মর্যাদা শব্দটি বিশেষ্য পদ। এর সমার্থক শব্দ হলো- সম্মান, খাতির, সম্ভ্রম, গৌরব (বংশমর্যাদা), নিয়ম, সদাচার, শালীনতা, দক্ষিণা, পণ, সেলামী, নজরানা (নবাবের মর্যাদা) ইত্যাদি। মর্যাদা, সম্মান বা খাতির যাই হোক না কেন। এটা নিজেকেই রক্ষা করতে হয়। অর্থাৎ কেউ অন্যকে সম্মান বা খাতির করলে, অন্যরাও তাকে সম্মান বা খাতির করবে। এটাই চিরায়িত নিয়ম।
জামালপুর সদর উপজেলার রশিদপুর ইউনিয়নের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তুলসীপুর উচ্চ বিদ্যালয়। এ প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক আসাদুজ্জামান (চান বিএসসি)। ওই বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সচিবও তিনি। কয়েক বছর আগে এসএসসি পরীক্ষার কেন্দ্রও হয়েছে এখানে। কেন্দ্র কোড- ২০৫। প্রধান শিক্ষক এ কেন্দ্র পরিচালনা কমিটির সচিব। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি দুপুর ২ টা ৫০ মিনিটে কেন্দ্রের তথ্য জানার জন্য কথা হয়। কেন্দ্রে কত জন পরীক্ষার্থী পরীক্ষা দিচ্ছে তা জানতে চাইলে- তিনি উত্তরে বলেন, কেন্দ্রের বাইরে আছেন। তাই কাগজপত্র না দেখে বলতে পারবেন না। অংশগ্রহণকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৯টি বলে জানান। সহকারী সচিব, হল সুপার, সহকারী হলসুপার ও ট্যাগ অফিসার বিষয়ে তিনি জানেন না। এ বিষয়ে উপজেলা থেকে জানার জন্য পরামর্শ দেন। তারপর একই দিন রাত ৭ টা ২০ মিনিটে সহকারী কেন্দ্র সচিব কৈডোলা-জাফরশাহী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছাইদুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করলে, তিনি এ কেন্দ্রের সহকারী সচিব। এছাড়া পাকুল্যা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফজলুল হক হল সুপার আর তুলসীপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক কোহিনুর আক্তার সহকারী হল সুপার বলে জানান। তবে মোট পরীক্ষার্থী কত ও ট্যাগ অফিসার কে তা তিনি জানেন না। ১৬ ফেব্রুয়ারি, রাত ৮ টা ১৮ মিনিটে হল সুপার ফজলুল হক এর সাথে যোগাযোগ করলে, তিনি জানান মোট পরীক্ষার্থী ৬শ’ এর উপরে হবে। ট্যাগ অফিসার হিসেবে সদর সমাজসেবার এক মহিলার কথা শুনেছি। পরে অন্য কেন্দ্রের এক ট্যাগ অফিসারের মাধ্যমে জানা যায়, তুলসীপুর উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের ট্যাগ অফিসার হিসেবে দায়িত্বে আছেন সদর সেবা কর্মকর্তা শাহাদাৎ হোসেন। এ বিষয়ে ১৯ ফেব্রুয়ারি তার সাথে কথা বলে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, ২২ ফেব্রুয়ারি ওই কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে কেন্দ্র সচিব আসাদুজ্জামান (চান বিএসসি) কে ওই দিনের ইংরেজি ২য় পত্র (১০৮) বিষয়ের তথ্য চাইলে, তিনি সোজা-সাপ্টা বলেন ওপাশে কক্ষে সহকারী কেন্দ্র সচিব ও হল সুপার আছে তাদের কাছ থেকে তথ্য নিন। ওপাশের কক্ষে গিয়ে তাদের পাওয়া যায় নি। পরে তিনি অফিস সহায়ক তাকওয়া তানভীরকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতে বলায়- তিনি জানান, মোট পরীক্ষার্থী ৬০২ জন। উপস্থিত ৬০১ জন এবং অনুপস্থিত ১ জন (ছাত্রী) কারণ ২৯২ জন ছাত্র সবাই উপস্থিত আর ৩১০ জন ছাত্রীর মধ্যে ৩০৯ জন উপস্থিত রয়েছে। অপরদিকে, ওই ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান হলেন- খন্দকার ফজলুল হক। গত ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝিতে তার ইউনিয়নের শংকরপুরে স্থানীয়দের বিরুদ্ধে (বংশাই নদী খনন করে পাড়ে রাখা) মাটি বিক্রির অভিযোগ ওঠছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে, তিনি সাফ জবাব দেন- ‘এটা তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না।’ আবার গত অক্টোবর মাসের ২৫ তারিখ বিকেলে জামালপুর সদর উপজেলার মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান (সংরক্ষিত) ফারজানা ইয়াসমিন লিটাকে তার ঠিকাদারীতে চলমান দিগপাইত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ওয়াশ ব্লক নির্মাণ কাজের বরাদ্দ কত তা জানতে চাইলে- তিনি সাফ জানান, বরাদ্দ ধরা নেই। এটা কেমন কথা বললেন? এমন প্রশ্নের জবাবে- কাগজপত্রে কোথাও লেখা নেই বলে জানান।
বাংলা প্রবাদে আছে- ‘তুই দিলে মুই দিই।’ আবার নেতাজী সুভাস চন্দ্র বলেছেন- ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা এনে দিব।’ এছাড়া নেপোলিয়ান-এর বিখ্যাত উক্তি- ‘তোমরা আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের উন্নত জাতি উপহার দেব।’ এসব কথায় একটা বিষয় স্পষ্ট যে, ‘কিছু পেতে হলে কিছু দিতেও হয়।’
কবি হরিশচন্দ্র হয়তো বা এজন্যই তার ‘বড় কে?’ কবিতায় উল্লেখ করেছেন- “গুণেতে হইলে বড়, বড় বলে সবে।” অপরদিকে, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তার ‘তৈল’ প্রবন্ধে লিখেছেন- তৈল যে কি পদার্থ, তাহা সংস্কৃত কবিরা কতক বুঝিয়াছিলেন। তাঁহাদের মতে তৈলের অপর নাম স্নেহ। বাস্তবিকই স্নেহ ও তৈল একই পদার্থ। আমি তোমায় স্নেহ করি, তুমি আমায় স্নেহ কর অর্থাৎ আমরা পরস্পরকে তৈল দিয়া থাকি । স্নেহ কি? যাহা স্নিগ্ধ বা ঠান্ডা করে , তাহার নাম স্নেহ । তৈলের ন্যায় ঠাণ্ডা করিতে আর কিসে পারে ? সংস্কৃত কবিরা ঠিকই বুঝিয়াছিলেন। যেহেতু তাহারা সকল মনুষ্যকেই সমানরূপে স্নেহ করিতে বা তৈল প্রদান করিতে উপদেশ দিয়াছেন। বাস্তবিকই তৈল সর্বশক্তিমান; যাহা বলের অসাধ্য, যাহা বিদ্যার অসাধ্য , যাহা ধনের অসাধ্য, যাহা কৌশলের অসাধ্য,তাহা কেবল একমাত্র তৈল দ্ধারা সিদ্ধ হইতে পারে।
তৈল প্রয়োগের উত্তম কৌশলও রয়েছে- পূর্বেই উল্লেখ করা গিয়েছে, যেরূপেই হউক, তৈল দিলে কিছু না কিছু উপকার হইবে। যেহেতু তৈল নষ্ট হয় না, তথাপি দিবার কৌশল আছে। তাহার প্রমাণ ভট্টাচার্যেরা সমস্ত দিন বকিয়াও যাহার নিকট পাঁচ সিকা বৈ আদায় করিতে পারিল না, একজন ইংরেজিওয়ালা তাহার নিকট অনায়াসে ৫০ টাকা বাহির করিয়া লইয়া গেল। কৌশল করিয়া এক বিন্দু দিলে যত কাজ হয়, বিনা কৌশলে কলস কলস ঢালিলেও তত হয় না।
কবি কাজী কাদের নেওয়াজ তার বিখ্যাত ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ কবিতায় উল্লেখ করেছেন- ‘যায় যাবে প্রাণ তাহে/প্রাণের চেয়েও মান বড়/আমি বোঝাব শাহানশাহে।’ কবি এখানে শিক্ষক যে সবার উর্ধ্বে সে কথাই বুঝিয়েছেন। তাই শিক্ষকগণ সকল পরিস্থিতিতেই তাদের মর্যাদা অক্ষুণ্ন ও সমুন্নত রাখবেন। পাশাপাশি সকলকেই তার নিজের মর্যাদা রক্ষা করতে হবে। পরিশেষে, কবি জসীম উদ্দীনের ‘প্রতিদান’ কবিতার কথা ধরেই শেষ করছি- ‘কত ঠাঁই হতে কত কী যে আনি সাজাই নিরন্তর/আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।’
কামরুল হাসান:
(লেখক: সাংবাদিক ও ডিরেক্টর- বাংলাদেশ সেন্ট্রাল প্রেস ক্লাব, ঢাকা এবং সাবেক শিক্ষক ও এনজিও কর্মকর্তা।)