লক্ষ্মীপুরে আলোচিত যুবলীগ নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান ও ছাত্রলীগ নেতা রাকিব ইমাম হত্যা মামলায় আলমগীর ওরফে কদু আলমগীরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বুধবার (৩ মে) সন্ধ্যায় তিনি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকার ঘটনায় ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট চন্দ্রগঞ্জ আমলি আদালতের বিচারক আনোয়ারুল কবীর তার জবানবন্দি গ্রহণ করেন।
রাত সাড়ে ৮টার দিকে লক্ষ্মীপুর জেলা পুলিশ সুপার মাহফুজ্জামান আশরাফ ব্রিফ করে সাংবাদিকদের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এর আগে মঙ্গলবার (২ মে) রাতে মামলার ৩য় আসামি রামগঞ্জ উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম-আহ্বায়ক দেওয়ান ফয়সাল হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার ঘটনায় আদালতে জবানবন্দি দেন।
পুলিশ জানায়, কদু আলমগীরের বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক, দস্যুতা, অপহরণ এবং বিস্ফোরণ আইনে লক্ষ্মীপুরের চন্দ্রগঞ্জ থানা, নোয়াখালীর চাটখিল থানা এবং চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানায় ১০টি মামলা রয়েছে।
আলমগীর এক সময় সন্ত্রাসী লাদেন মাসুম বাহিনীর সক্রিয় সদস্য ছিলেন। লাদেনের মৃত্যুর পর তিনি বাহিনী পরিবর্তন করেন। নোমান ও রাকিব হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত ১৮ নম্বর আসামি আলমগীর। তিনি সদর উপজেলার উত্তর জয়পুর ইউনিয়নের উত্তর মাগুরী গ্রামের আবু কালামের ছেলে। তাকে মঙ্গলবার রাতে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
জবানবন্দিতে আলমগীর জানান, ২৫ এপ্রিল দুপুর ২টার দিকে দুজন লোক তার বাড়িতে যায়। তখন তাকে জানানো হয় নোমানকে মারতে হবে। দুজন লোকের সঙ্গে মোটরসাইকেলে করে তিনি নাগেরহাট আসেন। সেখান থেকে তারা বশিকপুরের একটি বড় মাঠে যান। সেখানে আরও ৩০-৪০ জন লোক ছিলেন। তখন একজন লোক তাদেরকে শর্টগান, রিভলবার ও পিস্তলসহ বিভিন্ন আগ্নেয়াস্ত্র দেন। পরে ৭-৮ জন করে ৫-৬টি দলে তাদের ভাগ করে দেওয়া হয়। আলমগীরের দলে ৮ জন ছিলেন। এ সময় ওই ব্যক্তি সবাইকে কার্যক্রম বুঝিয়ে দেন। তাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল নোমানকে হত্যা করা।
ঘটনার আগে কদু আলমগীরের গ্রুপটি ঘটনাস্থলের অদূরে করাত কলের পাশে প্রায় ৪৫ মিনিট অপেক্ষা করেছে। পরে তারা ঘটনাস্থল থেকে গুলির শব্দ শোনে। এ গ্রুপটি দৌঁড়ে এসে দেখে রাকিব ইমাম পড়ে আছেন। নোমান পালাচ্ছিলেন। তখন তিনজন মিলে তাকে ধরে গুলি করে হত্যা করে। নোমান নিহত হলে তাদের গ্রুপটি নাগেরহাট মাদরাসার সামনে যায়। সেখানে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ছিল। ৫ জন সিএনজিতে করে চলে যায়। বাকি তিনজন মোটরসাইকেলে করে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। হত্যাকাণ্ডে সে নিজেও পিস্তল ব্যবহার করেছে। ঘটনা শেষে অস্ত্রগুলো ওই ব্যক্তির কাছে জমা দিয়ে দেয়।
পুলিশ সুপার জানান, সিসিটিভি ফুটেজে কদু আলমগীরসহ যে ৮ জনকে দেখা যাচ্ছে, তাদের মধ্যে ৫ জনের পরিচয় সে পুলিশকে জানিয়েছে।
প্রেস ব্রিফিংয়ে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এ বি ছিদ্দিক, মংনেথোয়াই মারমা, সোহেল রানা, ডিআইওয়ান আজিজুর রহমান মিয়া ও সদর মডেল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোসলেহ উদ্দিন।
নোমান - রাকিব হত্যা মামলার বাদী মাহাফুজ চেয়্যারম্যান বলেন ,কদু আলমগীর আটক হলেও মূল আসামি জেহাদী আটক না হলে আতঙ্ক থেকেই যাচ্ছে। এছাড়াও আওয়ামীলীগ নেতারা এই ঘটনায় কেউকেই বহিঃষ্কার করেনি। উল্টো আওয়ামীলীগ আইনজীবিরা আসামিদের পক্ষ নিয়েছে ।যা লজ্জাজনক ।
প্রসঙ্গত,রাকিব - নোমান হত্যার প্রধান আসামী আবুল কাশেম জেহাদী ১৯৯৬ সালে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে জামায়াত-বিএনপির সমর্থনপুষ্ট প্রার্থী আবুল বাশারের পক্ষে কাজ করেন। ভোটের দিন রকেট লঞ্চার নিক্ষেপ করে নতুন করে আলোচনায় আসেন। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করতে শতাধিক সদস্য নিয়ে গড়ে তোলেন 'জিহাদী বাহিনী'। তখন থেকেই জড়িয়ে পড়েন খুনখারাবিতে। ১৯৯৮ সালে প্রকাশ্যে দফাদার আবুল কাশেমের পায়ে গুলি করেছিলেন। তখন মামলা থেকে রেহাই পেতে যোগ দেন আওয়ামী লীগে। তাঁর যোগদানে ভূমিকা রেখেছিলেন তৎকালীন লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু তাহের। আওয়ামী লীগের সমর্থনে জিহাদী দুইবার ইউপি চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হন। সবশেষ নির্বাচনে তিনি দলের 'বিদ্রোহী' প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন।বশিকপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, আবুল কাশেম জিহাদী তাঁর সন্ত্রাসী বাহিনীর মাধ্যমে হত্যা, নির্যাতন, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত। তাঁর বিরুদ্ধে এক ডজন খুনের অভিযোগ আছে। ১৯৯৮ থেকে জিহাদীর বিরুদ্ধে ৯৪টি মামলা হয়েছে। বর্তমানে ২০টির বেশি মামলা বিচারাধীন।
র্যাব-১১-এর নোয়াখালী ক্যাম্পের কোম্পানি অধিনায়ক জানান, কাশেম জিহাদী ২০১৩ সালে দত্তপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান নুর হোসেন শামিম, ২০০০ সালে আইনজীবী নুরুল ইসলাম, দত্তপাড়া এলাকার আবু তাহের, বশিকপুরের নন্দীগ্রামের মোরশেদ আলম, করপাড়ার মনির হোসেন, উত্তর জয়পুরের সেলিম ভূঁইয়া ও কামাল হোসেন হত্যা মামলারও প্রধান আসামি।
আরো উল্লেখ্য, ২৫ এপ্রিল রাতে সদর উপজেলার বশিকপুর ইউনিয়নের পোদ্দারবাজার এলাকায় জেলা যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নোমান ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক রাকিবকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এসময় সন্ত্রাসীরা তাদের ব্যবহৃত মোটরসাইকেল ও মোবাইল নিয়ে যায়। গুলির শব্দ শুনে ঘটনাস্থলে গিয়ে স্থানীয় লোকজন তাদেরকে উদ্ধার করে সদর হাসপাতালে নেয়। সেখানে চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন। পরদিন রাতে নিহত নোমানের বড় ভাই ও বশিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান বাদী হয়ে ৩৩ জনের বিরুদ্ধে চন্দ্রগঞ্জ থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। এতে চন্দ্রগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আবুল কাশেম জিহাদিকে প্রধান করে ১৮ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাত ১৫ জনকে আসামি করা হয়। মামলার পর থেকে মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত র্যাব ও পুলিশ অভিযান চালিয়ে ১০ আসামিকে গ্রেপ্তার করে। এরমধ্যে আসামি মশিউর রহমান নিশান ও রুবেল দেওয়ানের ৫ দিন এবং মো. সবুজ, আজিজুল ইসলাম বাবলু ও নাজমুল হোসেন নাজিমের ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।