ধর্মান্তর হওয়াসহ মুসলিম রীতি অনুস্মরণে মেডিকেল ছাত্রীকে বিয়ে করেছেন ডা. তন্ময় কুমার দেবনাথ নামের এক চিকিৎসক। নথিপত্রে বিয়ের চার বছর হলেও এখনও ছাত্রীর মেলেনি স্ত্রী হিসেবে পারিবারিক স্বীকৃতি। এরপরও সংসার বাঁধার স্বপ্ন দেখেছেন ওই ছাত্রী। এতে সইতে হয়েছে চিকিৎসক প্রেমিক স্বামীর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। বিবাহ বিচ্ছেদের কৌশল হিসেবে এখন ছাত্রীর আপত্তিকর চারিত্রিক তথ্য প্রচারে লিপ্ত হয়েছেন তার চিকিৎসক স্বামী বলে অভিযোগ তুলেছেন ভুক্তভোগী মেডিকেল ছাত্রী।
স্ত্রীর স্বীকৃতি প্রাপ্তিতে ব্যর্থ আর প্রতারণার শিকার ওই ছাত্রী এখন বিচারের দাবিতে ঘুরছেন ধারে ধারে। বিচার প্রার্থণায় এরই মধ্যে চিকিৎসক স্বামীর বিরুদ্ধে ওই ছাত্রী দিয়েছেন টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, সিভিল সার্জন, নাগরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বরাবর অভিযোগপত্র। সংযুক্তিপত্রে দেয়া হয়েছে রাজশাহী জেলা নোটারী পাবলিকে এফিডেভিটের মাধ্যমে ধর্মান্তর হওয়াসহ নিকাহ রেজিস্ট্রারের নথিপত্র।
ওই ছাত্রীর স্বামী ডা. তন্ময় কুমার দেবনাথ টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মেডিকেল অফিসার পদে কর্মরত রয়েছেন। তিনি কালিহাতী পৌর শহরের ২ নং ওয়ার্ডের ঘূণী এলাকার নলনী কান্ত নাথ ও ইতি রাণী দেবনাথের ছেলে।
ভুক্তভোগী রাজশাহী জেলার বাসিন্দা ও একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ছাত্রী।
সরেজমিনও গিয়ে দেখা গেছে, ডা. তন্ময় কুমার দেবনাথ পরিচয়েই কর্মস্থলে দায়িত্ব পালন করছেন ধর্মান্তর হওয়া ওই চিকিৎসক।
তন্ময় আমার ভালোবাসার মূল্য দেয়নি আহাজারি আর এমন আক্ষেপ করছিলেন মেডিকেল কলেজের ওই ছাত্রী।
ওই ছাত্রী বলেন, ২০১৬ সালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে এমবিবিএস সম্পন্ন করেন ডা. তন্ময় কুমার দেবনাথ। সে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৫১ তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। এমবিবিএস শেষে তন্ময় রাজশাহীর একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ইনডোর এন্ড ইর্মাজেন্সি মেডিকেল অফিসার (আইএমও) পদে যোগদান করেন। এ সময় আমি ওই মেডিকেল কলেজের অর্থোপেডিক বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলাম। এরপর ওই মেডিকেলের অর্থোপেডিক বিভাগের দায়িত্ব পান ডা. তন্ময়। ওই বিভাগে যোগদানের পর সে আমাকে পছন্দ করতে শুরু করেন। এক পর্যায়ে তন্ময় আমাকে প্রেমের প্রস্তাব দেন। তবে আমরা দুইজন দুই ধর্মের অনুসারি হওয়ায় আমি সম্পর্ক স্থাপনে অসম্মতি জানাই। এরপরও তন্ময় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার সম্মতি পোষণ করাসহ আমাকে বিয়ে করবেন বলে আশ^াস দিয়ে প্রেমের সর্ম্পক স্থাপন করেন।
ছাত্রী বলেন, এরপর ২০১৮ সালের ১৯ আগস্ট রাজশাহী জেলা নোটারী পাবলিক কার্যালয়ে এফিডেভিট এর মাধ্যমে ধর্মান্তর হন ডা.তন্ময় কুমার দেবনাথ। ওই এফিডেভিটে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করাসহ পূর্বের নাম তন্ময় কুমার দেবনাথ এর স্থলে তন্ময় নাম ঘোষণা করেন সে।
এরপর ওইদিনই ইসলামী বিধি বিধান অনুস্মরণের মাধ্যমে রাজশাহী জেলার মোহনপুর থানার ৫ নং বাকশিমইল ইউপি নিকাহ্ রেজিস্ট্রার মোকাদ্দিম হোসেন (শাওন) এর কার্যালয়ে তিন লাখ টাকা দেনমোহরনায় আমরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হই।
এরপর তন্ময় ঢাকার কেরানীগঞ্জ এর জিঞ্জিরা ২০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে ৩৯তম বিসিএস ক্যাডার পদে যোগদান করেন। এ সময় তন্ময় মালঞ্চ হাসপাতালের ডরমেটরিতে থাকতেন। ওই ডরমেটরি বেশিরভাগ সময় ফাঁকা থাকায় এবং বিবাহিত স্ত্রী হওয়ায় আমার সেখানে মাঝে মধ্যেই যাতায়াত ছিল।
এরপর জানতে পারি মেডিকেলে অধ্যায়নরত অবস্থায় ২০১৩-১৪ সালে রাজশাহী জেলার পাটিয়া উপজেলার শান্তি নামের একটি মেয়ের করা নারী নির্যাতন মামলায় তন্ময় তিন রাত কারাভোগ করেছিলেন। ২০১৮ সাল পর্যন্ত ওই মামলায় সে আদালতে হাজিরা দিতে হয়েছে। পরবর্তীতে মামলায় কি হয়েছে সেটি আমি নিশ্চিত নই। এছাড়াও আমি প্রমাণ পাই, তন্ময় আরও একাধিক মেয়ের সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন।
এ নিয়ে আমাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। তন্ময়ের ভুল স্বীকার আর আমার সংসার করা ইচ্ছায় আমি সেটি মেনে নিই। এরপর আমি তন্ময়ের কাছে স্ত্রী মর্যাদা দেয়াসহ একত্রে বসবাস করার দাবি জানাই। ওই দাবির প্রেক্ষিতে তন্ময় আমাকে বলেন তোমার এমবিবিএস সম্পন্ন হওয়ার পরই পারিবারিকভাবে আমরা বিবাহের স্বীকৃতি নিব।
মেডিকেল কলেজের ওই ছাত্রী বলেন, এরপর থেকেই তন্ময় আমার সাথে দূরত্ব সৃষ্টি করতে শুরু করে। তবে আমি সম্পর্ক ধরে রাখার জন্য বারবার চেষ্টা চালিয়ে যাই। বিচ্ছেদ ঘটনাতে তন্ময় দফায় দফায় আমাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালাতে থাকে। একইভাবে নানা ধরণের চারিত্রিক অপবাদ ও প্রাণ নাশের হুমকি দিয়ে ভীত সন্তস্ত্র করে রাখতো। এরপর চলতি বছরের শুরুতেই তন্ময় আত্মগোপনে চলে যায়। হঠাৎ আমি জানতে পারি তন্ময় বর্তমানে নাগরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত রয়েছে। এ সংবাদ পেয়ে আমি নাগরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসি। প্রথমদিন তাকে পাইনি। পরবর্তীতে আবার আসি এবং তন্ময়ের সাথে দেখা হয়। সে আমাকে নানা প্রলোভন দেখিয়ে সেখান থেকে টাঙ্গাইল নতুন বাস টার্মিনাল নিয়ে আসে। বাস টার্মিনাল এলাকায় মারধর করে আমাকে জোরপূর্বক ঢাকায় পাঠিয়ে দেয়। মারধরের ঘটনাটি আমি তন্ময়ের সাথে কর্মরত নাগরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডা. রাকিবুল ইসলাম লিনকে জানাই। এরপর থেকেই তন্ময় বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটানোর জন্য চাপ প্রয়োগ আরও বৃদ্ধি করে। রীতিমত প্রচার করতে শুরু করে আমার চারিত্রিক অপবাদ। এছাড়াও মোবাইল ফোনে আমাকে নানা ধরণের হুমকি দেয়াসহ আমার পরিবারকে জানানো আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমাকে নিয়ে নানা ধরণের অপপ্রচার চালানোর কথা বলে ব্লাকমেইল চালিয়ে যাচ্ছে। তন্ময়ের এমন কর্মকান্ডে আমি চরম নিরাপত্তহীনতায় ভুগছি। আমি প্রতারক ডা. তন্ময় কুমার দেবনাথের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করছি।
ছাত্রী আরও বলেন, বিবাহিত স্ত্রী হওয়া স্বত্তেও বিয়ের চার বছরে তন্ময় কখনই আমার লেখাপড়া বা ভোরণ পোষণের কোন দায় দায়িত্ব গ্রহণ করেননি। প্রতারক তন্ময়ের ফাঁদে পরে এরই মধ্যে আমার শিক্ষাজীবনের বেশ কিছু মাস নষ্ট হয়ে গেছে। যার ফলে আমার পড়ালেখা স্থগিত রয়েছে।
এফিডেভিটে ধর্মান্তর হওয়াসহ ইসলামী রীতিতে বিয়ের কথা স্বীকার করে অভিযুক্ত ডা. তন্ময় কুমার দেবনাথ বলেন, একাধিক ছেলের সাথে সম্পর্ক থাকায় আমি ওই ছাত্রীর প্রতি বিশ^াস হারিয়ে ফেলেছি। এ কারণে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে তার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। তবে এখনও আমাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়নি। পারিবারিক ভাবে বিষয়টি সমাধান করা হবে।
ধর্মান্তর হয়েও ডা. তন্ময় কুমার দেবনাথ নাম ব্যবহারে রাষ্ট্রীয় আইনের অমান্য হচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গেছেন তিনি।
এছাড়াও বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটনোর জন্য ওই মেডিকেল ছাত্রীকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করার অভিযোগটি অসত্য বলে দাবি করেছেন তিনি। বিয়ের আগে আরও দুইজন মেয়ের সাথে সম্পর্ক থাকার কথা স্বীকার করেছেন ডা. তন্ময় কুমার দেবনাথ।
নাগরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. রোকনুজ্জামান বলেন, এফিডেভিটের মাধ্যমে ধর্মান্তর হওয়াসহ ইসলামী রীতি অনুসারে ওই ছাত্রীকে বিয়ে করেন বলে স্বীকার করেছেন ডা. তন্ময় কুমার দেবনাথ। এ বছরের শুরুতে ওই ছাত্রীর বিরুদ্ধে খারাপ কিছু অভিযোগ পায় তন্ময়। এ কারণে এখন ওই ছাত্রীর সাথে তার সম্পর্ক নেই। তবে বিষয়টি পারিবারিকভাবে মিমাংসার কথা জানিয়েছেন ডা. তন্ময়।
তিনি বলেন, এর আগে তার এক সহকর্মী ডা. রাকিবুল ইসলাম লিন এর মাধ্যমে জানতে পারেন, ওই ছাত্রী ইতোপূর্বে তন্ময়ের সাথে দেখা করতে নাগরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এসেছিলেন। সেইদিন ছাত্রী আর ডা. তন্ময়ের দেখা হয়। এরপরও তারা এক সাথে টাঙ্গাইলে যান। ওইদিন ডা. তন্ময় তাকে মারধরে করেছে বলে ডা. লিনকে ফোন করে জানিয়ে ছিলেন ওই ছাত্রী।
তিনি আরও বলেন, ছাত্রীর লিখিত অভিযোগ পেলে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের পরামর্শে যে ব্যবস্থা নেয়া যায়, অবশ্যই সে ব্যবস্থা গ্রহণের আশ^াস দিয়েছেন তিনি।
এ ব্যাপারে টাঙ্গাইলের সিভিল সার্জন ডা. আবুল ফজল মো.সাহাবুদ্দিন খান জানান, নাগরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মেডিকেল অফিসার পদে কর্মরত ডা. তন্ময় কুমার দেবনাথ এর বিরুদ্ধে মেডিকেলের এক ছাত্রী ও তার স্ত্রীর লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অভিযোগপত্রটি স্বাস্থ্য অধিদফতরে পাঠানো হয়েছে।