দিঘী খনন করা হয়। নির্মাণ করা হয় চলাচলের রাস্তাঘাটও। জমিদারের বংশধর আরিফ খাঁ চৌধুরী অভিযোগ করে বলেন, এখানে একটি বড় দিঘী ছিল। দিঘীটি বর্তমানেও আছে। কিন্তু আস্তে-আস্তে দিঘীটি ছোট হয়ে যাচ্ছে। ভরাট করারও পায়তারা চলছে বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, দিঘীর পাশের রাস্তাটি আমাদের পূর্ব পুরুষের হলেও সেই রাস্তার নাম আমাদের পূর্ব পুরুষের নামকরণে হয়নি। এছাড়া এয়ার আলী খাঁ হাটকে খাঁ-টি বাদ দিয়ে এয়ার আলী হাট নামকরণ করা হয়েছে। অনেক স্থান থেকে এভাবে খাঁ বাদ দেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি। স্থানিয় বাসিন্দা ও সমাজ সেবক মো. ইলিয়াছ খান চারশ বছরের পূরণো এই ইতিহাস ঐতিহ্য রক্ষা করতে হবে মন্তব্য করেন। স্থানিয় বাসিন্দারা জানান, রক্ষনাবেক্ষণের অভাবে মুছে যাচ্ছে মোগল আমলের বেশ কিছু স্থাপনার ইতিহাস। এটি সংরক্ষণে সরকারের যথাযথ উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন, অভিজ্ঞ সচেতন মহল।