আরব্য বাস্তবতার বেদুইন উত্তরাধিকার নিয়ে সারাসার অন্বেষণ বা সবিশেষ ব্যাখার অবকাশ এখানে নেই। বেদুইন উত্তরাধিকার বংশ পরম্পরায় মিইয়ে যাবার নয়। বরং স্বমহিমায় উজ্জীবিত হয়ে ডালপালা বিস্তার করে।
বংশ প্রধানের মৃত্যুর আগে তিনি উত্তরসূরিদেরকে ডেকে জানান দিয়ে যান, কে দোস্ত কে দুশমন। কার সাথে কেমন ব্যবহার করতে হবে সেটিও বাতলে দিয়ে যান। উত্তরসূরিরা সেই তরিকা এবং নির্দেশনা প্রাণান্ত হয়েও পালন এবং লালন করে। বেদুইন উত্তরাধিকারের একটি জ্বলন্ত উদাহরণ বাংলাদেশে বিদ্যমান রাজনীতিতে রয়ে গেছে। ১৯৭১ সনে যে মহল বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায় নি, পাকিস্তানিদের দালালি করেছে এবং মুক্তিবাহিনী ও ভারত বিরোধিতায় পঞ্চমুখ ছিল। তাদের উত্তরাধিকারী এবং আত্মীয় স্বজনরা পূর্বসূরিদের তরিকা যথাযথভাবে বহাল রেখেছে। তারা আওয়ামী লীগ, শেখ মুজিব এবং হাল আমলের শেখ হাসিনার নাম শুনলেই তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে। ভারত বিদ্বেষ তো আছেই। সুযোগ পেলে বাংলাদেশকে বলে ভাঙ্গাদেশ। রাজনীতিতে এটি বেদুইন উত্তরাধিকার। সহজভাবে বললে বলা যাবে জাত এবং রক্তের ধারাবাহিকতা। গণতান্ত্রিক অধিকার বলে অথবা গণতন্ত্রের বুলি কপচিয়ে তারা এই ধারাবাহিকতাকে অক্ষুণœ রাখতে পেরেছে। পূর্বসূরিরা যেহেতু বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায় নি সেহেতু উত্তরসূরিরাও এদেশে উন্নতি এবং মঙ্গল কামনা করবে কোন দুঃখে?
কূটনীতির ক্ষেত্রেও একই বাস্তবতা দৃশ্যমান বৈ কি। বহিরাবরণে বন্ধুত্ব এবং শিষ্টাচারের মাধুরী থাকলেও অন্তরের বিষজীবাণু অলক্ষ্যে ক্রিয়াশীল থাকে। শেষ পর্যন্ত এই বিষজীবাণু উপসর্গের আদল নিয়ে কার্যকর হয়। তার উদাহরণ হচ্ছে বাংলাদেশের সাথে আমেরিকার সাম্প্রতিক কূটনীতি। বাংলাদেশের ভোট ব্যবস্থাকে উপলক্ষ করে মার্কিন ভিসানীতি বা স্যাংশন কার্যকর হয়েছে। সতেরো কোটি মানুষের বেঁচেবর্তে থাকার জন্য তো মার্কিন ভিসা তেমন অত্যাবশ্যক নয়। আমেরিকা নির্ভর হয়ে দেশের মানুষ বেঁচেবর্তে থাকবে এমন আশা আহাম্মকও করে না। তারপরও এই ভিসা স্যাংশন একটি রাষ্ট্রের জন্য কূটনৈতিক চপেটাঘাত সমতুল্য। তার জের কোথায় গিয়ে ঠেকবে এই মুহূর্তে বলা মুশকিল। এটি মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার। তবে গাঙ্গেয় এই বদ্বীপের ক্ষেত্রে মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গি কোনোদিনই সুখকর ছিল না। পাকিস্তানি আমলে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতি তাদের দরদ ছিল। সেখানকার প্রকল্পসমূহে মার্কিন অনুদান বা ঋণ ছিল অতিমাত্রায়। এই ঋণের টাকা পরিশোধ করা হতো পূর্ববাংলার মানুষের রক্ত চোষে। বাঙালিরা ক্ষমতাধর হোক সেটি মার্কিনিদের কাম্য ছিল না। ১৯৫৪ সনের নির্বাচনে হক-ভাসানী সোহরাওয়ার্দীর ঐক্যের প্রতীক যুক্ত ফ্রন্টকে সুনজরে দেখেনি আমেরিকা। এই জোটের বিপুল বিজয়ের ফসল হিসেবে পূর্ববাংলায় গঠিত সেরে বাংলার নেতৃত্বাধীন মন্ত্রী পরিষদকে প্রথম আঘাত হেনেছিলে যুক্তরাষ্ট্র। কলকাতাতে শেরেবাংলার এক ভাষণের বিকৃতি ঘটিয়ে জনৈক মার্কিন সাংবাদিকের প্রেরিত রিপোর্টই মন্ত্রী পরিষদ ভাঙার হাতিয়ার হয়ে ওঠেছিল। নেপথ্যে ছিল মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগের ইন্ধন।
১৯৭০ সনের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে প্রতিহত করার জন্য মার্কিনি বরাদ্দ কম ছিল না। তথাপি বঙ্গবন্ধুর যাদুকরী প্রভাবে ভূমিধস বিজয় অর্জিত হওয়ায় মার্কিনমহলের মাথা বিগড়ে গিয়েছিল। অতঃপর মার্কিনি সহযোগিতা নিয়েই পাকিস্তানি সামরিক জান্তা পূর্ববাংলায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ৭১ সনের বিশ্ব বিবেককে অগ্রাহ্য করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানি সামরিক জান্তাকে সামরিক সাহায্য অব্যাহত রেখেছিল। পাকিস্তানিদেরকে রক্ষাকল্পে এবং মুক্তি ও মিত্র বাহিনীর বিজয় ঠেকাতে মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্র বঙ্গোপসাগর অভিমুখে সপ্তম নৌবহর ধাবিত করতেও কুণ্ঠিত ছিল না। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। ঘন মেঘ বেষ্টনী অতিক্রম করে বাংলার আকাশে স্বাধীনতার নব সূর্য উদিত হয়েছিল আপন প্রভা নিয়ে। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্টের সামরিক উপদেষ্টা হেনরিকিসিঞ্জার পূর্ব পাকিস্তানে পাকবাহিনীর পরাজয়কে নিজের পরাজয় হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। এই পরাজয়ের প্রতিশোধ কী ১৯৭৫ সনে নেওয়া হয়নি?
বাংলাদেশে অবাধ এবং অংশগ্রহণ মূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানকে অজুহাত হিসেবে খাড়া করে ভিসা স্যাংশন আরোপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পলিসির ব্যাপার। তাদের পলিসির কত রূপ কত বৈচিত্র্য তা নির্ণয় করা মুশকিল। গণতন্ত্র নাকি তাদের মূল উপজীব্য। কারণ বিশ্বের মধ্যে আমেরিকা নাকি গণতন্ত্রের গার্জিয়ান। কিন্তু যে সমস্ত দেশে গণতন্ত্রের বালাই নেই, প্রজাতন্ত্রের পরিবর্তে যেখানে রাজতন্ত্র মূখ্য এবং ভোটের চর্চা অনুপস্থিত, সে সমস্ত দেশের সাথে আমেরিকার সম্পর্কটি দা-কুমড়ার মতো? সখ্যতার বন্ধন তো সেখানে অন্য মতলবে। ভিসার তলোয়ার সেখানে খাপবন্দী থাকে। দরদ এবং অজুহাত শুধু বাংলাদেশের জন্য! বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সংবিধান স্থগিত করে গণতন্ত্রের মুখে টুটি চেপে দুই দুইবার যখন সামরিক স্বৈরশাসনের অধিষ্টান ঘটেছিল তখন মার্কিনিদের গণতন্ত্রের এবং ভোটপ্রীতি কোথায় ছিল? মানবাধিকার ও গণতন্ত্রকে বস্তাবন্দী রেখে স্বৈরশাসকদেরকে তখন পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়েছিল হাতের পুতুলের মতো নাচানোর আনুগত্য আদায়ের ভিত্তিতে। এখন নাচানো যাচ্ছে না। সমস্যা তো বোধহয় এখানেই। অন্তর্নিহিত অভিসন্ধি তো আরও আছে। যাকে দেখতে নারী তার চলন বাঁকা (?)। অন্যদিকে সহজাত গাত্রদাহ তো আছেই। গাঁও-গেরামের বিত্তহীন পরিবারে যখন সম্ভবনার ফুলকি ছুটে আসে তখন বনেদি পরিবার সমূহের গাত্রদাহসহ মাথাব্যথা জেকে বসে। কীভাবে এই সম্ভাবনাময় পরিবারকে পিছুটানে ধরাশায়ী করা যায় এই কুমতলব তখন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। শুরু হয় ষড়যন্ত্র এবং নষ্টের খেলা। বাংলাদেশের অবস্থাটাও তদ্রূপ।
হেনরিকিসিঞ্জারের কথিত তলাবিহীন ঝুড়ি এবং মধ্যপ্রাচ্যীয় শেখদের ভাষায় মিসকিন বাংলাদেশ এখন হাঁটি হাঁটি পায়ে অগ্রসর হয়ে সম্ভবনার দ্বারপ্রান্তে উপনীত। তিনদশক আগের বাংলাদেশ এবং বর্তমান বাংলাদেশের মধ্যে এন্তার ব্যবধান সূচিত হয়েছে। এই সূচকের অনুঘটক এবং পথপ্রদর্শক হচ্ছেন শেখ হাসিনা। বিশ্বের কয়েকজন বরণ্য প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে তিনি অন্যতম। তাই এই সরকারকে বেকায়দায় ফেলে অগ্রযাত্রাকে পিছুটানে ধরাশায়ী করার খেলা যে শুরু হয়েছে সেটিতো অনুমান সাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু ষড়যন্ত্র ভ্রুকুটি এবং পিছুটান যে সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য তেমন তো নয়। ভ্রুকুটি এবং প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে উত্তর কোরিয়া, কিউবা ভিয়েতনাম এবং ইরান কী নিজ নিজ অবস্থানে সংহত নয়? চীনের উল্লেখ নাই বা করলাম। ভূরাজনৈতিক অবস্থানের দিক থেকে বাংলাদেশ তো ছিটমহলের কোনো পর্ণকুটির নয় যে পাহাড়ি চতুষ্পদ দুয়ার ঠেলে ঘরে প্রবেশ করে সবকিছুকে তছনছ করে দেবে? জেনেটিক প্রভাবে বাঙালি জাতি লড়াকু। ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, খড়া, বন্যাসহ যাবতীয় প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করেই তো রচিত হয়েছে তাদের বর্তে থাকার ইতিহাস। ‘নাই নাই ভয় হবে হবে জয়।’ এই অনুভূতিকে চাঙ্গা করলে এবং শিরদাঁড়া খাড়া করলে অবশ্যই বলা যাবে-রাখে আল্লাহ মারে কে।