ঢাকা, বৃহস্পতিবার ৯ মে ২০২৪, ২৬শে বৈশাখ ১৪৩১

বিবর্তনের রাজনীতি

সরওয়ার আহমদ | প্রকাশের সময় : মঙ্গলবার ৭ নভেম্বর ২০২৩ ০১:২৫:০০ অপরাহ্ন | সিলেট প্রতিদিন

কিংবদন্তি আছে-সময়ের একফোঁড়,অসময়ের দশ ফোঁড়। ব্যক্তি সমাজ এমনকি রাস্ট্রের ক্ষেত্রেও প্রবচনটি সমানভাবে প্রযোজ্য। সময় তার গতি পরিবর্তনের ধারায় আমীরকে ফকীর, ফকীরকে আমীর, অস্পৃশ্যকে বরণীয় এবং মান্যবরকে ঘৃণিত অভিধায় ভূষিত করতে পারে। ইতিহাস হাতড়ালে এমন নজির পাওয়া যাবে অনেক। একই অবস্থান যে সবসময় অটল থাকবে এমনটি ভাবারও কারণ নেই। সময়ানুপাতে অবস্থানেরও হেরফের ধরে। তবে রাজনীতির ক্ষেত্রে এ সত্যটি অনেকেই মেনে নিতে নারাজ। অনুকূল বাতাসে একটি দল কিভাবে বেড়ে উঠতে পারে এবং প্রতিকূলতায় কিভাবে নেতিয়ে পড়ে তার উদাহরণ হতে পারে বি এন পি।

১৯৭৫ সনের পটপরিবর্তনের পর রাজনৈতিক অংগনে যখন শূন্যতা নেমে এসেছিলো, সেই শূন্যতা  পূরণ করেছিল বিএনপি।প্রথমে জাগদল, অতঃপর জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট এবং সবশেষে বিএনপিতে রূপান্তর। প্রেসিডেন্ট জিয়ার পৃষ্ঠপোষকতায় এবং জাস্টিস সাত্তারের নেতৃত্বে গঠিত জাগদল তেমন ভিত রচনা করতে না পারায় ৭৮ সনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকালে বিভিন্ন দলের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট। এই ফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে জিয়া প্রেসিডেন্ট পদে বিজয়ী হয়েছিলেন। তারপর মন্ত্রী পরিষদে বিভিন্ন দলের নেতাদেরকে টেনে আনার কৌশল নেন। পরবর্তিতে ৭৯ সনের সংসদ নির্বাচনের আগে ফ্রন্টকে গুলিয়ে একক দল হিসাবে গঠন করেছিলেন বিএনপি। মুসলিম লীগের ৭০% নেতাকর্মী বিএনপিকে তাদের আসল জায়গা মনে করে ছুটে এসেছিল। মাওলানা ভাসানীর মৃত্যুর পর পিকিংপন্তী ন্যাপ যাদু মিয়ার নেতৃত্বে বিএনপিতে এসে লয় হয়েছিল। অন্যান্য ছোট দল ছাড়াও দলছুট নেতারাও বিএনপির ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছিল। এমতাবস্থায় রাষ্ট্র প্রধানের পাশাপাশি একটি বড় দলেরও প্রধান হতে পেরেছিলেন জিয়াউর রহমান। স্তাবকতার আতিশয্যে শাহ আজিজুর রহমান জিয়াকে কামালআর্তাতুর্ক এবং মারশাল টিটুর সাথে তুলনা করেছিলেন। এক কালের ন্যাপ নেতা মানিকগঞ্জের আব্দুল হালিম চৌধুরী জিয়াকে জিন্নাহর সাথে তুলনা করে বলেছিলেন, আমার নিকট জিন্নাহ এবং জিয়ার দর্শনটাই বড় মনে হচ্ছে। জিয়ার মৃত্যুর পর তার কথিত সমাধিতে দৈনিক একট্রাকেরও অধিক ফুল জমা হতো। সরকারি নির্দেশ পালন করত গিয়ে অফিস কর্মচারীরা ফুল না পেয়ে গাছের ছোট ডাল নিয়েও সমাধিস্থলে হাজির হতো।

রাজনৈতিক ম্যাকানিজমেট ফলশ্রæতিতে এবং যৌথ আন্দোলনের ফসল এককভাবে ঘরে তুলতে পারায় বেগম খালেদা জিয়াও কি কম পেয়েছেন? দুইবারের প্রধান মন্ত্রী ছাড়াও আপসহীন নেত্রী,দেশনেত্রী, গণতন্ত্রের মানসকন্যা, বাংলার কোরাজানসহ বিভিন্ন অভিধায় ভূষিত হয়েছেন। আর মিডিয়াতো সর্বস্ব  উজাড় করে দিয়েছিল। এরশাদ শাসনামলে সরকার নিয়ন্ত্রিত সাপ্তাহিক বিচিত্রা বেগম জিয়াকে নিয়ে কভারস্টরি ছেপে আলোড়ন তুলেছিলো। খালেদা জিয়া আম উচ্চারণ করলে মিডিয়া সেটিকে কমলা বানিয়ে ফেলতো। ৯১ এর নির্বাচনকালে বগুড়ার বিভিন্ন জনসভা শেষে নিজ শশুর বাড়িতে যাবার কথাছিলো বেগম জিয়ার। সেখানে পৌঁছতে পৌঁছতে গভীর রাত হয়ে যায়। ইত্তেফাকের নাজিম উদ্দিন মোস্তান সহ তার অনুসারীরা নির্ঘুম রজনী যাপন করে একদিনের বাসি রিপোর্টকে তরতাজা পরিবেশন করেছিলেন। যাইহোক জিয়াউর রহমান ও বেগম খালেদা জিয়া নিজেদের চাওয়ার চাইতেও বেশী পেয়েছেন। এটাকেই বলে প্রকৃতির আনুকূল্য। অনুকূল পরিবেশে সবকিছুর বারবাড়ন্ত থাকে। কিন্তু অনুকূলের বিপরীতে প্রতিকূল, গড়ার বিপরীতে ভাংগার ধারাবাহিকতাও আছে।

যেভাবে এবং যেমন করেই হোক গত ২০০৭ থেকে বিএনপির ললাটে প্রতিকূলতা বা বৈরীপণা ভর করেছে। বৈরী বাতাসে জড়ো হওয়া বসন্তের কোকিলরা নিরুদ্দেশ বা কন্টরুদ্ধ। জন্মকালে যে সমস্ত ডাকসাইটে নেতা ছিলেন তাদের বড় অংশ গতায়ু হয়েছেন। কেউ কেউ দল ছেড়েছেন।

মধ্যমাপের নেতাদের কেউ কেউ নিষ্ক্রিয়। আবার অনেকে কোনঠাসা। মামলার ধকলে কেউ কেউ নাজেহাল। স্থানীয় এবং জাতীয়ভাবে নির্বাচন বর্জনের অর্জন হচ্ছে দলছুটদের তালিকা বৃদ্ধি। এক কথায় নব্বুই দশকের বিএনপি এবং এখনকার বিএনপির মধ্যে ব্যবধান এন্তার। বড় কথা হচছে বিএনপির আইকন বেগম খালেদা জিয়ার নাজুক অবস্থা। এমতাবস্থায় দলের দায়িত্ব বর্তেছে তারেক জিয়ার উপর। আগে বিএনপি চলতো কালেকটিভ উইজডমে। এখন দল চলছে একক নির্দেশে। নির্বাসনে থাকা তারেক জিয়াতো আয়াতুল্লাহ খোমেনী বা হো চি মিন কিংবা কারান্তরালে থাকা নেলসন মান্ডেলা নন যে তার কথায় জাতি উঠবস করবে। হাতের ইশারায় অসাধ্য সাধন করবে?  অসাড়ের তর্জনগর্জন দেখে এ প্রশ্ন উঠাই সংগত।

আন্দোলন হচছে গণতান্ত্রিক অধিকারের অংশ। এ আন্দোলন হচ্ছে নিয়ম তন্ত্রের ধারক। মারপিট সন্ত্রাস ভাংচুর এবং আগুনের খেলার নাম কি গণতন্ত্র ও আন্দোলন? গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অংগীকারাবদ্ধ বিএনপিকে ঘিরে কৌতুহলী মহলে এ প্রশ্ন ঘুরপাক খাচছে।

রাজনীতির উজান ভাটি আছে। আওয়ামী লীগেও এ  উজান ভাটি ছিল। এমন এক সময় ছিল যে আওয়ামী লীগাররা নিজের পরিচয় দিতে ভয় পেতো। রাজনৈতিক অমানিশা দলটিকে এমনভাবে ঘিরে ধরেছিল যে দলীয় অস্তিত্ব বিপন্ন হবার উপক্রম হয়ে উঠেছিল। কিন্তু সেই আওয়ামী লীগও ঘুরে দাড়িয়ে যথাস্থানে পৌছতে পেরেছে। বিএনপি শুধু আওয়ামী বিরোধী নয় বিদ্বেষীও। কিন্তু ঘুওে দাড়ানোর বেলায়  আওয়ামী লীগকে অনুসরণ করতে পারে। বাস্তবতা বলছে -আগে অস্তিত্ব তারপর লাফ ঝাপ।


লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট