‘বয়স ৫৫ অতিক্রম করেছে। এর আগে থেকেই চশমা ব্যবহার করতে হচ্ছে। চশমা ছাড়া কোনো কিছু পাঠ করা সহজ হয় না। কিন্তু আমার মায়ের বয়স হয়েছে ৮০ বছর। এই বয়সে এসেও মা কোরআন পাঠ করেন চশমা ছাড়া। নিয়মিত নামাজের পাশাপাশি কোরআন পাঠ অবশ্যই করতে হবে মা-কে। মা আমাদের পরিবারর সকল সদস্যের কাছে নানান কারণে আদর্শের বিষয়। যার মধ্যে অন্যতম নিয়মিত নামাজ আদায় করা ও কোরআন পাঠ করা।’
দৈনিক বায়ান্নের কাছে মমতাময়ী মা সম্পর্কে ওইভাবে তুলে ধরেন সিলেট জেলা জজকোর্টের বিজ্ঞ আইনজীবী এডভোকেট দেলোয়ার হোসেন দিলু। সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ উপজেলার ফুলবাড়ি ইউনিয়নের কায়স্ত গ্রামে এডভোকেট দেলোয়ার হোসেন দিলুর বাড়িতে বসে মমতাময়ী মাকে নিয়ে আলোচনা হয় দীর্ঘ সময়। ৫৫ বিঘার বিশাল বাড়িতে রয়েছে প্রাচীনকালের স্থাপনা। রয়েছে ১৪ টি পুকুর। নানান ফল, সাক সবজিসহ সুপাড়ি বাগান। বিশাল এই বাড়িটি একাই সামাল দেন মা। বছরের পর বছর বাড়িটি তদারকি করে আসছেন বলে পুরো বাড়ির চিত্র মায়ের নখদর্পনে। আজো ওই তদারকি অব্যাহত রয়েছে।
এডভোকেট দেলোয়ারের পিতা শওকত হোসেন ছিলেন একজন পুলিশ অফিসার। ৫০ বছর বয়সে ১৯৯০ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ৬ ভাই বোন হলেন এনায়েত হোসেন ব্যবসায়ী, এডভোকেট দেলেয়ার হোসেন দিলু আইন পেশায় নিবেদিত, এমরান হোসেন রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী, কামরান হোসেন ব্যবসায়ী, রেদোয়ান হোসেন ব্যবসায়ী ও ছোট বোন জান্নাতুল ফেরদৌস চম্পা স্বামী-সন্তান নিয়ে যুক্তরাজ্যে বসবাস করেন।
এডভোকেট দেলোয়ার হোসেন দিলু জানান, দাদার একমাত্র সন্তান ছিলেন বাবা। চাকরির কারণে বাবা দেশের বিভিন্ন এলাকায় দায়িত্ব পালন করেছেন। স্বাভাবিক নিয়মে সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব মাকেই পালন করতে হতো। বাবার মৃত্যুর পর পুরো দায়িত্ব এককভাবে মায়ের উপর বর্তায়। মা আয়েশা খাতুন ভেঙ্গে পড়েননি। ৬ ভাই বোনকে সঠিক পথে পরিচালনাসহ সংসারকে এগিয়ে নিতে সাহায্য কামনা করেছেন মহান আল্লাহর। মা সফল হয়েছেন।
১৯৬৭ সালে জন্ম নেয়া এডভোকেট দেলোয়ার জানান, ১৯৭০ সালে তাঁর তৃতীয় ভাইয়ের জন্ম হয়। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়। সেসময় একটু একটু বুঝতেন তিনি। বাবা কর্মস্থলে। এদিকে আমাদেরকে নিরাপদ রাখতে অস্থির না হয়ে মা নিজকে সাহসী করে তোলেন। যুদ্ধের প্রথম দিকে বাড়িতে বাংকার করা হয়। যুদ্ধ বিমান উড়ে যেতে দেখলে মাসহ তিনভাই ওই বাংকারে আশ্রয় নিতেন। যুদ্ধের অবস্থা খারাপ হওয়ায় একসময় ঢাকা দক্ষিণের কানিশাইল গ্রামে নানা নজির উদ্দিনের বাড়িতে আশ্রয় নেন তারা। নানার বাড়িতে কয়েকটি বাংকার করা হয়েছিল। যখনই যুদ্ধ বিমানের শব্দ পেতেন, তখনই সবাই গিয়ে আশ্রয় নিতেন ওই বাংকারে। যুদ্ধের পুরোটা সময় ওইভাবে কেটেছে তাদের। মা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিন ভাইকে সব সময় চোখে চোখে রেখেছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ফিরে এসেছেন বাড়িতে।
এডভোকেট দেলোয়ার বলেন, বাড়িতে ফেরার পর ৬ বছর বয়সে ভর্তি হন স্কুলে। শিক্ষা জীবনে মায়ের কঠোর নজরদারি ছিল। ভোরবেলায় ঘুম থেকে জেগে উঠতেন মা। ফজরের নামাজ পড়ে (ভাত বিরন) ভাত ভাজি করতেন। বিরন ভাতকে এখন আধুনিক ভাষায় বলা হয় ফ্রাইড রাইছ। পরে আমাদেরকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলতেন। নাস্তা শেষে মক্তবে যাওয়ার পালা। কোয়াটার মাইল দূরে ছিল নাশাগঞ্জ মসজিদে মক্তব। ৮ টার সময় মক্তব ছুটি শেষে বাড়ি ফিরতে হতো। বাড়িতে এসেই খাওয়া দাওয়া শেষে স্কুলে যাওয়ার পালা। সেসময় নির্ধারিত কোনো স্কুল ড্রেস ছিল না। ওই অবস্থায় মা সকলকে স্কুলে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত করে দিতেন। বাড়ির পাশেই কায়স্ত গ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা জীবন শুরু হয় এডভোকেট দেলোয়ারের। স্কুলে যাওয়ার সময় কপালে টিপ দিয়ে দিতেন। অনেক সময় কপালে চুমু দিয়ে দোয়া পড়ে ফু দিয়ে দিতেন মা। হাতে ধরিয়ে দিতেন চার আনা বা আট আনা পয়সা। বিকেল তিনটার দিকে স্কুল ছুটি হতো।
এডভোকেট দেলোয়ার বলেন, স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে দেখতাম মা দাঁড়িয়ে আছেন সদর দরজায়। ঘরে ফিরে পোশাক পাল্টে দুপুরের খাবার খেতেন। মায়ের অনুমোতি নিয়ে বের হয়ে যেতেন খেলা ধুলার উদ্দেশ্যে। কিন্তু মাগরিবের আজানের আগেই ঘরে ফিরতে হতো। মাগরিবের নামাজ শেষে পড়ার টেবিলে যেতে হতো।
এডভোকেট দেলোয়ার জানান, ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত কোনো গৃহশিক্ষক ছিল না। গৃহশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন মা। রাত ১০ টা পর্যন্ত পড়ার টেবিলে থাকতে হতো। কারো চোখে ঘুমে এলে চোখে সরষের তেল লাগিয়ে দিতেন মা। এতে ঘুম কেটে যেতো। রাত ১০ টায় রাতের খাবার খেতাম মাটিতে মাদুর বিছিয়ে। খাবার শেষে ঘুমাতে যেতে হতো। মশারি টানিয়ে দিতেন মা। ঘুম পাড়ানির জন্যে রূপকথার গল্প বলতেন। হাত বুলিয়ে দিতেন মাথায়। এভাবে নরম গরম শাসনের মধ্য দিয়ে দিন কেটে যেত।
তিনি জানান, প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময় মা বলেছিলেন ভালোভাবে ৫ম শ্রেণি পাস করলে আমাকে হাতঘড়ি দেবেন। সেসময় ৫ম শ্রেণিতে চূড়ান্ত পরীক্ষা দিতে হতো। চূড়ান্ত পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করেছিলাম। মা আমাকে ঘড়ি উপহার দিয়েছিলেন। ওই ঘড়ি মামা পাঠিয়েছিলেন যুক্তরাজ্য থেকে। সেসময় হাত ঘড়ি ব্যবহার ছিল অনেকটা স্বপ্নের বিষয়।
তিনি বলেন, নিয়মিত মা-ই লেখাপড়ার বিষয়ে কঠোর নজরদারি করতেন। রমজান মাসে সকাল বেলায় কোরআন পড়াতেন মা। এখানেই শেষ নয়। নিয়মিত নামাজ পড়ার বিষয়ে তিনি ছিলে কঠোর। নামাজ কাজা হলে শাস্তি পেতে হতো। বাড়িতে কাজের লোক ছিল। এখনো আছে। তাদেরকে সাথে নিয়ে বিশাল বাড়ির যাবতীয় কাজ মা একাই সামাল দিতেন। এখনো দেন। বাড়িতে অনেক সুপাড়ি গাছ রয়েছে। প্রতি বছরই বিপুল পরিমাণ সুপাড়ি ফলে। ওই সুপাড়ি সংরক্ষণ করে বিক্রি করা হয়। সাক সবজি ফলসহ অন্যান্য ফসল ফলে বাড়িতে। নিজেদের প্রয়োজন মিঠিয়ে বাকি ফসল বিক্রি করে দেয়া হয়। অনেক ক্ষেতের জমি রয়েছে। কয়েকশ মণ ধান ফলে। সংসারের প্রয়োজন মিটিয়ে ওই ধান বিক্রি করে দেয়া হয়।
তিনি জানান, মায়ের অসুখ বিসুখের যাবতীয় ওষুধের যোগান দেয়া হয়। এছাড়া তিনি যখন যা চান তাই পেয়েই যান। কিন্তু প্রতি মাসে তিনি বাবার পেনশনের টাকা পেয়ে থাকেন। ওই টাকা তিনি নাতি নাতনিদের মধ্যে বিতরণ করে থাকেন। এছাড়া অনেকে সাহায্য পেতে মায়ের দিকে হাত বাড়ায়। তাদেরকে খালি হাতে ফেরান না মা।
এডভোকেট দেলোয়ার হোসেন দিলু বলেন, মায়ের কাছে তিনি এবং অন্য ভাই বোনেরা এখনো শিশুর মত। রাত নেমে এলেই আমাদের অবস্থান জানতে চেয়ে ফোন করতে শুরু করেন। কখন বাড়ি ফিরব তা জানাতে হয়। এর মধ্যে কেউ যদি ফোন না ধরেন, তাহলে মায়ের অস্থিরতা বেড়ে যায়। পুত্রবধূ বা অন্য সন্তানের কাছে ফোন করে জানতে চাইবে ‘অমুক’ ফোন ধরছে না কেন। কাঙ্খিত উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত অস্থিরতায় সময় কাটে মায়ের। খাওয়া দাওয়া, নামাজ বন্দেগী করছি কিনা এখনো সেই খবর রাখেন নিয়মিত।