ঢাকা, শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ঠা আশ্বিন ১৪৩১

১৩ কোটির সড়কের কাজ ঠেকেছে ১৮৪ কোটিতে

নিজস্ব প্রতিবেদক : | প্রকাশের সময় : শনিবার ২৭ অগাস্ট ২০২২ ০৪:০৩:০০ অপরাহ্ন | দেশের খবর

 

উত্তরাঞ্চলের ব্যস্ততম জেলা বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালের সংযোগ সড়ক এটি। দৈর্ঘ্য মাত্র আড়াই কিলোমিটার। ২০০৪ সালে যখন এই সড়কটির পরিকল্পনা করা হয় তখন এর দৈর্ঘ্য ছিলো সাড়ে ৪ কিলোমিটার। নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৩ কোটি ৭০ লাখ ৬৮ হাজার টাকা।

মূল সড়কের সঙ্গে শহরে যানজট কমাতে আন্তঃসড়ক লিংক করা হয়েছিলো আরো ২টি। এখন লিংকরোড বাদ দিয়ে সড়ক নির্মাণ প্রকল্পটি ঝুলছে ১৮ বছর ধরে। নির্মাণ ব্যয় ১৪ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ১৮৪ কোটি। এরপরও শেষ করা যায়নি সড়কের কাজ। জেলা শহরের স্বল্পদৈর্ঘ্যের এই সংযোগ সড়ক নির্মাণ করতে ব্যয়বহুল খরচ নিয়েও নানা রকম প্রশ্ন উঠেছে।

খরচ নিয়ে প্রশ্ন

গত বছর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় সংশোধনী প্রস্তাবের মাধ্যমে এই প্রকল্পে ৭৫.৯২ শতাংশ বা ৭৯ কোটি টাকা ব্যয় বৃদ্ধির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এখন প্রকল্পের মোট ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮৪ কোটি টাকা। হিসাব করে দেখা গেছে এই টাকায় প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হবে ৯৯ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। আর প্রতি মিটারে ব্যয় প্রায় ১০ লাখ টাকা। আর প্রতি ইঞ্চিতে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ২৫ হাজার টাকার মতো। একটি জেলা শহরের সংযোগ সড়কের প্রতি কিলোমিটার নির্মাণ করতে প্রায় শত কোটি টাকা খরচ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

তবে বগুড়া সড়ক ও জনপথ অধিদফতর বলছে ব্যয় বাড়ার অন্যতম কারণ ভূমি অধিগ্রহণ খরচ বেড়ে যাওয়া। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিতে জমির মূল্য বাবদ তিনগুণ অর্থ দেওয়া হচ্ছে।

এদিকে কিলোমিটার প্রতি প্রায় শত কোটি টাকা ব্যয় নিয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মূখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেছেন, অতিরিক্ত খরচ এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। ছোট-বড় অধিকাংশ প্রকল্পের ক্ষেত্রেই দুই বা আড়াই গুণ সময়ের আগে শেষ হচ্ছে না। ব্যয়ের ক্ষেত্রেও একই চিত্র। এর মূল কারণ প্রকল্পের টিমের জবাবদিহিতা না থাকা।

পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সচিব (সদস্য) মামুন-আল-রশীদ বলেন, নতুন ভূমি অধিগ্রহণ আইনে জমির ক্ষতিপূরণ বেড়েছে। ফলে সংশোধিত প্রস্তাবের মাধ্যমে ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। তবে নির্দিষ্ট সময়ে কেন কাজ শেষ হচ্ছে না এটি তদন্ত করে দেখা দরকার।

বগুড়া-৬ (সদর) আসনের এমপি গোলাম মো. সিরাজ বলেন, ১৮ বছর ধরে প্রকল্পটি ঝুলিয়ে রেখে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে শতকোটি টাকার ক্ষতি করা হয়েছে। এভাবে প্রকল্প ঝুলিয়ে রাখলে প্রকল্প ব্যয় যে চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ে তা এই সড়কটি না দেখলে বোঝা যাবে না। আমি এটাকে সরকারি অর্থের অপচয় ছাড়া আর কিছুই বলবো না।

শুরুতে সড়ক ও জনপদ অধিদপ্তরের মাধ্যমে প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছিল। যেখানে বলা হয়, এ সড়ক নির্মাণ হলে যানজট হ্রাস পাওয়ায় বছরে পরিবহন ব্যয় সাশ্রয় হবে ৭ কোটি ৫৯ লাখ টাকার। এখন ১০ বছর পর এসে যানবাহন বেড়ে গেছে ২০ গুণ বেশি। মূল সড়কে প্রচণ্ড চাপে যানবাহনের গতি হচ্ছে শ্লথ। যার কারণে একটি মাত্র সড়কে আয়-ব্যয় বিশ্লেষণে প্রকল্পটি অর্থনৈতিকভাবে অলাভজনক হিসেবে মনে করা হচ্ছে।

কেন সংযোগ সড়ক

দেড় যুগ আগে যখন বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) সড়কের পরিকল্পনা করা হয় তখন শহরে যানজট ছিলো কম। ব্যক্তিগত প্রাইভেট গাড়ির আধিক্যও কম ছিলো। যার জন্য শহরের স্টেশনরোড হয়ে মোহাম্মদ আলী হাসপাতালের পাশ দিয়ে ব্যাংকপাড়া, ঠনঠনিয়া, সিঅ্যান্ডবি গোডাউন, মালগ্রাম, সিলিমপুর এলাকা দিয়ে একটি সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা করে সড়ক বিভাগ। এই সড়কটির ২টি সংযোগ পয়েন্ট করার কথা ছিলো কারবালা মুরগির ফার্ম হয়ে ওয়াপদা রোড এবং টিনপট্টি এলাকা দিয়ে।

শহরের উত্তরপ্রান্তের লোকজনের হাসপাতালে যাতায়াতের স্বার্থে এই সড়কটি ব্যবহারের কথা ছিলো। কিন্তু খরচ কমাতে উত্তরপ্রান্তের দুইটি সংযোগ সড়ক বাদ দিয়ে সাড়ে ৪ কিলোমিটার থেকে আড়াই কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। সাড়ে চার কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও ৬০ ফুট প্রস্থ রেখে নকশা অনুমোদনের পর জমি অধিগ্রহণ, মাটি কাটা এবং কার্পেটিংসহ ওই সময় সড়কটির নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৩ কোটি ৭০ লাখ ৬৮ হাজার টাকা।

২০০৪ সালের ২ মে পরিকল্পনা কমিশন থেকে প্রকল্পটি অনুমোদনের পর দরপত্র আহ্বানের প্রক্রিয়া শেষ হয়। ১ দশমিক ১২ হেক্টর জমি অধিগ্রহণও করা হয়। পরে রাস্তার দৈর্ঘ্য আড়াই কিলোমিটারে কমিয়ে আনা হয়। আড়াই কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণের এই প্রকল্পের মেয়াদ ৩ বছর ধরা হলেও পরবর্তী ১২ বছরে কাজ হয় মাত্র ৮শ মিটার।

সওজ সূত্র জানায়, ২০০৬ সালের পরপর এই সড়কের কাজ বন্ধ হয়ে যায় নানা জটিলতায়।

পরিকল্পনা কমিশন এবং সড়ক ও জনপথ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, বগুড়া শহর থেকে মেডিকেল কলেজ পর্যন্ত অসমাপ্ত ১ দশমিক ৮৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণে ২০১৭ সালে নতুন করে উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০১৭ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৯ সালের জুনের মধ্যে এটি বাস্তবায়নের কথা ছিল। ওই সময় সড়কটি নির্মাণে খরচ ধরা হয় ১০৪ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। পরে প্রকল্প সংশোধন ছাড়াই তিন দফায় সড়কটি নির্মাণের সময় বাড়ানো হয়। প্রথমবার ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত, দ্বিতীয়বার ২০২১ সালের জুন এবং তৃতীয়বার ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত সময় নেওয়া হয়। গত অর্থবছরেও কাজ শেষ না করতে পারায় নতুন করে ব্যয় বৃদ্ধি করার প্রস্তাব রেখে প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। সেখানে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভায় ব্যয় বাড়িয়ে ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল (ডিপিপি) বা প্রকল্প প্রস্তাবনা পুনর্গঠন করা হয়। এখন এই সড়কটির ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১৮৪ কোটি টাকা।