জীবনের শুরুটা খুব সহজ ছিল না। কৃষকের ঘরে জন্ম, তার আবার এতো পড়াশোনা কেন? এমনটা ভেবে গ্রামে এসএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করলেই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিতো। কারণ মেয়েদের বেশি বয়স হলে সহজে বিয়ে হতো না। আমার বাবাও এমনটা ভাবছিল যে আমি এসএসসি পাশ করলে আমাকে বিয়ে দিয়ে দিবে। এই কথাগুলো বলছিলেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবি) অর্থনীতি বিভাগ থেকে স্নাতক পাশ করা শিক্ষার্থী শিল্পী খাতুন।
শিল্পী খাতুন বাড়ি সিরাজগঞ্জের সলঙ্গা থানার দাঁতপুর গ্রামে। এসএসসিতে ভালো রেজাল্ট করেছিল বলে বগুড়ার সরকারি মুজিবুর রহমান মহিলা কলেজে ভর্তি হয়েছিল এবং এইচএসসি’তে পড়াকালীন তার বিয়ে হয়ে যায়। এরপরেও থেমে থাকেনি শিল্পী খাতুন। সংসার সামলিয়ে পড়াশোনা করেন তিনি। বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তির আগেই গর্ভবতী হন এবং স্বামীর সহায়তার বাচ্চা সংসার সামলিয়ে এখন সে স্নাতক শেষ করে স্নাতকোত্তরে পড়াশোনা করছেন।
নিজের পড়াশোনা জীবনের কথা বলতে গিয়ে শিল্পী খাতুন বলেন, যেখানে আমার বেড়ে ওঠা সেখান থেকে স্বপ্ন দেখতাম, অন্তত মাধ্যমিক পাশ করতে হবে আমাকে। যেদিন এসএসসির রেজাল্ট জানতে পারি তখন বাবা রেজাল্ট জেনে বাবা অনেক খুশি হয়েছিল। আমারও ইচ্ছে জাগে কলেজে ভর্তি হবার। কিন্তু আশেপাশে অনেকেই বলাবলি করে কলেজে পড়লে, সে মেয়েকে কেউ বিয়ে করতে চাইবে না, এমন কথা। পরে আমার জোরাজোরিতে বাবা কলেজে ভর্তি করান এবং আমার পড়াশোনাও ভালো চলছিলো। কিন্তু ২০১৫ সালে ঈদের ছুটিতে যখন আমি বাড়িতে আসি, তখন আমাকে বিয়ের কথা বলেন আমার বাবা। এরপরে তালহার আব্বুর (তালহা শিল্পী খাতুনের ছেলে) পরিবার দেখতে আসে। শুরুতে আমি রাজি ছিলাম না কথা বলতে, পরে আমার পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছেটা আমি ওনাকে জানাই। উনি আমার কথায় রাজি হন। এরপরে বিয়েতে আর কোন আপত্তি ছিল না।
শিল্পীর স্বামী সিলেটে চাকরি করতেন। সেই সূত্রে স্বামীর সঙ্গে তিনি সিলেটেই থাকতেন। কিন্তু এইচএসসির পরীক্ষার জন্য তাকে আবারও বাড়িতে যেতে হয়। এরমাঝে পরীক্ষা কেন্দ্রে যাবার পথে একদিন সে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হন তিনি। তিনি বলেন, পরীক্ষার দিনে কেন্দ্র যাওয়ার সময় একটি কারগাড়ি আমার রিকশায় পেছন থেকে ধাক্কা দেয়, রিকশা থেকে ছিটকে পড়ে আমি হাত এবং কোমরে ব্যাথা পাই। সেদিন আমি বসে পরীক্ষা দিতে পারিনি, দাঁড়িয়ে থেকে লিখতে হয়েছে আমাকে। ওই দিন আমার অ্যাকাউন্টিং বিষয়ের পরীক্ষা ছিল। ওই বিষয়ে স্কেলিং করা লাগে বেশি, হাতে আঘাত পাওয়ায় আমি খুব বেশি স্কেলিং করতে পারিনি, এতে পরীক্ষাটা খুব খারাপ হয়। যার কারণে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় এ প্লাস আসেনি। রেজাল্ট একটু খারার হওয়ায় পড়ার স্বপ্নটা অনিশ্চিত হয়ে যায়। তখন আমার স্বামীকে অনুরোধ করলাম যেন আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার অনুমতি দেয়। তিনি রাজি হন, তবে শর্ত জুড়ে দেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হলে তিনি আমাকে পড়াবেন, কিন্তু ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয় হলে তিনি পড়াবেন না।
শিল্পী বলেন, আমি পড়াশোনা শুরু করি, কিন্তু মাঝখানে সংসারের কাজ এবং শারীরিক কিছু সমস্যার কারণে খুব বেশি পড়াশোনা হতো না। এতে প্রথমবার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স হয়নি। এতে মন খারাপ হয় ঠিক, তবে কিছুদিন যাওয়ার পর আমি আবার পড়াশোনা শুরু করি। দিনের বেলা সংসারের অনেক কাজ থাকতো, তাই আমি রাতের বেলা পড়ার চেষ্টা করতাম। আলহামদুলিল্লাহ, আমি শাবিপ্রবিতে চান্স পাই। এদিকে এতোদিনে আমি আমি অন্তঃসত্ত্বা হই। আমার বিষয়টি কেউ যেন বুঝতে না পারে, সেজন্য আমি অনেকগুলো কাপড় গায়ে দিয়ে আসি। এভাবে চলছিলো আমার ক্যাম্পাস জীবন।
শিল্পী খাতুন আরও বলেন, আমার বাসা তিনতলায় এবং ক্লাসরুম চারতলায় হওয়ায় আমাকে উপরে ওঠা-নামা করতে হতো। এতে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ডাক্তার আমাকে বেড রেস্টে থাকতে বলে। কিন্তু এরমাঝে আসে প্রথম সেমিস্টার পরীক্ষা। তখন আমি স্যারকে বলি, আমার এই শারীরিক অবস্থায় পরীক্ষা দেওয়া কঠিন এবং আমার অনুরোধে স্যাররা আমাদের পরীক্ষা পিছিয়ে দেন।
তিনি বলেন, আমি যখন পরীক্ষায় বসি তখন আমার সন্তান তালহার বয়স ৩৬ দিন। সেসময় আমি পরীক্ষা দিতাম, আর আমার শাশুড়ি তালহাকে নিয়ে কমন রুমে বসে থাকতেন। ছেলেটা কান্না করতো, আর আমি একটু পরপর গিয়ে ওকে দেখে আসি। এই সময়গুলোতে স্যাররা অনেক সাহায্য করেছেন। একদিন পরীক্ষার সময় তালহা এতো কান্না করছিল, যে কান্না শুনে স্যার আমাকে বলেছিল, ‘তোমাকে অতিরিক্ত সময় দিব, তুমি বাচ্চাকে দেখে আসো।’ পরে স্যার আমাকে অতিরিক্ত সময় দিয়েছিলেন। এছাড়াও প্রায়ই টার্মটেস্ট গুলোতে এমন হয়েছে, এক ঘন্টার পরীক্ষা আমি ২০ মিনিটে দিয়ে চলে এসেছি। আর এসে দেখতাম তালহা কান্না করতে করতে দূর্বল হয়ে গেছে।
শিল্পী বলেন, এভাবেই দিনগুলো পার হচ্ছিল আমার। কিন্তু ২০১৮ সালে আমার হাসবেন্ড সিরাজগঞ্জে ট্রান্সফার হয়ে গেলে আমার কষ্ট আরো বাড়তে থাকে। তখন আমার বিভাগের শিক্ষক জহির স্যারের কাছে গিয়ে উনাকে অনুরোধ করি, যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডে-কেয়ার সেন্টারে আমার বাচ্চাকে রাখার অনুমতি দেন, পরে তিনি সেই ব্যবস্থা করে দেন। আমার বাচ্চাও অন্য বাচ্চাদের সাথে আস্তে আস্তে বেড়ে উঠে। এখন তার বয়স ৪ বছর ১১মাস। ডে-কেয়ার সেন্টারে অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে সে এতোটাই মিশে গেছে যে, বিশ্ববিদ্যালয় যেদিন বন্ধ থাকে সেদিনও ডে-কেয়ার সেন্টারে যাওয়ার জন্য প্রায়ই কান্না করে। বর্তমানে আমার স্নাতক শেষ। আমার বন্ধুরা আমাকে প্রচুর সাহায্য করতো। বন্ধুদের ছাড়া আমার পক্ষে স্নাতক শেষ করা আমার পক্ষে সম্ভব হতো না। আমার এতটুকু আসার পিছনে আমার স্বামীর পর আমার শিক্ষক এবং আমার বন্ধুদের অবদান অনস্বীকার্য।