ঢাকা, শুক্রবার ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ই পৌষ ১৪৩১

চট্টগ্রামে অনলাইন জুয়ার আসক্তি বাড়ছে

মো. এনামুল হক লিটন/সাহেনা আক্তার, চট্টগ্রাম : | প্রকাশের সময় : শুক্রবার ১৯ নভেম্বর ২০২১ ০৭:৫২:০০ অপরাহ্ন | চট্টগ্রাম প্রতিদিন

ক্যাসিনো, জুয়ার বোর্ডের বিপরীতে চট্টগ্রামে এবার অনলাইন জুয়ার আসক্তিতে ঝুঁকে পড়ছে যুব সমাজ। নিজেদের ব্যবহৃত মোবাইলে জুয়ার সাইটগুলোতে অ্যাকাউন্ট খোলে মোটা অঙ্ক বাজি ধরে চলছে এসব জুয়া খেলা। অভিযোগ রয়েছে, প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে রাস্তা, ফুটপাত, রেষ্টুরেন্ট, রেলক্রসিংসহ যত্রতত্র বসে এসব জুয়ার পরিচালনা করছে একশ্রেণীর অসাধু ব্যক্তিরা। ফলে যুব সমাজ ধাবিত হচ্ছে অন্ধকারের পথে। এসব জুয়াকে ঘিরে লাখ-লাখ টাকা যেমন খোয়াচ্ছে অনেকে তেমনি লাখ-লাখ টাকার বানিজ্য করছে অসাধু জুয়ারিয়া।

জানা যায, পুলিশ ও র‌্যাবের অভিযানের মুখে ক্যাসিনোকান্ড ও জুয়া কান্ডে ভাটা পড়লেও নগরজুড়ে এবার অনলাইন জুয়াড়িদের উৎপাত উদ্বেগজনক বৃদ্ধি পেয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী মাঝে-মধ্যে এ ধরণের জুয়াড়িদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করলেও কমছে না তাদের অপতৎপরতা। অভিযোগ রয়েছে, স্থানিয় পর্যায়ের কয়েক রাজনৈতিক নেতা, কতিপয় পুলিশ সোর্স ও কিশোর গ্যাং লিডারদের ছত্রছায়ায় নগরীর ১৬টি থানার বিভিন্ন অলিগলি এমনকি আবাসিক এলাকায়ও চলছে নানা ধরণের জুয়া খেলা। তার ওপর এখন যুক্ত হয়েছে অনলাইন জুয়া। এসব জুয়ায় অংশ নিয়ে সর্বশান্ত হচ্ছে অনেকেই। নষ্ট হচ্ছে সমাজ ব্যবস্থাও।

জানা যায়, ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে চট্টগ্রামসহ সারাদেশে দলমত নির্বিশেষে বিভিন্ন খাতের অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা ও অবৈধ অর্থের বিরুদ্ধে ‘শুদ্ধি অভিযান’ শুরু করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে দৃশ্যমান এসব অভিযানের নের্তৃত্ব দেয় পুলিশের এলিট ফোর্স র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। ওই বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ফকিরাপুলে ইয়াং ম্যান্স ক্লাবে ক্যাসিনো বিরোধী অভিযান শুরু করে র‌্যাব।

এরপর একে-একে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন নামীদামী ক্লাবগুলোতে র‌্যাবের ধারাবাহিক অভিযানে বেরিয়ে আসতে থাকে ক্যাসিনোর অন্ধকার জগৎ। একের পর এক অব্যাহতভাবে লাগাতার এসব অভিযানের ফলে চট্টগ্রামে ক্যাসিনোকান্ডে ভাটা পড়ে। বন্ধ হয়ে যায়, চট্টগ্রামের অসংখ্য ক্লাব। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সমাজ বিরোধি অসাধু চক্ররা নগরজুড়ে শুরু করেছে জুয়ার ব্যবসা পাশাপাশি যুক্ত করেছে অনলাইন জুয়া।

এসব জুয়ার ব্যবসার সাথে ক্যাসিনো কান্ডের বিভিন্ন ক্লাব মালিকরা জড়িত বলেও জানা গেছে। সিএমপি প্রশাসন মাঝে-মধ্যে এসব জুয়ার আসরে হানা দিলেও তেমন সুফল মিলছে না। বলা হচ্ছে, পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে একের পর এক আস্তানা বদল করে নগরীর বিভিন্ন থানা এলাকায় প্রতিদিনই বসছে জুয়ার আসর। ইতিমধ্যে পুলিশ ও র‌্যাব এসব বিভিন্ন জুয়ার আসরে হানা দিলেও অনলাইন জুয়ারিয়া রয়ে গেছে অধরা।

অভিযোগ রয়েছে, জুয়া খেলায় অংশ গ্রহণ কারিরা ধরা পড়লেও জুয়ার মূল হোতারা সবসময় থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। এছাড়া জুয়া খেলার মতো দূর্বল মামলার কারণে অল্পদিন সাজা ভোগ করে নতুবা জামিনে ছাড়া পেয়ে এসে এসব জুয়ারিরা আবারো সংগঠিত হয়ে পূর্বের পেশায় ফিরে যায়। জানা গেছে, নগরীর ক্রাইমজোন হিসেবে খ্যাত অপরাধ প্রবণ এলাকার শীর্ষে রয়েছে, বায়েজিদ, চান্দগাঁও ও বাকলিয়া থানা এলাকা।

এসব এলাকায় নির্দিষ্ট জুয়ার আস্তানা ছাড়াও অলিগলির চায়ের দোকানগুলোতে চলছে কেরাম-দাবা, অনলাইন জুয়াসহ বিভিন্ন জুয়ার আসর। শুধুমাত্র নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী থানা এলাকার আমিন জুট মিল কলোনী, রৌফাবাদ জলদা সংলগ্ন এলাকা, বাংলাবাজার ব্যাংক পাহাড়, ডেবারপাড়, মুক্তিযোদ্ধা কলোনী, আরেফিন নগর, বায়েজিদ বোস্তামী মাজারের পিছনেসহ আরো বেশ কয়েকটি এলাকায় সন্ধ্যার পর জমজমাট জুয়ার আসর বসে। এসবস্থানে বায়েজিদ বোস্তামী থানা পুলিশ বিভিন্ন সময় হানা দিলেও থেমে নেই জুয়াকান্ড।

সরেজমিনে বায়েজিদ বোস্তামী থানার ডেবারপাড় জামতলা এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে জুয়াকান্ডের আস্তানা না থাকলেও দুটি চায়ের দোকানে রাত-দিন প্রকাশ্যে চলে কেরাম-দাবা ও অনলাইন জুয়াকান্ড। এসব দোকানিরা নামকা ওয়াস্তে চায়ের দোকান বলে চালিয়ে গেলেও দোকানে টিভি, ডিশ-এন্টেনা প্রর্দশণীর মাধ্যমে মূলত: কাষ্টমার আকৃষ্ট করে চালাচ্ছে কেরাম জুয়ার আসর। ওই দোকানে দাবা খেলারত এক ব্যক্তি জানান, ভাই আসলে জুয়া নয়, অবসরে সময় কাটানোর জন্য বসে-বসে চায়ের বাজিতে দাবা খেলি। অর্থ্যাৎ যে হেরে যাবে সে সবাইকে চা খাওয়াতে হবে। এটাই দোকানদারের মূল ব্যবসা।

অক্সিজেন রেলক্রসিং সংলগ্ন জলদা এলাকার ব্যবসায়ি ফজলুর রহমান জানান, বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত এলাকার কিছু ওঠতি ও বখাটে যুবকরা পূরো রেল লাইনে অনলাইন জুয়ার আসরে মেতে ওঠে। শুধু তাই নয়, সন্ধ্যায় পোশাক কারখানা ছুটি হলে পাশ্ববর্তী এলাকার মহিলা শ্রমিকরা রেল লাইন পথ চলতে পারে না।

তাদেরকে সরে বসতে বললে উল্টো মহিলার সাথে অশোভন আচরণ করে। সূত্র জানায়, পুলিশ সোর্স নামদারি কতিপয় ব্যক্তি এসব জূয়ার আসরের নেতৃত্ব দিচ্ছে। ফলে প্রকাশ্যে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চায়ের দোকান, রাস্তাঘাট, রেল ক্রসিং ও অলিগলির বিভিন্ন এলাকাগুলোতে কেরাম-দাবা ও টিভি প্রর্দশণ করার পাশাপাশি অনলাইন জুয়ার আসর চলছে হরদম। জানা যায়, এসব জুয়া খেলাকে ঘিরে প্রতিদিন ঝগড়া-বিবাদসহ দাঙ্গা-হাঙ্গামা লেগে থাকার পাশাপাশি চলাচলের সময় মহিলা ও পোশাক শ্রমিকরা নানা সমস্যার সম্মুখিন হচ্ছেন। এ অবস্থা চলতে দেয়া যায় না বলে মত প্রকাশ করেছেন সচেতন নগরবিদরা।

তবে সিএমপির শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা অপরাধ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি সব ধরণের জুয়ার আসরের বিরুদ্ধে শীঘ্রই সাড়াশি অভিযান পরিচালনা করা হবে বলে জানিয়েছেন। একই কথা জানিয়েছেন, র‌্যাব-৭ এর সিনিয়র সহকারি পরিচালক (জনসংযোগ) ফ্লাইট লেফট্যানেন্ট নিয়াজ মোহাম্মদ চপল। তিনি জানান, র‌্যাবের নিয়মিত অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

সন্ত্রাসী, মাদক ব্যবসায়ি ও জুয়ার আসরের দিকে আমাদের বাড়তি নজরদারি রয়েছে।