ঢাকা, বৃহস্পতিবার ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ঠা আশ্বিন ১৪৩১

দেশ সংগ্রামী মজনু এখন করাত কল শ্রমিক, পাননি স্বীকৃতি

তোফায়েল হোসেন জাকির, গাইবান্ধা : | প্রকাশের সময় : রবিবার ১২ ডিসেম্বর ২০২১ ০৩:২০:০০ অপরাহ্ন | দেশের খবর

মজনু মিয়া। ৭১’এ ছিলেন টগবগে যুবক। ঠিক তখনই জীবনের মায়া  ত্যাগ করে ঝাঁপিয়ে পড়েন স্বাধীনতা অর্জনের জন্য। এমন অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের অংশগ্রহণে দেশ হয়েছিল স্বাধীন। জনগণ পেয়েছে স্বাধীনতার সুখ। কিন্তু দেশ স্বাধীনের ৫০ বছরেও মজনু মিয়া পাননি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি। তাই জীবনযুদ্ধে পরাজীত হয়ে তিনি এখন করাত কল শ্রমিক। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে দুর্বিষহ জীবনে বসবাস করছেন একটি গুচ্ছগ্রামে। 

এই মজনু মিয়ার বাড়ি গাইবান্ধা জেলার সাদুল্লাপুর উপজেলার বনগ্রাম ইউনিয়নের জয়েনপুর গ্রামে। তিনি ওই গ্রামে মৃত খবির উদ্দিনের ছেলে। 

সরেজমিনে রোববার (১২ ডিসেম্বর) জানা গেছে, মজনু মিয়ার বয়স এখন প্রায় ৬৬ বছর। বসতভিটা হারিয়ে বর্তমানে তিনি জয়েনপুরের একটি গুচ্ছগ্রামে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

জানা যায়,  ৭১’এ মজনু মিয়া ছিলেন টগবগে যুবক। সেই সময় দেশটা ছিল উত্তাল। বাংলাকে নিজের রূপে রূপ দেওয়ার নেশায় কাঁপছিল পুরো দেশ। পাকিস্থানীদের শোষণ আর অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন এদেশের আপামর জনগণ। ঠিক তখনই মজনু মিয়া জীবনের মায়া ত্যাগ করে দেশকে রক্ষার্থে ঝাঁপিয়ে পড়েন স্বাধীকার আদায়ের জন্য। তার অদম্য সাহস আর দেশপ্রেম তাকেও নিয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধে।

তিনি ভারতের কাকড়ীপাড়া প্রশিক্ষণ শিবিরের আজিম মাহবুরের কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে গাইবান্ধার কামারজানি, কঞ্চিবাড়ী ও দক্ষিণ দূর্গাপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় ক্যাপ্টেন হামিদ উল্লার নেতৃত্বে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তার অধিনায়ক ছিলেন আব্দুল হামিদ পালোয়ান। যুদ্ধকালীন ১১নং সেক্টরে মজনু মিয়ার সহযোদ্ধা হিসেবে ছিলেন- আবেদ আলী, সুলতান গিয়াস ও আলতাফ হোসেন। এই মহাবীরের এমন অনেক সফল সাহসী অভিযান হয়েছিল যুদ্ধকালীন সময়ে। দেশ হয়েছিল স্বাধীন। এক্ষেত্রে তৎকালীন সময়ের অধিনায়ক মুহম্মদ আতাউল গনি ওসমানী স্বাক্ষরিত দেশ স্বাধীনতা সংগ্রামের সনদপত্র পান মজনু মিয়া। যার সনদ নম্বর ১৬৫৮৮৫। কিন্তু মজনু মিয়া সনদ পেলেও পাননি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি। যুদ্ধের পর বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা  সংসদ গাইবান্ধা জেলা ইউনিটিরে সাবেক কমান্ডার নাজমুল আরেফিন তারেক, সাদুল্লাপুর উপজেলা ইউনিটের সাবেক কমান্ডার মেছের উদ্দিন সরকারসহ আরও অনেকে তাকে প্রত্যায়নপত্র দেন।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে গেজেটধারী মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেতে দুই বছর আগে অনলাইনসহ বিভিন্ন মাধ্যমে আবেদন করেন তিনি। এরই প্রেক্ষিতে সাদুল্লাপুর উপজেলা যাচাই-বাছাই কমিটি কর্তৃক মজনু মিয়াকে “গ” তালিকাভুক্ত করেন। ওই কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, মজনু মিয়ার সংগ্রামী সনদপত্র থাকলেও ক্রমিক নম্বর নেই। এ কারণে তাকে তালিকা থেকে বাতিল করা হয়েছে। অথচ ওই সনদপত্রের অপর পৃষ্ঠায় ক্রমিক নম্বর ছিল। বাধ্য হয়ে মজনু মিয়া জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে আপিল করেন। 

পরবর্তীতে গাইবান্ধা-৩ আসনের সাবেক সাংসদ ডা. ইউনুস আলী সরকার সাদুল্লাপুর ইউএনও’র নিকট ডিও লেটার দেন। তৎকালীন ইউএনও রহিমা খাতুন ওই ক্রমিক নম্বর যাচাইয়ের জন্য সাদুল্লাপুর উপজেলা সমাজসেবা অফিসারকে দায়িত্ব দেন। এর ফলে মজনু মিয়ার যুদ্ধকালীন যাবতীয় কাগজপত্র পুনঃযাচাই-বাছাই করে ক্রমিক নং খুঁজে পান এবং তার নাম তালিকাভুক্ত করতে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠান।

এসব তথ্য নিশ্চিত করে মজনু মিয়া বলেন, সাদুল্লাপুর উপজেলা যাচাই-বাছাই কমিটি কর্তৃক আমাকে “গ” তালিকাভুক্ত করায় জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে আপিল করি। এরই প্রেক্ষিতে ফের যাচাই-বাছাই কার্যক্রমে চিঠির মাধ্যমে আমাকে ডাকা হয়। গত  ৬ অক্টোবর/২১ইং তারিখে গাইবান্ধা সার্কিট হাউজ সম্মেলন কক্ষে এ কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করি। এসময় মুক্তিযোদ্ধার স্বপক্ষে আবেদনের কপি ও সকল প্রমানাদি পেশ করা হয়। 

তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে আরও বলেন, আমার কোন অর্থ-সম্পদ কিংবা কোন জমিজমাও নেই। প্রায় ১৩ বছর ধরে স্ত্রী-সন্তান-নাতী-নাতনী নিয়ে গুচ্ছগ্রামে বসবাস করে আসছি। জীবিকার তাগিদে স্থানীয় একটি ‘ছ’ মিলে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে কোনমতে জীবিকা নির্বাহ করছি। সরকার আমাকে যদি  মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিতেন তাহলে শেষ বয়সে হয়তো কিছুটা শান্তি পেতাম। 

সাদুল্লাপুর উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধা আবেদ আলী বলেন, যুদ্ধকালীন সময়ে ১১নং সেক্টরে মজনু মিয়া সহযোদ্ধা হিসেবে একই সঙ্গে কাজ করেছি। তাকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য জোর দাবি জানাচ্ছি।