এবার ২২০-২৫০ কোটি টাকা আয়ের সম্ভবনা
মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে লাভের বেশি অংশ
রপ্তানী হয় বিদেশেও, বর্তমানে দাম কিছুটা কমেছে
এখন আনারসের ভরা মৌসুম চলছে। বাগান থেকে শুরু করে বাজার পর্যন্ত আনারসের মিষ্টি গন্ধে সুভাস ছড়াচ্ছে। টাঙ্গাইলের মধুপুরের আনারসের স্বাদ ও সুনাম এক সময় সারাদেশেই এক নামে ছিল। মাঝে রাসায়নিকের অত্যাধিক ব্যবহারের কারণে আনারসের বিক্রি ও সুনাম কিছুটা নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু বর্তমানে কৃষকরা আবার বিষমুক্ত আনারস চাষে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। ফিরে আসতে শুরু করেছে মধুপুরের সেই আনারসের হারানো ঐতিহ্য।
মধুপুর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, এবছর ৬ হাজার ৫৮২ হেক্টর জমিতে চাষকৃত আনারস উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ২ লক্ষ ৬১ হাজার ৬০০ মেট্রিক টন। এতে আনুমানিক আয় ধরা হয়েছে ২২০ থেকে ২৫০ কোটি টাকা।
আনারসের রাজধানী হিসেবে খ্যাত মধুপুরে জমে উঠেছে রসালো ফল আনারসের বাজার। এখন আনারসের ভরা মৌসুম। এবার আবহাওয়া ভাল থাকার কারণে ভাল দাম পাচ্ছেন কৃষকরা, মুখে ফুটেছে হাসিও। তবে বর্তমানে আনারসের দাম কিছুটা কমেছে। গড়াঞ্চলের চাষি, পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা মহা ব্যস্ত সময় পাড় করছেন। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত চলে কাজকর্ম। গড় এলকার জলছত্র, মোটের বাজার, গারোবাজার, সাগরদিঘী ও আশ্রাবাজারে জমে উঠেছে আনারসের কেনাবেচার হাট বাজার। সকাল থেকেই সাইকেল, ভ্যান, রিক্সা, অটো বাইক ও ঘোড়ার গাড়ীতে করে বাজারে আনারস নিয়ে আসেন কৃষকরা। সারিবদ্ধভাবে সাজিয়ে রাখা হয় আনারস ভর্তি যানগুলো। দেশের বিভিন্নপ্রান্ত থেকে আসা পাইকাররা কৃষকদের সাথে দর কষাকষি করে আনারস ক্রয় করেন। ক্রয়কৃত আনারস ট্রাকভর্তি করে সারাদেশে সরবারহ করা হয়। আনারস উৎপাদন ও ক্রয় বিক্রয়ের সাথে জড়িত শ্রমিকরা মজুরি ভালই পাচ্ছেন। বাজারগুলো আনারসের ব্যবসার কারনে জনার্কীর্ন। স্থানীয় খাবার হোটেল ও চায়ের দোকানীদের বেচা বেড়ে গেছে।
মধুপুরের আনারসের স্বাদ ও গন্ধ অতুলনীয়। বাণিজ্যিকভাবে আনারস চাষ করতে গিয়ে বেশি লাভের আশায় চাষিরা আনারসের আকার, রং উজ্জল ও অসময়ে বাজারে উঠানোর জন্য নানা ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার করছেন। এতে সুনাম হারাতে বসেছে মধুপুরের আনারসের।
আনারসের সবচেয়ে বড় হাট জলছত্রে গিয়ে দেখা যায়, দম ফেলার সময় নেই ক্রেতা বিক্রেতা, শ্রমিকদের। কথা হয় কৃষক আবু বক্কর সিদ্দিকের সাথে। তিনি বলেন, আমি ২৫ বছর ধরে আনারসের চাষ করি। আমার বাবাও আনারসের চাষ করতেন। কিছুদিন আগে বাগান থেকে যে ফল ৪০ টাকায় বিক্রি করেছি, এখন সেটা ২২ টাকা। এবার ফলন ভালো হয়েছে। নষ্টও কম হয়েছে। শোলাকুড়ি গ্রামের আলী হোসেন বলেন, প্রচন্ড গরমে আনারসের চাহিদা বেশি থাকায় দাম মোটামুটি ভালো। প্রতি আনারসে ৫-৬ টাকা লাভ হয়।
লোকমান তালুকদার বলেন, আমরা খরচা অনুয়ায়ী লাভ পাই না। পাইকারগোই বেশি লাভ হয়। ফুলবাগচালা গ্রামের কৃষক হাবিবুর রহমান সিন্টু বলেন, বিষমুক্ত আনারস চাষ করছি। তবে সে অনুযায়ী দাম পাচ্ছি না।
দিনাজপুর থেকে আসা পাইকার সাজ্জাদ মিয়া বলেন, আনারস ভেদে ২৫, ৩০, ৩৫, ৪০ থেকে ৪৫ পর্যন্ত কিনি। তারপর আড়তে দেই। সেখান থেকে নিয়ে আবার খুচরা বিক্রেতারা লোকজনদের কাছে বিক্রি করে। প্রতি আনারসে ৫-৭ টাকা লাভ থাকে। বেশি লাভ করেন খুচরা দোকনদাররা। তারা ৮০, ৯০, ১০০, ১১০ টাকা পর্যন্ত প্রতি আনারস বিক্রি করেন।
মধুপুর থেকে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল হওয়ায় ঢাকা, কুষ্টিয়া, বগুড়া, সিলেট, নাটোর, রাজশাহী, খুলনা, হবিগঞ্জ, নীলফামারী, গাইবান্ধা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, কুমিল্লা, চাঁদপুর, নারায়নগঞ্জ ও দিনাজপুরসহ সারাদেশেই আনারস যায়।
জলছত্র কাঁচামাল ও সংরক্ষণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক হারুন অর রশিদ বলেন, কৃষকদের চেয়ে আগত পাইকরা এবং খুচরা ব্যবসায়ীরাই বেশি লাভবান হন।
মধুপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আল মামুন রাসেল জানান, চলতি বছর উপজেলায় আনারসের চাষ হয়েছে ৬ হাজার ৫৮২ হেক্টর জমিতে। গত বছরের তুলনায় এবার বেশি চাষাবাদ হয়েছে। উপজেলা ছাড়াও গড় এলাকার ঘাটাইল, ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া ও মুক্তাগাছা এবং জামালপুর সদরে আনারস চাষ হয়েছে। এখানে হানিকুইন, জায়ান্ট কিউ এবং ফিলিপাইনের এমডিটু জাতের আনারস চাষ হয়ে থাকে। বিষাক্ত কেমিকেল ব্যবহার থেকে কৃষকরা সরে আসতেছেন। মধুপুরের আনারস দেশের বাইরেও প্রসেসিং করে রপ্তানি হয়ে থাকে। তিনি আরও জানান, আনারসের জমিতে আদা, হলুদ, কলা, কচু ও পেঁপে চাষ করা যায়। আনারস বেশির ভাগই জলছত্র পাইকারি হাটে বিক্রি হয়ে থাকে। জুন মাসের শেষ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গরমে আনারসের চাহিদা থাকে। গত কয়েক বছরের চেয়ে এ বছর বেশি দামও পাচ্ছেন কৃষকরা। প্রতিপিচ আনারস ২০-৫০ টাকা পর্যন্ত পাইকারি বিক্রি হচ্ছে। মধ্যস্বত্বভোগীরা বেশি লাভবান হন।