মাদারীপুর প্রতিনিধি :
মাদারীপুরে নদীতে অবৈধভাবে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে লাখ লাখ ফুট বালু উত্তোলন করছে প্রভাবশালী একটি চক্র। কোনোরকম সরকারি ইজারা ছাড়াই প্রকৃতি ও পরিবেশের ক্ষতি করে কয়েক মাস ধরে চলছে বালু তোলার মহোৎসব। মাদারীপুর, কালকিনি, রাজৈর, ডাসার ও শিবচর উপজেলায় আড়িয়াল খাঁ ও পদ্মা নদী থেকে ড্রেজার মেশিনের মাধ্যমে প্রতিদিন ভোর থেকে রাত পর্যন্ত বালু তোলা হয়।
অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে তারা অবৈধভাবে কাজটি করে যাচ্ছেন।
এতে পানির প্রবাহে গতি পরিবর্তন হওয়ায় নদীর পাড় ভেঙে এলাকার ফসলি জমিসহ বাড়ি-ঘর নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার পথে। তবে বালু উত্তোলনকারীরা প্রভাবশালী হওয়ায় ভয়ে কেউ কিছু বলতে সাহস পাচ্ছেন না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, কালকিনি উপজেলার আলিনগর ইউনিয়নের সস্তাল গ্রামের আড়িয়াল খাঁ নদী থেকে দীর্ঘদিন ধরে নিয়মিত বালু তোলা হয়। এদিকে মাদারীপুর সদর উপজেলা ঝাউদি ইউনিয়ন চর হোগলপাতিয়া গ্রামে আড়িয়াল খাঁ নদী থেকে তৈয়ব হাওলাদারের নেতৃত্বে মানিক হাওলাদারের অবৈধ ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করেন। ফলে এর প্রভাব পড়ছে উপজেলার ১০ থেকে ১৫টি গ্রামের ওপর। এদিকে অবৈধ ড্রেজার দিয়ে বালি কাটার ফলে ঘরবাড়ি স্কুল, মসজিদ ভেঙে গেছে। ফলে এখন নদীর পারের বসবাসকারীরা আতঙ্কের মধ্যে দিন পার করছে। শিবচর উপজেলায় আড়িয়াল খাঁ নদী ও পদ্মা নদ এবং কুমার নদের বিভিন্নস্থান থেকে বালু উত্তোলনের জন্য ড্রেজার মেশিন বসান বলে জানা গেছে। এদের সঙ্গে যুক্ত বাল্কহেড। তারপর শুরু হয় বালু কাটা মহাউৎসব রাতে থেকে শুরু করে ভোর অবধি চলে বালু কাটা। এতে বিলীন হচ্ছে নদীর পারে ফসলি জমি ও বসতবাড়ি।
অভিযোগ উঠেছে, এ বালু উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত খাসেরহাট এলাকার শামিম হোসেন, জুয়েল হাসান, মাহাবুব রহমান, পলাশ,আশিক, দিলিপ বাড়ৈ, ওসমান, মোয়াজ্জেম আলী আকবর মোল্লা ও তৈয়ব হাওলাদারসহ বেশ কয়েকজন। এদিকে তারা স্থানীয় প্রভাবশালী হওয়ায় কেউ তাদের ভয়ে কিছু বলতে সাহস পাচ্ছে না। যদিও বালু উত্তোলনের জন্য তাদের কাছে কোনো অনুমতি নেই। এতে সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নদীর মাঝখানে ও কূল ঘেঁষে কয়েকটি ড্রেজার মেশিন বসানো। এর প্রতিটি মেশিনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে কয়েককটি বাল্কহেড। প্রতিটি বোটে ১০/১২ জন লোকের পাহারা। বেলা ৮টার দিকে দেখা গেল সস্তাল এলাকার আড়িয়াল নদীর কূল ঘেঁষে তিন ড্রেজার মেশিনের মাধ্যমে তোলা হচ্ছে বালু। সেই বালু বাল্ডহেডের মাধ্যমে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এ সময় সংবাদকর্মীদের উপস্থিতি দেখে তারা নড়েচড়ে বসে। ছবি তুললে তাদের অনেককেই ক্ষুব্ধ হয়ে সাংবাদিকদের পিছু নিয়ে ধাওয়া করতে থাকে। তারা তাদের স্পিডবোট দিয়ে সাংবাদিকদের স্পিডবোটকে ধাক্কা দেওয়ার চেষ্টা করে। পরক্ষণেই প্রভাবশালী মহলটি সাময়িক সময়ের জন্য বালু উত্তোলনের ড্রেজার মেশিনগুলো বন্ধ করে দেয়।
উপজেলার কয়েকটি গ্রামের একাধিক গ্রামবাসী বালু উত্তোলনের কারণে দুর্দশার কথা জানিয়ে বলেন, এই অবৈধ বালু উত্তোলন আমাদের সর্বস্বান্ত করে ছাড়বে। আমাদের গ্রাম নদী গ্রাস করে নিচ্ছে।
স্হানীয় বাসিন্দারা রাজিব মন্ডল, রবি মন্ডল, আলিম আকন, সিরাজুল হাওলাদার, মকসেদ আকন, ইলিয়াস আকন, লালমিয়া হাওলাদার, সুমন মন্ডল, নিখিল বাড়ৈ, সেমল মন্ডল, নিজাম মিয়াসহ বেশ কয়েকজন বলেন, আমাদের তিন কানি জমি ছিল। এর মধ্যে দুই কানি জমির মাটি ভেঙে নদীতে চলে গেছে। আমাদের ছাড়াও অন্যান্য মানুষের ফসলি জমিও চলে গেছে। সরকার যদি আমাদের সহযোগিতা করে তাহলে আমাদের জীবনটা বাঁচব।
চর হোগলপাতিয়া গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দা কাজী ইলিয়াস আকন বলেন, নদীটা অনেক দূরে ছিল। আমরা নদীর অনেক দূরে গিয়ে গবাদি পশু গোসল করতাম। ড্রেজারে বালু তোলার ফলে ধীরে ধীরে নদী ভাঙন শুরু হয়েছে। প্রায় আধা মাইল পর্যন্ত চলে এসেছে। এখন হুমকির মুখে আমাদের কয়েকটি গ্রাম রয়েছে।
মাহফুজ নামে এক ব্যক্তি বলেন, প্রতিদিন একটু একটু করে পাড় ভেঙে চলছে। মূলত অবাধে বালু তোলার কারণে সব সময় আতঙ্কে থাকি। কখন জানে আমাদের ভবন পানিতে চলে যায়। প্রভাবশালী চক্রটি প্রশাসনকে ম্যানেজ করে অবাধে বালু উত্তোলন করছে।
নদীর কবলে ৮ বার বসতভিটা বিলীন হওয়া হোসেনাবাদ গ্রামের আরেক কৃষক সিরাজুল মাতুব্বর জানান, প্রতিবছর নদী ভাঙলেও এবার নদী ভাঙনের ভয়াবহ তীব্রতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রতিদিনই নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে ফসলি জমি ও বিস্তীর্ণ এলাকা। স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে অবাধে বালু উত্তোলন করছে ওই চক্রটি। তাদের ভয়ে অনেকে মুখ খুলে কিছু বলতে পারছে না। এ বিষয়ে প্রশাসনকে জানিয়েও কোনো প্রতিকার পাইনি।
৬০ বছরের বৃদ্ধা রোকেয়া বেগম আক্ষেপ নিয়ে বলেন, বালি কাটার কারণে নদীর পারে আমার বাবা-মায়ের কবর ছিল সেই কবরও ভেঙে গেছে নদী ভাঙ্গার কারণে। বাধা দিতে গেলে আমাদের মারতে আসে আমরা এখন কোথায় যাব আমরা তো তাদের সাথে পারতেছি না তারা অনেক ক্ষমতাশালী লোক। এই বালি কাটার কারণে আমাদের ঘর কয়েকবার ভাঙছে। এখন পরের জমিতে ঘর তুলে থাকি যাওয়ার আর কোনো জায়গা নেই। যা জমিজমা ছিল সেগুলো নদীর ভেতরে চলে গেছে। এখন যদি সরকার আমাদের দিকে একটু তাকায়।
কালিকাপুর ইউনিয়ন ২নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আবদুল সাত্তার ফকির বলেন, আমরা নদীভাঙন এলাকার লোক।ড্রেজার দিয়ে অবৈধভাবে বালু কাটার কারণে আমাদের বসতঘর দুইবার নদীতে ভেঙেছে। যারা বালি কাটে তাদের অনেক ক্ষমতা। আমরা তাদের ভয়ে কিছু বলতে পারি না।
এ ব্যাপারে অভিযুক্ত বালু উত্তোলনকারী ফারুক সরদার, মজিবর খা, শফিক মাতুব্বর দেলোয়ার মুন্সিরা বলেন এখন আর বালু উত্তোলন করা হয় না।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আলী আকবর মোল্লা বলেন, আপনারা নিউজ করলে কোন সমস্যা হবে না। সকলকে নিয়েই আমরা এই কাজ করি। এদিকে আরেক অভিযুক্ত মানিক হাওলাদার বলেন, ওই নদীতে আমার কোন ড্রেজার চলে না।
আলীনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহিদ পারভেজ বলেন, যারা নদী থেকে অবৈধভাবে বালি উত্তোলন করে মানুষের ঘরবাড়ি বিলীন ফসলের জন্য নষ্ট করতেছে তাদের ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রশাসনের জোড় দাবি জানাচ্ছি।
ঝাউদি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম আবুল হাওলাদার বলেন, অবৈধ ড্রেজার দিয়ে বালু তোলা হচ্ছে। এতে নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে। এভাবে অপরিকল্পিতভাবে বালু তোলা হলে গ্রামের পর গ্রাম বিলীন হয়ে যাবে। আমি বিষয়টি প্রশাসনকে অবগত করেছিলাম।
কালকিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পিংকি সাহা বলেন, যারা এই অবৈধ বালি উত্তোলনের সাথে জড়িত তাদেরকে অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে। যারা এইভাবে আমাদের নাম ভাঙিয়ে বালু উত্তোলন সুবিধা নিতে চায় তাদের ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেব। অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা একেবারেই নিষিদ্ধ।
মাদারীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মাইনুদ্দিন বলেন, ‘নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা সম্পূর্ণভাবে নিষেধ। মন্ত্রণালয় থেকেও এই বিষয়ে আমাদের চিঠি দিয়েছে। বালু উত্তোলনকারীরা আসলে আমাদের কথা বলে সুবিধা নিতে চায়। যারা বালু উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মাদারীপুর জেলা প্রশাসক মারুফুর রশিদ খান বলেন, যারা অবৈধভাবে বালি উত্তোলন করে তাদের ব্যাপারে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।