পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বাস্তুতন্ত্রের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মিঠা পানির বাস্তুতন্ত্র। তবে মিঠা পানির প্রাণীরা বর্তমানে সবচেয়ে বিপন্নও বটে। বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে প্রায় ২৪ শতাংশ মিঠা পানির প্রজাতি– এমনই উঠে এসেছে বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নাল ‘নেচার’-এ প্রকাশিত নতুন এক গবেষণায়। সূত্র: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর
জরুরি পদক্ষেপ না নিলে আগামী কয়েক দশকে মাছ, কাঁকড়া থেকে শুরু করে গঙ্গা-ফড়িং, শামুকসহ হাজার হাজার মিঠা পানির প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন গবেষকরা।
প্রায় ২৪ হাজার মিঠা পানির প্রজাতির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রায় এক হাজার প্রজাতি মারাত্মকভাবে বিপন্ন। যার মধ্যে প্রায় দুইশো প্রজাতি সম্ভবত এরইমধ্যে বিলুপ্তও হয়ে গেছে।
“মিঠা পানির জীববৈচিত্র্য রক্ষার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এসব বাস্তুতন্ত্র প্রকৃতি ও মানুষ উভয়ের জন্যই অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তাই এদের সুরক্ষার জন্য আমাদের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার,” বলেছেন এ গবেষণার প্রধান লেখক ক্যাথরিন সায়ার।
পানি, খাবার ও সম্পদের জন্য মানুষের চাহিদা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নদী, হ্রদ ও জলাভূমির মতো মিঠা পানির পরিবেশ চাপের মুখে পড়েছে বলে প্রতিবেদনে লিখেছে বিজ্ঞানভিত্তিক সাইট নোরিজ।
সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে ম্যানগ্রোভ ও লবণাক্ত জলাভূমির মতো জলাভূমি, যেখানে ১৭০০ সাল থেকে ভারতের সমান আয়তনের প্রায় ৩৪ কোটি বর্গকিলোমিটার এলাকা হারিয়ে গেছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, এ ক্ষতি কেবল প্রাণী প্রজাতিরই ক্ষতি করছে না, বরং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই ও বন্যা ঠেকাতে আমাদের ক্ষমতাকেও দুর্বল করে দিচ্ছে।
পানি উত্তোলন ও বাঁধের কারণে বিভিন্ন নদীও আকারে ছোট হয়ে আসছে। কলোরাডো নদীর মতো কিছু নদী আর সমুদ্রে প্রবাহিত হয় না। আর যা-ও অবশিষ্ট রয়েছে তা বেশিরভাগই পয়ঃনিষ্কাশন, শিল্প বর্জ্য ও প্লাস্টিকের মাধ্যমে দূষিত হচ্ছে।
কীটনাশক’সহ কৃষিজমি থেকে আসা পানি মিঠা পানির প্রাণী প্রজাতির জন্য বিশেষভাবে ক্ষতিকর। এসব চ্যালেঞ্জের পরেও মহাসাগরের তুলনায় কম গবেষণা হয় মিঠা পানির বিভিন্ন বাস্তুতন্ত্র নিয়ে। ফলে অনেক প্রজাতি প্রয়োজনীয় সহায়তা ছাড়াই টিকে আছে।
প্রাণী সংরক্ষণ পরিকল্পনায় মিঠা পানির প্রজাতি যোগ করার গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছেন এ গবেষণার সহ-লেখক ড. টপিল্টজিন কনট্রেরাস ম্যাকবিথ। তিনি বলেছেন, “বন্যপ্রাণী ও মানুষ উভয়ের সুস্থ থাকার জন্যই এসব বাস্তুতন্ত্র পর্যবেক্ষণ ও সুরক্ষায় আমাদের আরও বিনিয়োগের প্রয়োজন।”
কোন প্রাণী সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে?
গবেষণায় ডেক্যাপডস, ওডোনেটস, মলাস্ক ও মাছ– এই চারটি দলের মিঠা পানির প্রাণী প্রজাতির ওপর নজর দেন গবেষকরা। এরা বেঁচে থাকে মিঠা পানির আবাসস্থলের ওপর নির্ভর করে।
● ডেক্যাপডস: এ দলে কাঁকড়া, চিংড়ি ও ক্রাইফিশ প্রজাতির প্রাণীরা রয়েছে, যার প্রায় ৩০ শতাংশ প্রজাতি বর্তমানে হুমকির মুখে। কীটনাশক দূষণের কারণে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে এরা।
● ওডোনেটস: বসবাসের উপযোগী জায়গা কমে যাওয়ায় ঝুঁকিতে আছে গঙ্গা-ফড়িং ও ফড়িং, যার অর্ধেকেরও বেশি বিপন্ন প্রজাতির ওপর প্রভাব পড়ছে কৃষিকাজ ও কাঠ কাটার মাধ্যমে জলাভূমি ধ্বংসের কারণে।
● মলাস্ক: গবেষণায় এ দলটি নিয়ে পুরোপুরি বিশ্লেষণ করা না হলেও আগের বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, মিঠা পানির শামুক ও ঝিনুকের মতো মলাস্ক প্রজাতির প্রায় এক তৃতীয়াংশ প্রাণী বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে।
● মাছ: দূষণ ও আবাসস্থল ধ্বংসের বিষয়টি মিঠা পানির মাছেরও ক্ষতি করছে, যা এদের বেড়ে ওঠা ও প্রজননের ওপর প্রভাব ফেলছে।
মিঠা পানির প্রজাতি রক্ষার জন্য প্রয়োজন বৈশ্বিক সহযোগিতা ও পানি সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা। সরকার, বিজ্ঞানী ও বিশ্বের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষকে অবশ্যই দূষণ কমাতে, প্রাণীদের আবাসস্থল পুনরুদ্ধার ও এদের সংরক্ষণ কৌশল তৈরিতে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। মিঠা পানির বাস্তুতন্ত্র ছোট হলেও পৃথিবীতে প্রাণের জন্য এদের গুরুত্ব অপরিসীম।
বায়ান্ন/একে