২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার অনন্তপুর সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নির্মমভাবে প্রাণ হারায় ১৫ বছর বয়সী কিশোরী ফেলানী খাতুন। বাবার সঙ্গে ভারতের কাটাতারের বেড়া পার হওয়ার সময় তার ঝুলন্ত মৃতদেহের ছবি সারা বিশ্বে সীমান্ত হত্যার মর্মান্তিক প্রতীক হয়ে ওঠে। ১৪ বছর পেরিয়ে গেলেও ফেলানীর পরিবার বিচার পায়নি। ন্যায়বিচারের দাবিতে আজও অপেক্ষায় বাবা-মা এবং সীমান্ত এলাকার মানুষ।
২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি ভোরে নূর ইসলাম তার মেয়ে ফেলানীকে নিয়ে বাংলাদেশ থেকে ভারতে প্রবেশের চেষ্টা করছিলেন। ঠিক তখনই ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) সদস্য অমিয় ঘোষ গুলি চালান। ঘটনাস্থলেই মারা যায় ফেলানী। গুলিবিদ্ধ হয়ে কাটাতারের বেড়ায় ঝুলে থাকা তার নিথর দেহ মানবতার প্রতি নিষ্ঠুর ব্যঙ্গের চিহ্ন হয়ে ওঠে।
ফেলানীর হত্যার বিচার শুরু হয় ২০১৩ সালে ভারতের কোচবিহারে বিএসএফের বিশেষ আদালতে। কিন্তু প্রথম বিচারে অভিযুক্ত অমিয় ঘোষকে খালাস দেওয়া হয়। ২০১৫ সালে দ্বিতীয় দফার বিচারেও একই রায় আসে। পরে ফেলানীর বাবা নূর ইসলামের পক্ষে ভারতের মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ দেশটির সুপ্রিম কোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করে। তবে ২০১৮ সালের ২৫ জানুয়ারি নির্ধারিত শুনানির পর থেকে আর কোনো অগ্রগতি হয়নি।
ফেলানীর বাবা নূর ইসলাম বলেন, “আমার মেয়ের বিচার চাইতে দুইবার আমাকে নিয়ে গেছে ওদের আদালতে। কিন্তু আজও কোনো বিচার পাইনি। শেখ হাসিনার কাছেও অনেকবার বলেছি, ভারত সরকারকেও বলেছি। কিন্তু কিছুই হয়নি।”
মা জাহানারা বেগমের কণ্ঠে অসহায় আর্তি: “আগের সরকার যদি চাইত, বিচার করতে পারত। নতুন সরকারের কাছে একটাই দাবি, অন্তত আন্তর্জাতিক আদালতে যেন বিচারটা করা হয়।”
বিচার দীর্ঘসূত্রিতার শিকার হলেও সীমান্ত হত্যা বন্ধে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে একমত আইনজীবীরা। বাদীপক্ষের আইনজীবী এস. এম. আব্রাহাম লিংকন বলেন, “ভারতের সুপ্রিম কোর্টে মামলার নিষ্পত্তি হলে শুধু ন্যায়বিচারই নয়, দুই দেশের সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।”
কুড়িগ্রামের সাধারণ মানুষও বারবার সীমান্ত হত্যার অবসানের দাবি জানিয়েছেন। তাদের মতে, ফেলানীর বিচার সম্পন্ন হলে সীমান্তে হত্যা বন্ধে এটি একটি দৃষ্টান্ত হতে পারে।
বিএসএফের গুলিতে ফেলানীর মতো বাংলাদেশি নাগরিকের মৃত্যু কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ২০০০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত হাজারো বাংলাদেশি সীমান্তে প্রাণ হারিয়েছেন। ভারত সরকার বারবার সীমান্তে “প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার না করার” প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখা যায়নি।
ফেলানীর হত্যাকাণ্ড শুধু একটি পরিবার নয়, পুরো জাতির সম্মান ও মানবাধিকারের প্রশ্ন তুলে ধরে। বিচারিক প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা ও সীমান্ত হত্যার পুনরাবৃত্তি আমাদের নীতিনির্ধারকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা।
ফেলানীর মা জাহানারা বেগম যেমনটি বলেছেন, “আমাদের মতো আর কোনো মা যেন এভাবে সন্তান হারিয়ে কাঁদতে না হয়।”
সীমান্তে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং হত্যা বন্ধে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্মিলিত উদ্যোগই পারে এ সমস্যার সমাধান আনতে। ফেলানীর বিচার শেষ হওয়া কেবল ন্যায়বিচারের বিজয় নয়, এটি হবে সীমান্ত হত্যা বন্ধের প্রথম পদক্ষেপ।