ঢাকা, মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১২ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১
টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ মহাসড়ক

১৩ বছরে চার বাসে ডাকাতি তিন ধর্ষণ, দুই নারী খুন

১৩ বছরে চার বাসে ডাকাতি তিন ধর্ষণ, দুই নারী খুন | প্রকাশের সময় : শুক্রবার ৫ অগাস্ট ২০২২ ১২:১৭:০০ অপরাহ্ন | জাতীয়

টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ মহাসড়কে মধুপুরের বনাঞ্চলের নির্জন এলাকায় গত ১৩ বছরে চারবার চলন্ত বাসে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। এ সময় তিনজন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।

 

খুন হয়েছেন দুই নারী। স্থানীয় ব্যক্তিরা বলছে, এর বাইরেও ছোটখাটো অনেক ঘটনা ঘটে।

এগুলো খুব একটা জানাজানি হয় না। অপরাধীরা সহজেই পালাতে পারছে বলে বারবার এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর পর্যাপ্ত নিরাপত্তা থাকলে এ ধরনের ঘটনা রোধ করা সম্ভব।

 

পুলিশ, ভুক্তভোগী ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ২০০৯ সালের ২৬ জানুয়ারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা বাসন্তী মাংসাং বনাঞ্চলের জলছত্র থেকে টেলকি যাচ্ছিলেন। তাঁর সঙ্গে স্কুলের শিশুদের টাকা ছিল। পথে ডাকাতদল বাসন্তীকে কুপিয়ে হত্যা করে টাকা নিয়ে যায়। পরে বাসন্তীর স্বামী যতীশ নকরেক বাদী হয়ে মামলা করেন। তিনি বলেন, ‘মামলা এখনো চলমান। আসামিরা জামিনে বের হয়ে গেছে। আমি আদালতে নিয়মিত হাজিরা দিলেও ওরা আসে না। বিচার নিয়ে আমি সন্দিহান। এ ডাকাতদের যথাযথ বিচার চাই। ’

 

২০১৬ সালের ১ এপ্রিল এক নারী পোশাককর্মী টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী বাসস্ট্যান্ড থেকে ভোর ৫টার দিকে ‘বিনিময় পরিবহনের’ একটি বাসে কালিয়াকৈরের উদ্দেশে রওনা দেন। বাসে আর কোনো যাত্রী ছিল না। বাসটি কিছুদূর যাওয়ার পর চালকের সহকারী (হেলপার) বাসের জানালা-দরজা বন্ধ করে দেন। পরে গাড়ির চালক হাবিবুর রহমান নয়ন তাঁকে পেছনের আসনে নিয়ে ধর্ষণ করেন। এরপর বাসের কন্ডাক্টর-হেলপাররাও ধর্ষণ করেন। এরপর টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সড়কের একটি ফাঁকা জায়গায় ওই নারীকে নামিয়ে দিয়ে পালিয়ে যান। তাঁর স্বামী বাদী হয়ে টাঙ্গাইল মডেল থানায় ৯ জনকে আসামি করে মামলা করেন। পরে পুলিশ তদন্ত শেষে চারজনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দিয়ে ছয়জনকে অব্যাহতি দেয়। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আদালতের তৎকালীন বিশেষ পিপি নাসিমুল আক্তার বলেন, ২০১৯ সালের ২২ মে মামলার রায়ে চারজনকে যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয়। একই সঙ্গে প্রত্যেককে এক লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়। পরে আসামিরা উচ্চ আদালতে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন।

 

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট বগুড়া থেকে ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে সিরাজগঞ্জের জাকিয়া সুলতানা রূপাকে চলন্ত বাসে পরিবহন শ্রমিকরা ধর্ষণ করেন। পরে তাঁকে হত্যা করে টাঙ্গাইলের মধুপুর বন এলাকায় ফেলে যাওয়া হয়। পুলিশ ওই রাতেই তাঁর লাশ উদ্ধার করে। ময়নাতদন্ত শেষে পরদিন বেওয়ারিশ হিসেবে লাশ টাঙ্গাইল কেন্দ্রীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়। ২০১৮ সালে গণধর্ষণ ও হত্যা মামলায় চার আসামির মৃত্যুদণ্ড এবং একজনের সাত বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত। জব্দকৃত ছোঁয়া পরিবহনের বাসটি রূপার পরিবারকে হস্তান্তর করার নির্দেশও দেন আদালত। রূপার ভাই হাফিজুর রহমান বলেন, ‘মামলাটি উচ্চ আদালতে বিচারাধীন। কবে মামলার রায় কার্যকর হবে সেটা নিয়ে আমরা সংশয়ে আছি। ’

 

সর্বশেষ কুষ্টিয়া থেকে ছেড়ে আসা ঈগল পরিবহনের বাসটি বুধবার ভোরে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সড়কের মধুপুর উপজেলার রক্তিপাড়া জামে মসজিদের পাশে বালুর স্তূপে রেখে ডাকাতদল পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় এক যাত্রী বাদী হয়ে মামলা করেছেন। ডাকাতরা এক নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করে। ওই নারীকে শারীরিক পরীক্ষার জন্য টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হলে প্রাথমিকভাবে ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায়। তিনি আদালতে ২২ ধারায় জবানবন্দিও দিয়েছেন। বাসটিতে ২৪ থেকে ২৫ জন যাত্রী ছিল। এর মধ্যে ছয় থেকে সাতজন নারী যাত্রী ছিল। বাসের সবাইকে জিম্মি করে টাকা, স্বর্ণালংকার, মোবাইল ফোন—সব লুট করে নেয় ডাকাতরা। রাত দেড়টা থেকে সাড়ে ৩টা পর্যন্ত বাসটি ডাকাতদলের নিয়ন্ত্রণে ছিল। একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশ সুপার সরকার মোহাম্মদ কায়সার জানিয়েছেন, অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

 

মধুপুরের জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি ইউজিন নকরেক বলেন, এই বনাঞ্চল এলাকার নির্জন স্থানে ধর্ষণসহ প্রায়ই ছোটখাটো অপরাধ হয়ে থাকে। কিছু ঘটনা জানাজানি হয়, আবার অনেক ঘটনাই ধামাচাপা পড়ে যায়।

 

মধুপুর ডিগ্রি কলেজের সাবেক শিক্ষক জয়নাল আবেদীন বলেন, মধুপুরের নির্জন এলাকাকে অপরাধীরা নিরাপদ মনে করে। তাই চলন্ত বাসে ডাকাতি, হত্যা, ধর্ষণ এ এলাকায় বারবার ঘটছে। সড়কের জলছত্র থেকে রসুলপর পর্যন্ত আগে প্রায়ই প্রান্তিক পরিবহনে ডাকাতি হতো। তখন পুলিশ যাত্রীদের একত্রিত করে পাহারা দিয়ে অনিরাপদ সড়কটুকু পার করে দিত। এখন আর সে ব্যবস্থা নেই। ফলে রাতে চলাচলকারী যাত্রীরা অনেক সময় নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সড়কে, বিশেষ করে মধুপুর এলাকায় সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত জোরদার পুলিশি টহল থাকলে এ অপরাধগুলো রোধ করা যেত।

টাঙ্গাইল জেলা মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান আজাদ বলেন, ডাকাতদল ও অপরাধীরা মধুপুরের নির্জন স্থানে নিয়মিত অঘটন ঘটাচ্ছে। এ সড়কে মানুষের জানমাল হুমকির মুখে পড়ে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে আরো তৎপর হতে হবে। অপরাধী বাসচালক, হেলপারদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত হলেই বাসে এ ধরনের ঘটনা কমে যাবে।

মধুপুর থানার ওসি মোহাম্মদ মাজহারুল আমিন বলেন, ‘বাসে ডাকাতির ঘটনায় অনেক সময় চালক-হেলপারদের সঙ্গে ডাকাতদলের সদস্যদের যোগসাজশ থাকে বলে আমরা শুনি। কিন্তু ঈগল বাসের এ ঘটনার সঙ্গে এখন পর্যন্ত সে ধরনের যোগসাজশ পাওয়া যায়নি। তবু আমরা তদন্ত করে দেখব। মানুষের নিরাপত্তার জন্য এ সড়কে পুলিশি টহল ব্যবস্থা জোরদার করা হবে। ’