বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার প্রস্তাবিত সংশোধনীর আলোকে চেয়ারম্যান ও মেয়র পদের জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক ডিগ্রি বাধ্যতামূলক করার এবং পরোক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব, তবে এর সম্ভাব্য সুবিধা ও অসুবিধা নিয়ে গভীর বিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে।
শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রয়োজনীয়তা সুশাসনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ থাকলে নেতৃত্বের গুণগত মান বৃদ্ধি পায়, প্রশাসনিক দক্ষতা আরও শক্তিশালী হয় এবং নীতিনির্ধারণে স্বচ্ছতা আসতে পারে। দুর্নীতির প্রবণতাও কমে যায়, কারণ শিক্ষিত নেতারা তাদের কাজের প্রতি দায়বদ্ধ থাকেন। কিন্তু, বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ এবং এখানে দরিদ্র জনগণের সংখ্যা অনেক বেশি, তাই এই ধরনের একটি প্রস্তাব কি সমাজের বৃহত্তর অংশের জন্য উপযুক্ত হবে? শিক্ষার জন্য যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা এবং অর্থনৈতিক অবস্থা প্রয়োজন, তা অনেক মানুষের জন্য সম্ভব নাও হতে পারে। এই অবস্থায়, শিক্ষাগত যোগ্যতার বাধ্যবাধকতা একটি বড় প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষত নিম্নবর্গের মানুষদের জন্য, যারা শাসক বা নেতা হিসেবে কাজ করার যোগ্যতা অর্জনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে পারে।
বিশ্বব্যাপী এমন ধারণা প্রচলিত রয়েছে যে, একজন শিক্ষিত নেতা দেশের তথা এলাকার উন্নতির জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণে সক্ষম। এর মাধ্যমে তিনি প্রশাসনকে আরও দক্ষভাবে পরিচালনা করতে পারেন। তবে, এই প্রস্তাবের বাস্তবায়নে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, বিশেষ করে যদি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এবং অর্থনৈতিক অবস্থা দুর্বল হয়। যদি শিক্ষাগত যোগ্যতার বাধ্যবাধকতা শক্তিশালী হয়, তবে তা জনগণের নির্বাচনের অধিকারের প্রতি একটি বিপদ হতে পারে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণের মাধ্যমে হওয়া উচিত, কারণ এতে জনগণের পছন্দের নেতৃত্ব নিশ্চিত হয়।
এদিকে, পরোক্ষ নির্বাচনের প্রস্তাবটি গণতান্ত্রিক অধিকার ও জনগণের অংশগ্রহণের উপর এক ধরনের প্রশ্নবোধক চিহ্ন ফেলে। বাংলাদেশের বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থায় জনগণের সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত নেতা তাদের কাছে বেশি জনপ্রিয় এবং জবাবদিহিতার দায়িত্ব পালন করে থাকেন। তবে, প্রস্তাবিত সংশোধনীর মাধ্যমে চেয়ারম্যান ও মেয়রদের যদি স্থানীয় কাউন্সিলের ভোটে নির্বাচিত করা হয়, তাহলে সাধারণ জনগণের সরাসরি অধিকার ক্ষুন্ন হতে পারে।
পাকিস্তানের অভিজ্ঞতা এই বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা প্রদান করে। ২০০০ সালে পাকিস্তানে স্থানীয় সরকার আইন সংশোধন করে পরোক্ষ নির্বাচন পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল। তবে, এর ফলে জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ কমে গিয়েছিল এবং সেখানকার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। এই ব্যবস্থা বেশিদিন টেকেনি, কারণ এতে রাজনৈতিক বিভাজন এবং দুর্নীতি বেড়ে গিয়েছিল। একইভাবে, ভারতের কিছু রাজ্যে স্থানীয় নির্বাচনে পরোক্ষ নির্বাচন পদ্ধতি প্রয়োগ করা হলেও, এটি স্থানীয় জনগণের সঙ্গে নেতৃত্বের সম্পর্ক দুর্বল করে ফেলেছিল, কারণ নির্বাচিত মেয়র বা চেয়ারম্যানরা সরাসরি জনগণের কাছ থেকে ভোট পায়নি এবং জনগণ তাদেরকে পুরোপুরি গ্রহণ করেনি।
এছাড়া, ভারতের কিছু রাজ্যে স্থানীয় নির্বাচনে শিক্ষাগত যোগ্যতা বাধ্যতামূলক করা হলে, এটি বিশেষত গ্রামীণ এলাকায় নারীদের এবং দরিদ্র জনগণের জন্য একটি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল। অনেক ক্ষেত্রে, এই ধরনের বাধ্যতামূলক শিক্ষাগত যোগ্যতা এই জনগণের জন্য প্রাপ্তিযোগ্য ছিল না, যা তাদের স্থানীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের অধিকারকে খর্ব করেছে।
বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় শিক্ষাগত যোগ্যতা বাধ্যতামূলক করা হতে পারে, তবে এর সঙ্গে জনগণের সরাসরি নির্বাচনে অংশগ্রহণের অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা উচিত। জনগণের ভোটাধিকার যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রতিফলিত হয়। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণ তাদের অধিকার নিশ্চিত করে এবং একটি শক্তিশালী গণতন্ত্র গড়ে তোলার জন্য আবশ্যক।
বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রয়োজনীয়তা থাকা উচিত, তবে তা জনগণের ভোটাধিকারকে খর্ব না করে, যাতে জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণ বজায় থাকে। এটি প্রমাণিত হয়েছে যে নির্বাচনে সরাসরি অংশগ্রহণ, যদি জনগণের স্বাধীন মতামত এবং অংশগ্রহণের অধিকার রক্ষা করা যায়, তা সুশাসন এবং স্বচ্ছতার জন্য সবচেয়ে কার্যকর পন্থা।
লেখক: এডভোকেট মোহাম্মদ সরোয়ার হোসাইন লাভলু
অতিরিক্ত জেলা পাবলিক প্রসিকিউটর , চট্টগ্রাম