বছর শেষের আগে রাজধানীতে শুরু হয় বাড়িভাড়া বাড়ানোর পাঁয়তারা। নতুন বছর থেকে মালিকরা ‘ইচ্ছেমতো’ বাড়িয়ে দেন ভাড়া। এক্ষেত্রে ভাড়াটিয়ারা যেন নিরুপায়। আয়ের সিংহভাগ খরচ করে তারা এ নগরে থাকেন কেবল জীবিকার তাগিদে।
নতুন বছরে ভাড়া বেড়ে যাওয়ার চিন্তায় বাসিন্দাদের কপালে ভাঁজ পড়েছে। তারা বলছেন, সবকিছুর দাম বাড়ছে, এর সঙ্গে বাড়িভাড়া বেড়ে গেলে এ শহরে থাকাই দায় হয়ে যাবে। অন্যদিকে বাড়ির মালিকদের যুক্তি, নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার সঙ্গে ভাড়াটিয়াদের আয় বাড়ছে। সে কারণেই নতুন বছরে তারা ভাড়া বাড়াতে যাচ্ছেন।
ভোক্তাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত ২৫ বছরে রাজধানীতে বাড়িভাড়া বেড়েছে প্রায় ৪০০ শতাংশ। একই সময়ে নিত্যপণ্যের যে দাম বেড়েছে, সেই তুলনায় বাড়িভাড়া বাড়ার হার প্রায় দ্বিগুণ।
সংগঠনটির অন্য এক পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকার ২৭ শতাংশ ভাড়াটিয়া আয়ের প্রায় ৩০ শতাংশ, ৫৭ শতাংশ ভাড়াটিয়া প্রায় ৫০ শতাংশ, ১২ শতাংশ ভাড়াটিয়া আয়ের প্রায় ৭৫ শতাংশ টাকা ব্যয় করেন বাড়িভাড়া পরিশোধে।
রাজধানীর মিরপুরের কাজীপাড়া এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে একটি বাসায় পরিবার নিয়ে ভাড়া থাকেন হাসিবুর রহমান নামে একজন বেসরকারি চাকরিজীবী। তিনি বলেন, বেতনের সিংহভাগ চলে যায় বাড়িভাড়া পরিশোধে। তুলনামূলক একটু কম ভাড়ায় পাব বলে অফিস থেকে অনেক দূরে বাসা নিয়েছি। তবুও ভাড়া নিয়মিত বাড়ছে আছে। নতুন বছর সামনে রেখে বাড়ির মালিক জানিয়েছেন, করোনার জন্য এ বছর ভাড়া বাড়ানো হয়নি। এ কারণে নতুন বছরে ভাড়া আরও এক হাজার টাকা বাড়বে।
১৪ হাজার টাকা বাড়িভাড়া হলেও গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ বিলসহ প্রায় ১৭ হাজার টাকা পড়ে যায়। বেতনের টাকায় বাড়িভাড়া, সংসার খরচ, বাচ্চার খরচ চালিয়ে নিতে খুব কষ্ট হয়ে যায়। নতুন বছরে বাড়িভাড়া আরও ৫০০ টাকা বাড়ানো হবে বলে মালিক জানিয়ে দিয়েছেন। অফিস, সন্তানের স্কুল এদিকে। তাই অন্য কোথাও গিয়ে বাসা নেওয়া একটু কঠিন।
তিনি আরও বলেন, ৩৫ হাজার টাকা বেতন পাই, এর মধ্যে ১৪ হাজার টাকা বাড়িভাড়া পরিশোধে চলে যায়। বাকি টাকা দিয়ে সন্তানদের পড়ালেখা, সংসারের খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হয়। মাস শেষে ধার-দেনা নিয়মিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে যদি আবার এক হাজার টাকা ভাড়া বাড়ে, তাহলে বিপদ বাড়বে। হয়ত বাসা পরিবর্তন করে আরও ভেতরের দিকে চলে যেতে হবে, নাহলে টিকে থাকাই কঠিন হয়ে যাবে।
উত্তর বাড্ডা এলাকায় ১৪ হাজার টাকা নিট ভাড়ায় একটি বাসায় থাকেন বেসরকারি চাকরিজীবী ফরহাদ হোসেন। তিনি বলেন, ১৪ হাজার টাকা বাড়িভাড়া হলেও গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ বিলসহ প্রায় ১৭ হাজার টাকা পড়ে যায়। বেতনের টাকায় বাড়িভাড়া, সংসার খরচ, বাচ্চার খরচ চালিয়ে নিতে খুব কষ্ট হয়ে যায়। নতুন বছরে বাড়িভাড়া আরও ৫০০ টাকা বাড়ানো হবে বলে মালিক জানিয়ে দিয়েছেন। অফিস, সন্তানের স্কুল এদিকে। তাই অন্য কোথাও গিয়ে বাসা নেওয়া একটু কঠিন।
তিনি বলেন, অসহায় ভাড়াটিয়ারা প্রতিনিয়তই বাড়ির মালিকদের কাছে নির্যাতিত হয়ে আসছেন। আমাদের পক্ষ নিয়ে কেউ কাজ করছেন না। নতুন বছর এলে এভাবেই মালিকরা বাড়িভাড়া বাড়িয়ে দেন। আমরা কোণঠাসা-অসহায় হয়ে পড়ছি। মালিকরা যদি এতটা লোভী না হয়ে, কিছুটা মানবিক হলে ভাড়াটিয়ারা কোনোভাবে টিকে থাকতে পারতেন।
রাজধানীর উত্তরা এলাকার আরেক ভাড়াটিয়া আব্দুর রশিদও জানান, তিনি যে বাসায় থাকেন, সেই বাসার মালিক নতুন বছর সামনে রেখে ভাড়া আরও এক হাজার টাকা বাড়িয়ে দিচ্ছেন।
ঢাকার ২৭ শতাংশ ভাড়াটিয়া আয়ের প্রায় ৩০ শতাংশ, ৫৭ শতাংশ ভাড়াটিয়া প্রায় ৫০ শতাংশ, ১২ শতাংশ ভাড়াটিয়া আয়ের প্রায় ৭৫ শতাংশ টাকা ব্যয় করেন বাড়িভাড়া পরিশোধে।
তিনি বলেন, বলতে গেলে বেতনের সিংহভাগই বাড়িভাড়া পরিশোধে ব্যয় করতে হয়। এরপরও প্রতি বছরই বাড়ির মালিকরা নিয়মিত ভাড়া বাড়িয়ে দেন। নতুন বছর এলেই আমাদের মতো ভাড়াটিয়ারা আতঙ্কে থাকেন, এই বুঝি ভাড়া বাড়ানোর নোটিশ এল।
নতুন বছরে ভাড়া কেন বাড়ানো হচ্ছে, সেই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন রাজধানীর শেওড়াপাড়া এলাকার একটি বাড়ির মালিক নাছির আহমেদ। তিনি বলেন, যারা চাকরি করে তাদের কি প্রতিবছর বেতন বাড়ে না? আমাদের তো আয়ের উৎস বাড়িভাড়াই। ভাড়াটিয়াদের তো বেতন বাড়ে। আমরা প্রতি বছর ভাড়া বাড়ালে সমস্যা কী? করোনাকালে রাজধানীর বেশিরভাগ বাড়ির মালিকরা ভাড়া বাড়াননি। প্রায় দুই বছর ধরে অনেক বাড়িতে অনেক ফ্ল্যাট ফাঁকা ছিল। আমাদেরও তো কষ্ট হয়েছে তখন। কষ্ট করে আমরাও চলেছি।
তিনি আরও বলেন, বাজারে নিত্যপণ্যসহ প্রতিটি জিনিসের দামের ঊর্ধ্বগতি। আমাদের আয়ের উৎস যেহেতু বাড়িভাড়া, সেহেতু প্রতি বছর না বাড়ালে চলব কীভাবে? এসব কারণেই আমরা মালিকরা বছরের শুরুতে বাড়িভাড়া বাড়িয়ে দিই। অনেক মালিকই ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে সারা জীবনের আয় দিয়ে বাড়ি তৈরি করে। তাদের টিকে থাকতে হলে নতুন বছরে তো বাড়িভাড়া বাড়াতেই হবে।
৩৫ হাজার টাকা বেতন পাই, এর মধ্যে ১৪ হাজার টাকা বাড়িভাড়া পরিশোধে চলে যায়। বাকি টাকা দিয়ে সন্তানদের পড়ালেখা, সংসারের খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হয়। মাস শেষে ধার-দেনা নিয়মিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে যদি আবার এক হাজার টাকা ভাড়া বাড়ে, তাহলে বিপদ বাড়বে। হয়ত বাসা পরিবর্তন করে আরও ভেতরের দিকে চলে যেতে হবে, নাহলে টিকে থাকাই কঠিন হয়ে যাবে।
ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি মো. বাহারানে সুলতান বাহার বলেন, ঢাকাসহ সারাদেশের ভাড়াটিয়ারা আজ নিষ্পেষিত। কোনো নিয়মনীতি না মেনে বাড়ির মালিকরা যা ইচ্ছা তা-ই করছেন। রাজধানীর লাগামহীন বাড়িভাড়া রোধে প্রয়োজন আইনের সঠিক প্রয়োগ। ভাড়াটিয়াদের সমস্যা সমাধানে সিটি করপোরেশনের মনিটরিংয়ের পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে হবে।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ঢাকায় বর্তমানে আড়াই কোটিরও বেশি মানুষের বসবাস। প্রতি বছর রাজধানীতে ছয় লাখ ১২ হাজার মানুষ যুক্ত হচ্ছে। এক দিনের হিসাবে এক হাজার ৭০০ জন। পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল শহরগুলোর তালিকায় ঢাকা ১১তম। কিন্তু আয়তন ও জনসংখ্যার হিসাবে ঢাকা পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহর। এখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে ৪৩ হাজার ৫০০ মানুষ।